চট্টগ্রাম বৃহষ্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

রাজস্ব দুর্বলতার কারণে চলতি বাজেটেও হবে না লক্ষ্যপূরণ : আইএমএফ

নিজস্ব প্রতিবেদক

১৯ অক্টোবর, ২০১৯ | ৪:০২ অপরাহ্ণ

দেশের অর্থনীতির ব্যাপ্তির সঙ্গে পাল্লা দিতে প্রতি বছরই বাড়ছে জাতীয় বাজেটের আকার। তবে বাজেটের বড় লক্ষ্যমাত্রা এবং তা বাস্তবায়নের মধ্যে তৈরি হচ্ছে দূরত্ব, যা অর্থবছর শেষে ঘাটতি হিসেবে দেখা যাচ্ছে। মূলত রাজস্ব আহরণের দুর্বলতায় বাজেটে আয়-ব্যয়ের লক্ষ্য পূরণ হচ্ছে না। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদন বলছে, চলতি ২০১৯-২০ অর্থবছরের বাজেটেও লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় প্রকৃত আয় ও ব্যয়ের অংকে বড় ব্যবধান থাকবে। ফলে সামগ্রিকভাবে বাজেটের বাস্তবায়ন লক্ষ্য পূরণ হবে না বলে পূর্বাভাস দিয়েছে সংস্থাটি।

অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও নীতি বিষয়ে বাংলাদেশের সংশ্লিষ্ট সরকারি কর্মকর্তাদের সঙ্গে আইএমএফ প্রতিনিধি দলের ধারাবাহিক বৈঠকের ভিত্তিতে এ অগ্রগতি প্রতিবেদনটি তৈরি করা হয়। এতে বলা হয়েছে, চলতি অর্থবছর মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ১৩ দশমিক ২ শতাংশ আয়ের লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে অর্জন হবে ১০ দশমিক ২ শতাংশ। লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় আয় না হলে ব্যয়ের ক্ষেত্রেও তার প্রভাব পড়বে। ফলে জিডিপির ১৮ দশমিক ১ শতাংশ হিসাবে ব্যয়ের যে প্রাক্কলন করা হয়েছে, তা বছর শেষে দাঁড়াবে ১৫ দশমিক ১ শতাংশ। আর ঘাটতিও হবে প্রাক্কলনের মতোই ৪ দশমিক ৯ শতাংশ।

আইএমএফ বলছে, প্রতি বছরই বাজেটের লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত না হওয়ায় শেষদিকে এসে ব্যয়ের খাত সংকুচিত করতে হয়। এর প্রভাব পড়ে সরকারের বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পে। এ অবস্থায় অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও অবকাঠামোগত উন্নয়নে কর আহরণ বাড়ানোর বিকল্প নেই।

চলতি অর্থবছরের বাজেটে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) আকার নির্ধারণ করা হয়েছে ২ লাখ ২ হাজার ৭২১ কোটি টাকা। এ অর্থে মোট ১ হাজার ৫৬৫টি প্রকল্প বাস্তবায়নের পরিকল্পনা রয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাজেটে আয়ের সংস্থান না হলে শেষে এডিপির বরাদ্দ কমিয়ে দেয়া হয়। আবার অদক্ষতা ও সুষ্ঠু ক্রয় পরিকল্পনার অভাবেও অনেক মন্ত্রণালয় নির্ধারিত সময়ে এডিপির বাস্তবায়ন করতে পারে না।

চলতি ২০১৯-২০ অর্থবছরের বাজেট জাতীয় সংসদে পাস হয়েছে গত ৩০ জুন। ৫ লাখ ২৩ হাজার ১৯০ কোটি টাকার এ বাজেটে আয়ের লক্ষ্য ধরা হয়েছে ৩ লাখ ৭৭ হাজার ৮১০ কোটি টাকা। বাজেটে কর রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা হচ্ছে ৩ লাখ ৪০ হাজার ১০৩ কোটি টাকা। এর মধ্যে এনবিআরের মাধ্যমে ৩ লাখ ২৫ হাজার ৬০০ কোটি টাকা ও এনবিআরবহির্ভূত কর রাজস্ব ১৪ হাজার ৫০০ কোটি টাকা নির্ধারণ করা হয়। সামগ্রিক ঘাটতি মেটাতে বৈদেশিক উৎস থেকে সংগ্রহ করা হবে ৬৩ হাজার ৮৪৮ কোটি টাকা ও অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে ৭৭ হাজার ৩৬৩ কোটি টাকা। অভ্যন্তরীণ উেসর মধ্যে ব্যাংকঋণের মাধ্যমে নেয়া হবে ৪৭ হাজার ৩৬৪ কোটি টাকা। এছাড়া সঞ্চয়পত্র থেকে ঋণ নেয়া হবে ২৭ হাজার কোটি টাকা। অনুদান ছাড়া আয়-ব্যয়ের ঘাটতির পরিমাণ হবে ১ লাখ ৪৫ হাজার ৩৮০ কোটি টাকা।

প্রতি বছর বাজেটের আকার বাড়লেও বাস্তবায়নের হার কমছে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, ২০১০-১১ থেকে ২০১৮-১৯ অর্থবছর পর্যন্ত নয় বছরে বাজেট বাস্তবায়নের হার ৯৭ শতাংশ থেকে কমে ৭০ শতাংশের ঘরে নেমেছে।

রাজস্ব আদায়ের দুর্বলতার কারণে বাজেটের লক্ষ্যমাত্রা বাস্তবায়ন সম্ভব হচ্ছে না বলে মনে করেন পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর। তিনি বলেন, প্রতি বছর রাজস্ব আদায়ের যে লক্ষ্যমাত্রা এনবিআরকে বেঁধে দেয়া হয়, সেই লক্ষ্য প্রতিষ্ঠানটি পুরোপুরি পূরণ করতে পারে না। এটা বাজেটে ঘাটতির অন্যতম প্রধান কারণ। এছাড়া বৈদেশিক সাহায্যের লক্ষ্যমাত্রাও পুরোপুরি বাস্তবায়ন করতে পারে না। এর প্রভাব পড়ে বাজেট বাস্তবায়নে। মোটা দাগে এ দুটি বিষয় বাজেট বাস্তবায়নে প্রভাব ফেলে। এর বাইরে বাস্তবায়নজনিত সমস্যাসহ আরো অনেক বিষয় আছে, যেগুলোর কারণে বাজেট বাস্তবায়নের সময় বড় অংকের ঘাটতি দেখা দেয়।

কর ব্যবস্থা সংস্কারের অংশ হিসেবে চলতি বছরের জুলাই থেকে নতুন ভ্যাট আইন বাস্তবায়ন শুরু হয়েছে। ৫, ৭ দশমিক ৫, ১০ ও ১৫ এ চার স্তরে ভ্যাট আরোপ করা হয়েছে নতুন আইনে। ভ্যাট নিবন্ধনের সীমা ৮০ লাখ থেকে বাড়িয়ে ৩ কোটি টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। তবে ভ্যাটের বহুস্তর, ভ্যাট নিবন্ধনের সীমানা বৃদ্ধি শিগগিরই রাজস্ব আহরণে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে কিনা, তা নিশ্চিত নয় বলে মনে করছে আইএমএফ।

আইএমএফের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৬-১৭ অর্থবছরের বাজেটে অনুদানসহ আয়ের লক্ষ্য ছিল জিডিপির ১২ দশমিক ৪ শতাংশ, বছর শেষে অর্জন ১০ দশমিক ২ শতাংশ। ওই অর্থবছর ১৭ দশমিক ৪ শতাংশ ব্যয়ের লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে অর্জিত হয়েছে ১৩ দশমিক ৫ শতাংশ। অর্থবছরটিতে বাজেট ঘাটতি ধরা হয়েছিল জিডিপির ৫ শতাংশ, যদিও বছর শেষে তা ৩ দশমিক ৪ শতাংশ হয়েছে। ২০১৭-১৮ অর্থবছর বাজেটে আয়ের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয় ১২ দশমিক ৮ শতাংশ। প্রকৃত অর্জন ছিল ৯ দশমিক ৬ শতাংশ। ব্যয়ের ক্ষেত্রে ১৭ দশমিক ৮ শতাংশ লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে অর্জন দাঁড়ায় ১৩ দশমিক ৩ শতাংশ। ২০১৭-১৮ অর্থবছর বাজেট ঘাটতি ছিল ৪ দশমিক ৭ শতাংশ। এর পরের অর্থবছর বাজেটে আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয় ১৩ দশমিক ৪ শতাংশ, যা বছর শেষে দাঁড়িয়েছে মাত্র ৯ দশমিক ৯ শতাংশ। আয়ের লক্ষ্য পূরণ না হওয়ায় উন্নয়ন ব্যয়ও কমিয়ে আনা হয় অর্থবছরটিতে। এডিপির জন্য বরাদ্দের ৫৫ শতাংশ অর্থ ছাড় করা হয়। এতে শ্লথ হয়ে যায় এডিপি বাস্তবায়নের গতি। ১৮ দশমিক ৩ শতাংশ ব্যয়ের লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে ওই অর্থবছর প্রকৃত ব্যয় দাঁড়ায় জিডিপির ১৪ দশমিক ৮ শতাংশ। যদিও অর্থবছরটিতে ঘাটতি ছিল নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রার মধ্যেই, ৪ দশমিক ৯ শতাংশ।

বাজেট বাস্তবায়নের লক্ষ্য পূরণ না হওয়ার বিষয়ে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, আমাদের দেশে এটা নতুন কিছু নয়। এর পেছনে সাধারণত দুটি প্রধান কারণ রয়েছে। প্রথমত, বাজেটে যে টার্গেট দেয়া হয় সেটা অবাস্তব। চলতি বাজেটেও রেভিনিউর ক্ষেত্রে যে লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে সেটা তারই প্রমাণ। দ্বিতীয়ত, ব্যয়ের ক্ষেত্রে প্রশাসনিক অদক্ষতার অভাব। কারণ প্রতিটি প্রকল্পের পরিচালক নির্ধারিত অর্থ সঠিকভাবে ব্যয় করেন না। ফলে এডিবিসহ অন্যদের টার্গেটও পূরণ করা সম্ভব হয় না। অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায়, প্রকল্প শুরুর প্রথম নয় মাসে কাজ হয় ৪০ শতাংশের মতো, আর বাকি তিন মাসে ৬০ শতাংশ কাজ সমাপ্ত করা হয়। ফলে কোনো কাজেরই গুণগত মান থাকে না। আবার অনেক সময় প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে বাজেটও বাড়ানো হয়। ফলে কোনো বছরই বাজেটের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করা সম্ভব হয় না।

আইএমএফের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, রেমিট্যান্স ও রফতানি প্রবৃদ্ধি ক্রমান্বয়ে বাড়ার প্রক্ষেপণ রয়েছে সরকারের। চলতি হিসাবে মধ্যমেয়াদি ঘাটতি থাকতে পারে। তবে চলমান মেগা অবকাঠামো প্রকল্পগুলোর কারণে সরাসরি বিদেশী বিনিয়োগকে (এফডিআই) আকৃষ্ট করা সম্ভব হবে। রফতানি প্রবৃদ্ধিকেও গতিশীল করবে এটি। অন্যদিকে রেমিট্যান্স প্রবাহের বিদ্যমান ধারা ব্যালান্স অব পেমেন্টের ক্ষেত্রে ঘাটতি কমিয়ে আনবে। অর্থনীতিতে আস্থা তৈরি ও এফডিআই বাড়াতে বৈদেশিক মুদ্রার পর্যাপ্ত রিজার্ভ নিশ্চিতের বিষয়ে গুরুত্ব দিচ্ছে সরকার।

পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের সদস্য (সিনিয়র সচিব) ড. শামসুল আলম বলেন, আইএমএফ যে বাজেট ঘাটতির কথা বলছে, তা আমাদের প্রাক্কলিত সীমার মধ্যেই। বাজেটের আকার বড় হলেও সে অনুযায়ী জনবল বাড়ছে না। ফলে আয় ও ব্যয়ের লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হচ্ছে না। তবে এর পরও প্রতি বছর আয় ও ব্যয়ের অংক আগের বছরের চেয়ে বাড়ছে। অর্থ সংকটের কারণে নয়, বরং অভিজ্ঞতার অভাবসহ নানা কারণে বাস্তবায়নের গতি কিছুটা শ্লথ হতে পারে বলে মন্তব্য করেন তিনি।

 

 

পূর্বকোণ/রাশেদ

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট