চট্টগ্রাম শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

কী হবে ফাঁদের পরিণতি

আফতাবুজ্জামান , নিউজিল্যান্ড

২৯ মে, ২০১৯ | ২:৫৯ পূর্বাহ্ণ

মে মাসের ১৫ তারিখ প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প কার্যনির্বাহী আদেশ ১৩৮৭৩ স্বাক্ষর করেন। এই আদেশ অনুযায়ী আমেরিকার কোন প্রতিষ্ঠান “শত্রু ভাবাপন্ন বিদেশি কোন প্রতিষ্ঠানের” সাথে লেনদেন করতে পারবে না। কিছুদিন পর চীনের হুয়াওয়েই কে ‘নিরাপত্তার ঝুঁকি’ হিসাবে ঘোষণা করা হয়, এবং বিশেষ অনুমতি ছাড়া হুয়াওয়েইর সাথে সব সহযোগিতা নিষিদ্ধ করা হয়। হুয়াওয়েই পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম সেলফোন প্রস্তুতকারক এবং বেতার যোগাযোগের সরঞ্জামাদির সবচেয়ে বড় প্রস্তুতকারক। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল, ফাইভ জি প্রযুক্তিতে হুয়াওয়েই সবার চেয়ে অনেক এগিয়ে। নিষেধাজ্ঞা জারির পর গুগল, ছঁধষধপড়সস, অজগ সহ আরও কিছু কোম্পানি হুয়াওয়েইর সাথে সহযোগিতা বন্ধের ঘোষণা দেয়। এর ফলে হুয়াওয়েইর ফোন ব্যবসা বর্তমানে চরম হুমকির মুখে। আমেরিকা হুয়াওয়েইকে ধংসের জন্য কেন এতো মরিয়া হয়ে উঠেছে তা বুঝতে হলে আমাদের ইতিহাসের দিকে দৃষ্টিপাত করতে হবে।
গ্রীক ঐতিহাসিক থুসিডিডিসের (ঞযঁপুফরফবং) জন্ম খ্রিস্টের জন্মের ৪৬০ বছর আগে। অনেকেই তাকে ইতিহাসের সবচেয়ে বড় ‘ঐতিহাসিক’ মনে করেন, অনেকে তাকে “বৈজ্ঞানিক ইতিহাসের” জনক ভাবেন। তাঁর যুগে গল্প গাথায় বা ইতিহাসে দেবদেবীদের প্রভাবের কথা উল্লেখ করা হতো। তিনি প্রথম দেবদেবী বাদ দিয়ে রাজনৈতিক এবং মানবিক গুণাবলীর ভিত্তিতে ঐতিহাসিক বা সমসাময়িক ঘটনার বিশ্লেষণ করেন। তাঁর যুগে সবচেয়ে বড় যুদ্ধ হয় এথেন্স এবং স্পারটার মধ্যে। স্পারটা ছিল শত বছরের প্রতিষ্ঠিত শক্তি আর এথেন্স ছিল উদীয়মান শক্তি। এই যুদ্ধের কারণ বিশ্লেষণ করে থুসিডিডিস বলেন, যখন কোন উদীয়মান শক্তি প্রতিষ্ঠিত কোন শক্তির সমকক্ষ হয় বা হবার কাছাকাছি হয় তখন তাদের মধ্যে যুদ্ধ হয়। এই যুদ্ধের মূল কারণ হচ্ছে, ভয়, স্বার্থ আর সম্মান। ২০১২ সালে হার্ভার্ডের প্রফেসর গ্রাহাম এলিসন “থুসিডিডিসের ফাঁদ” কথাটির প্রচলন করেন। তাঁর মতে ইতিহাসে ১৬ বার প্রতিষ্ঠিত শক্তি আর উদীয়মান শক্তি মুখোমুখি হয়েছে এবং ১২ বার এই সংঘাত যুদ্ধে রূপ নিয়েছে। তিনি ইতিহাস বিশ্লেষণ করে দেখান যে, শুধু যুদ্ধের খাতিরে বড় শক্তিরা যুদ্ধ করেনি, করেছে ভয়, সম্মান আর স্বার্থের জন্য। এই তিন উপাদানকে ফাঁদ হিসাবে বর্ণনা করে গ্রাহাম এলিসন যুক্তি দেখান যে চীন আর আমেরিকা এই ফাঁদে পড়েছে। দুই পক্ষের আন্তরিক প্রচেষ্টা না থাকলে এই দুই শক্তির যুদ্ধের সম্ভাবনা খুব বেশি।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সমাপ্তির পর আমেরিকা পৃথিবীর সবচেয়ে বড় শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়। সময়ের সাথে আমেরিকার শক্তি এবং প্রভাব বিশ্বময় ছড়িয়ে পড়ে। জ্ঞান, বিজ্ঞান, অর্থনীতি এবং সামরিক ক্ষেত্রে আমেরিকা অভূতপূর্ব শক্তির অধিকারী হয়। সোভিয়েত ইউনিয়ন এর পতনের পর বিশ্বব্যাপী আমেরিকার প্রভাব একচ্ছত্র রূপ লাভ করে। বলা হয়ে থাকে আমেরিকার মতো এতো বড় শক্তি পৃথিবী আর দেখেনি। এই পটভূমিতে শুরু হয় চীনের উত্থান। বিগত চার দশকে বিভিন্ন ক্ষেত্রে চীন এতো দ্রুত আর এতো বেশি উন্নত হয়েছে যে পৃথিবীর ইতিহাসে তা নজিরবিহীন। ধারণা করা হচ্ছে, এক দশকের মধ্যে অর্থনৈতিক শক্তি হিসাবে চীন আমেরিকাকে ছাড়িয়ে যাবে। কৌশলগত প্রযুক্তিতে চীন এগিয়ে যাচ্ছে এবং এক থেকে দুই দশকের মধ্যে আমেরিকাকে ছাড়িয়ে যাবে বলে অনেকের ধারণা। এর ফলে বিশ্বব্যাপী চীন প্রধান শক্তি হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হবে। চীনের উত্থান ঠেকাতে ওবামার আমলে এশিয়া এবং প্রশান্ত মহাসাগরীয় কিছু দেশের সাথে আমেরিকা টিপিপি নামের বাণিজ্য চুক্তি করে। ট্রাম্প ক্ষমতাসীন হবার অল্প কিছুদিনের মধ্যে এই চুক্তি রদ করেন। ট্রাম্প এবং তাঁকে ঘেরা কট্টরপন্থীরা মনে করেন, চীনকে আরো সরাসরি মোকাবিলা করতে হবে। সাম্প্রতিক ঘটনা প্রবাহ পর্যবেক্ষণে ধারণা করা যায় যে, আমেরিকা চীনকে অর্থনৈতিক এবং প্রযুক্তিগত ক্ষেত্রে সরাসরি আঘাত করতে চায়। অর্থনৈতিক মোকাবিলার জন্য আমেরিকা চীনের কয়েকশ পণ্যের উপর ১০% থেকে ২৫% আমদানি শুল্ক আরোপ করেছে। চীন পাল্টা শুল্ক আরোপ করে এর জবাব দিয়েছে। এই পদক্ষেপে দুই পক্ষের ক্ষতি হলেও, কেউ ছাড় দিতে রাজি নয়। আমেরিকা মনে করছে, নিজের ক্ষতি হলেও চীনের অর্থনৈতিক অগ্রগতি থামাতে হবে। প্রযুক্তিগত ক্ষেত্রে আমেরিকার বেশি ভয় হুয়াওয়েই কে, কারণ হুয়াওয়েই ফাইভ জি প্রযুক্তিতে সবাইকে ছাড়িয়ে গেছে। ধারণা করা হয়, ফাইভ জি প্রযুক্তির অবকাঠামো যাদের হাতে থাকবে আগামী ১০ থেকে ২০ বছর ইন্টারনেট, আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স সহ আরো অনেক প্রযুক্তি তাদের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়বে। তাই আমেরিকার বর্তমান প্রশাসন হুয়াওয়েই কে পঙ্গু বা বিলুপ্ত করে দিতে বদ্ধপরিকর যদিও এতে আমেরিকার অনেক প্রতিষ্ঠান, যারা হুয়াওয়েইর কাছে বছরে ১০ বিলিয়ন ডলারের বেশি প্রযুক্তি বিক্রি করে, তারা ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
গত ২০০ বছর বাদ দিলে বিগত ৩০০০ বছরে চীন ছিল পৃথিবীর সবচেয়ে বড় সভ্যতা আর অর্থনৈতিক শক্তি। চীন মনে করে পশ্চিমা শক্তি তাদের সভ্যতাকে ধ্বংস করেছে, তাদের দরিদ্র করেছে, এখন সময় এসেছে তাদের মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর। আমেরিকার প্রভাবশালী মহল ভয় করে, চীনের উত্থান মানে আমেরিকার পতন, তাই চীনের উত্থান ঠেকাতে তারা বদ্ধপরিকর। একদিকে সম্মান আর স্বার্থ। অন্যদিকে ভয় আর স্বার্থ। ফাঁদ পাতা হয়ে গেছে। বলা কঠিন, এই ফাঁদের পরিণতি কী হবে।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট