চট্টগ্রাম শুক্রবার, ১০ মে, ২০২৪

সর্বশেষ:

বদলে যাচ্ছে মধ্যপ্রাচ্য

২২ মে, ২০২৩ | ৭:০২ পূর্বাহ্ণ

[মরক্কো থেকে মিশর হয়ে আরব উপসাগরীয় দেশগুলো এবং ইরান ও তুরস্ককে নিয়ে বিশাল পরিধির মধ্যপ্রাচ্যে দ্রুতই পট পরিবর্তন চলছে। গত কয়েক মাসে আমরা এমন তৎপরতা সেখানে দেখেছি, যা ক’বছর আগেও আমাদের কাছে আশ্চর্যজনক মনে হতো।]

সৌদি আরব চীনের সহায়তায় সরাসরি আলোচনার মাধ্যমে ইরানের সাথে সম্পর্ক স্থাপন করছে। ইয়েমেনে আবার ইরানকে সাথে নিয়ে আলোচনার মাধ্যমে একটা মীমাংসার চেষ্টা চলছে। ইসরায়েল দ্রুত অর্থনৈতিক এবং ক্রমবর্ধমান রাজনৈতিক সম্পর্ক গড়ে তুলছে আরব দেশগুলির সাথে। বিশেষত ক’ বছর আগে স্বাক্ষর হওয়া আব্রাহাম চুক্তির উপর ভিত্তি করে ইসরায়েল সংযুক্ত আরব আমিরাত, বাহরাইন এবং মরক্কোর সাথে দ্রুত সম্পর্ক স্বাভাবিক করার চেষ্টায় আছে।

সৌদি আরব সাধারণত ওপেক নীতির নির্ভরযোগ্য সমর্থক, যা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বরাবর চেয়ে এসেছে। সম্প্রতি দেশটি ওপেক তেল উৎপাদন বজায় রাখার মার্কিন আহ্বান প্রত্যাখ্যান করার অভূতপূর্ব অবস্থান নিয়েছে এবং পরিবর্তে ওপেক-কে উৎপাদন কমানোর ঘোষণা দিয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলোর রাশিয়ার বিরুদ্ধে আরোপিত নিষেধাজ্ঞায় আরব রাষ্ট্রগুলো স্পষ্টভাবে নিরপেক্ষ থাকার প্রেক্ষাপটে এসব ঘটছে। অবশেষে, গত সপ্তাহে আমরা দেখেছি সিরিয়াকে আরবের বৃহত্তর সম্প্রদায়ের মধ্যে স্বাগত জানানো হয়েছে গত ১০ বছরের মধ্যে প্রথমবারের মতো আরব লীগের বৈঠকে অংশগ্রহণের মাধ্যমে।

তাহলে কী ঘটছে এতদাঞ্চলে এবং আমরা যে ঘটনাগুলি দেখছি তার প্রভাবটাই বা কী?
মধ্যপ্রাচ্যের এ পরিবর্তিত বিশ্বকে বোঝা যাবে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের মৌলিক বাস্তবতা দ্বারা। লর্ড অ্যাক্টনের বিখ্যাত একটি উক্তি সম্পর্কটাকে ব্যাখ্যা করার জন্য বোধহয় যথেষ্ট। অ্যাক্টন বলেছিলেন, ‘জাতিগুলির মধ্যে কোনোও স্থায়ী জোট থাকে না, তাদের মধ্যে থাকে স্থায়ী স্বার্থ’। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর (বিশেষ করে আরব উপসাগরীয় রাষ্ট্রগুলো) ‘স্বার্থ’ এখন বেশ কিছু গভীর পরিবর্তনের মাধ্যমে রূপ পেতে চলেছে।
১. স্বভাবতই বর্তমান বিশ্বব্যবস্থায় মধ্যপ্রাচ্যের চেয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ‘অগ্রাধিকার’ অনেক বেশি। নতুন বিশ্ব পরিস্থিতিতে চীন-রাশিয়ার সঙ্গে মার্কিন ক্ষমতার দ্বন্দ্বের ক্ষেত্রে এখন দেখা যাচ্ছে যে, বাইডেন প্রশাসনের মূল ফোকাসটা রয়েছে ‘ইন্দো-প্যাসিফিক’ অঞ্চল আর ইউক্রেন সংঘাতের উপর। মধ্যপ্রাচ্যে সক্রিয় অংশগ্রহণ থেকে (তত্ত্বগতভাবে না হলেও) বাস্তবে মার্কিন বিচ্ছিন্নতার শিকড় অনেক গভীরে। আমেরিকানরা এখন ‘বিদেশি যুদ্ধে’ ক্লান্ত; বিশেষত ইরাক আর আফগানিস্তানের বিপর্যয়কর ফলাফলের পরে ওরকম যুদ্ধে জড়িত হওয়ার ঝুঁকি নিতে ইচ্ছুক নয়। তার ওপর, ২০ বছর আগের পরিস্থিতির অনেকটাই বিপরীতে অবস্থান এখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের। সে সময় বিদেশি তেলের উপর ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল ছিল দেশটি। কিন্তু ২০১৮ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বের বৃহত্তম তেল উৎপাদনকারী হয়ে ওঠে এবং আজ রাশিয়া বা সৌদি আরবের চেয়েও বৃহত্তর তেলের রিজার্ভের ওপর বসে আছে তারা। তাই সহজ একটা প্রশ্ন করাই যায়, যদি এটি তেল সম্পর্কে না হয় কিংবা ইসরায়েলের নিরাপত্তা সম্পর্কিত, তাহলে যুক্তরাষ্ট্রের কেন

মধ্যপ্রাচ্যকে অগ্রাধিকার দিতে হবে ইউক্রেন সংঘাত বা চীন থেকে?
২. মধ্যপ্রাচ্যের প্রধান চ্যালেঞ্জ হিসেবে ইরানের দিকে যুক্তরাষ্ট্রের নজর নেই, যা আরব উপসাগরীয় দেশগুলিকে সন্তুষ্ট করতে পারে। যদিও ট্রাম্প প্রশাসন ইরানকে চ্যালেঞ্জ করার বিষয়ে অনেক কথা বলেছে, সৌদি আরব এবং সংযুক্ত আরব আমিরাত উভয় দেশই বিশ্বাস করে যে, নিরাপত্তার ক্ষেত্রে পর্যাপ্ত কোনোও ফলোআপ ছিল না, বিশেষ করে ২০২০ এবং ২০২১ সালে তাদের দেশের মূল স্থাপনায় ড্রোন হামলার পর। একইভাবে সৌদিরাও বিশ্বাস করে যে, ইয়েমেনে সৌদি লক্ষ্যকে পর্যাপ্ত সমর্থন করেনি মার্কিন প্রশাসন। ‘কম্বল নিরাপত্তা ছাতা’র বিনিময়ে ‘মার্কিন শক্তির স্বার্থ’র প্রতি সৌদি সমর্থনের ঐতিহাসিক কৌশলগত ‘কুইড প্রো কো’ ম্লান হয়ে যাচ্ছে বলে মনে হচ্ছে।

৩. অধিকৃত ফিলিস্তিনের ইস্যুটি আরব দেশগুলির জন্য তার ‘প্রাসঙ্গিকতা’ হারাতে বসেছে বা এটাকে তারা আর আগের মতো তেমন ‘জরুরি’ মনে করছে না। যদিও অনেক আলাপ চলছে কিন্তু সমাধানের দিকে এগিয়ে যাওয়ার জন্য সামান্য ‘শক্তি’ অবশিষ্ট আছে। আরব দেশগুলির জন্য, ইসরায়েলের সাথে অর্থনৈতিক তৎপরতা বৃদ্ধি এবং ইরানের প্রভাব মোকাবেলায় আরও বেশি মনোযোগ দানের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে বলে মনে হয়। আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক শক্তিগুলো, বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, অধিকৃত ফিলিস্তিনের ইস্যু থেকে কার্যত বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে।

৪. অবশেষে, প্রধান শক্তিগুলো (মার্কিন, রাশিয়া এবং চীন) তাদের প্রতিযোগিতা আরো শাণিতকরণে ব্যস্ততার পাশাপাশি আঞ্চলিক শক্তিগুলোও নানা ছল-ছুতোয় তাদের প্রভাব বিস্তার করতে ছাড়ছে না। তুরস্ক এখন একটি আঞ্চলিক শক্তি এবং প্রেসিডেন্ট এরদোগান সচেতনভাবে সমগ্র অঞ্চল জুড়ে অটোমান আমলের প্রভাব প্রয়োগ করার চেষ্টা করছেন। সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত এবং কাতার, ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসনের পর তেলের আয় নাটকীয়ভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে, তারা অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিকভাবে তাদের সীমানার বাইরে প্রভাব বিস্তার করছে। এটি লিবিয়া, ইথিওপিয়া, সোমালিয়া এমনকি সুদানেও স্পষ্ট।

তাহলে সামনের মাসগুলিতে আমরা কী দেখার আশা করতে পারি? আমি বিশ্বাস করি যে, আমরা ‘আঞ্চলিক খেলোয়াড়দের’ ক্রমবর্ধমানভাবে তাদের নিজস্ব স্বার্থ হাসিলে আন্তঃসম্পর্কের একটি নতুন জটিল সমীকরণ তৈরি করতে দেখবো; যার মাধ্যমে তারা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, চীন এবং রাশিয়ার মতো বহিরাগত বৃহৎ শক্তিগুলোকে কাজে লাগাবে।

একভাবে দেখলে এটি অনেকটা ‘ভবিষ্যতে ফিরে যাওয়া’র মতো ব্যাপার। বরং মধ্যপ্রাচ্য পশ্চিমা বহিরাগত শক্তিগুলোর ‘আখড়া’য় পরিণত হবার চেয়ে আমরা দেখতে পাব তুরস্ক, সৌদি আরব, ইরান, সংযুক্ত আরব আমিরাত কিংবা কাতারের মতো দেশগুলি জনগণের আকাক্সক্ষা দ্বারা চালিত হয়ে তাদের স্ব স্ব ভাগ্য নিয়ন্ত্রণ করছে।

এটি আমাদের সকলের জন্য একটি ‘পাঠ’ হওয়া উচিত। বৈশ্বিক শক্তিগুলির চোখ দিয়ে বিশ্বকে দেখার সনাতন দৃষ্টিভঙ্গি থেকে আমাদের সরে আসতে হবে এবং আমাদের আঞ্চলিক ঘটনাবলীর দিকে আরও বেশি মনোযোগ দেওয়া উচিত।
যদিও অতীতে নিহিত ‘ষড়যন্ত্র তত্ত্ব’র মাধ্যমে ঘটনাগুলি ব্যাখ্যা করা সহজ এবং অনেকক্ষেত্রেই সুবিধাজনক; বর্তমান বিশ্বের বাস্তবতায় (যদিও এটি অনেক বেশি অগোছালো এবং জটিল) আমাদের বুঝতে হবে, শেষ পর্যন্ত এটি এমন এক বিশ্ব যেখানে ‘আত্মসংকল্প’ এবং উন্নতির জন্য অনেক বেশি সম্ভাবনা রয়েছে। [অনূদিত]

লেখক : সিইও, ডব্লিউএন্ডএ কনসাল্টিং : প্রাক্তন প্রধান কৌশলী ও প্রশাসনিক কর্মকর্তা হারশে (ঐবৎংযবু),ফার্মার ব্রাদার্স’র পরিচালনা পরিষদের সদস্য। এছাড়াও ‘ফরচুন ফাইভ হানড্রেড’ কোম্পানির বেশ ক’টি প্রতিষ্ঠানের নেতৃত্ব দিয়েছেন তিনি। বর্তমানে উদ্যোক্তাদের পরামর্শ আর সিনিয়র এক্সিকিউটিভদের প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট