চট্টগ্রাম মঙ্গলবার, ০৭ মে, ২০২৪

সর্বশেষ:

স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্র হান্নান-জিয়ার উপস্থিতি ও স্বাধীনতার ঘোষণা প্রচারের পটভূমি

পূর্ব প্রকাশিতের পর

মুহাম্মদ শামসুল হক

৩১ ডিসেম্বর, ২০১৯ | ২:৫৫ পূর্বাহ্ণ

খসড়াটি নিয়ে তাঁর সঙ্গীয় ক্যাপ্টেনদের নিয়ে আলোচনার সময় আমিও উপস্থিত ছিলাম। মেজর জিয়াউর রহমান দ্বিধাগ্রস্ত, এ ঘোষণা প্রচার করা সঙ্গত হবে কি না। একজন বলেছিলেন, এই প্রাধান্য দাবি আপনাকে করতেই হবে, নইলে দেশ-বিদেশের কাছে আপনার আবেদনের গুরুত্ব কি করে হবে! তিনি (জিয়া) বলেছিলেন, কিন্তু অন্য এলাকায় আমার চেয়ে সিনিয়র বাঙালি অফিসার থাকতে পারেন। তিনিও হয়তো আমাদের মতোই বিদ্রোহ ঘোষণা করেছেন এবং প্রতিরোধ শুরু করেছেন। যা হোক, মেজর জিয়াউর রহমান আমার সম্মতি চেয়েছিলেন। বলেছিলাম ক্যান্টনমেন্টের বাইরে আপনার মতো আর কেউ আছেন কিনা মানে, কোনো বাঙালি সিনিয়র অফিসার, তার জানবার উপায় নেই। বিদেশের কাছে গুরুত্ব উৎপাদনের জন্য আপনি নিজেকে ‘বঙ্গবন্ধুর পক্ষে’ সামরিক বাহিনীর প্রধান অবশ্যই বলতে পারেন। ঘোষণাটি প্রচারের সময় ‘বঙ্গবন্ধুর পক্ষ থেকে’ উল্লেখ করা হয়নি।

এই দ্বিতীয় ঘোষণাটি কালুরঘাট এলাকার বাসিন্দা ওসমান গণি তার টেপ রেকর্ডারে বাণীবদ্ধ করেছিলেন। স্বাধীনতার পর আমাদের সহকর্মী আমিনুর রহমানের মাধ্যমে সেটির ডাবিং সংগৃহীত হয়েছিল। পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশ বেতারের চট্টগ্রাম ও ঢাকা কেন্দ্র থেকে সেটির নির্বাচিত অংশ প্রচারিত হয়েছিল, মুক্তিযুদ্ধকালীন প্রামাণ্য উপাজীব্য হিসেবে।
জিয়ার দ্বিতীয় ঘোষণা রাত ১০টায় : মেজর জিয়া নিজেকে সরকারের অস্থায়ী প্রধান হিসেবে যে ঘোষণাটি দেন সেটি যে দ্বিতীয় ঘোষণা সে সম্পর্কে বেতার প্রকৌশলী আমিনুর রহমানের বক্তব্য প্রণিধানযোগ্য, তাঁর মতে, জিয়াউর রহমান ২৭ মার্চ রাত ১০টায় এক অনুষ্ঠানে নিজেকে স্বাধীন বাংলা সরকারের অস্থায়ী প্রধান হিসেবে ঘোষণা দিয়েছিলেন। তিনি বলেন, সান্ধ্য অনুষ্ঠানের পর সংশ্লিষ্ট সবাই কালুরঘাট ট্রান্সমিটার কেন্দ্র থেকে চলে যান। রাত সাড়ে নয়টায় তিনি (আমিনুর রহমান) এবং আবদুস শাকুর ট্রান্সমিটার ভবনে আসেন। মেজর জিয়াসহ কয়েকজন সেনা সদস্য সেখানে অবস্থান করছিলেন। মেজর জিয়ার সঙ্গে পূর্ব আলাপের ভিত্তিতে তাঁরা রাত ১০টায় ট্রান্সমিটার অন করেন। তখনই জিয়া নিজেকে স্বাধীন বাংলা লিবারেশন গভর্ণমেন্টের অস্থায়ী প্রধান হিসেবে ঘোষণা দেন। পরে জয় বাংলা বলে বক্তব্য শেষ করেন। প্রসঙ্গত, আমিনুর রহমান ও শাকুরের বাড়ি ট্রান্সমিটার কেন্দ্রের কাছাকাছি।

বেতার কেন্দ্রে আরও যাঁদের অবদান : স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের প্রথম পর্যায় অর্থাৎ কালুরঘাটের সম্প্রচার কেন্দ্রটি চালুর শুরু থেকে ৩০ মার্চ পর্যন্ত বিভিন্নভাবে আরও যাঁরা উপদেশ, পরামর্শ ও সাহস যুগিয়েছেন তাঁদের মধ্যে ছিলেন ডা. আবু জাফর, অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদ, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব মাহবুব হাসান, বেগম মুশতারী শফি, আবদুল্লাহ আল হারুন চৌধুরী, ডা. আনোয়ার আলী, সুলতান আলী, খন্দকার এহসানুল হক আনসারী, এয়ার মাহমুদ, অধ্যাপিকা তমজিদা বেগম প্রমুখ।
২৬ থেকে ২৮ তারিখের মধ্যে যোগ দেওয়া বেতারকর্মী ও অন্যান্য উৎসাহী সহযোগীদের কেউ কেউ পরবর্তী সময়ে আর সম্পৃক্ত থাকেননি স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের সাথে। তবে দেশ শত্রুমুক্ত হওয়ার পর পর্যন্ত বেতারে যাঁরা জড়িত ছিলেন তাঁরা হলেনÑবেলাল মোহাম্মদ (বেতারের তৎকালীন নিজস্ব শিল্পী এবং দল নেতা), আবুল কাশেম সন্দ্বীপ (ফটিকছড়ি কলেজের তৎকালীন উপাধ্যক্ষ), সৈয়দ আবদুস শাকুর (চট্টগ্রাম বেতারের তৎকালীন টেকনিশিয়ান), আবদুল্লাহ আল ফারুক (তৎকালীন অনুষ্ঠান প্রযোজক), রাশেদুল হোসেন (তৎকালীন টেকনিক্যাল অ্যাসিস্ট্যান্ট), মোস্তফা আনোয়ার (তৎকালীন অনুষ্ঠান প্রযোজক), আমিনুর রহমান (তৎকালীন টেকনিক্যাল অ্যাসিস্ট্যান্ট), শারফুজ্জামান (তৎকালীন টেকনিক্যাল অপারেটর), রেজাউল করিম চৌধুরী (তৎকালীন টেকনিক্যাল অপারেটর) এবং কাজী হাবিবুদ্দিন (ইনি বেতারকর্মী ছিলেন না)।

বেতার কেন্দ্র রক্ষণাবেক্ষণে সেনা সদস্য ও ইপিআর বাহিনীর মধ্যে ছিলেন ক্যাপ্টেন অলি আহমদ (পরবর্তী সময়ে মন্ত্রী, বিএনপি ও এলডিপি নেতা), লে. শমসের মবিন (পরবর্তীতে বিএনপি নেতা), এম এস এ ভূঁইয়া (কোম্পানি কমান্ডার)। বেতারকর্মী ও সংশ্লিষ্ট অন্যদের সার্বক্ষণিক দেখা-শোনা, খাওয়া-দাওয়া ও থাকাসহ বিভিন্নভাবে ভূমিকা পালন করেন হারুন অর রশিদ খান ও সেকান্দার হায়াত খান। এরা দুজন সহোদর, চান্দগাঁও থানাধীন মোহরা এলাকার বাসিন্দা। পরবর্তীতে হারুন খান জাতীয় পার্টিতে যোগ দেন এবং সেকান্দর খান আওয়ামী লীগে থেকে যান। পটিয়া ও বোয়ালখালীর একাধিক ছাত্রনেতাও বেতারকর্মী ও পাহারায় নিয়োজিত সেনাদের রসদ যোগানোর কাজে সহযোগিতা করেন। (সমাপ্ত)
(সূত্র : ‘স্বাধীনতার বিপ্লবী অধ্যায়-বঙ্গবন্ধু ও অন্যান্য ৪৭-৭১’, ২০১৬, ‘স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রস্তুতি এবং বেতার ঘোষণার ইতিবৃত্ত’ ১৯৯৯, ‘ইতিহাসের খসড়া’, জানুয়ারি-মার্চ ২০১৯ সংখ্যা)

মুহাম্মদ শামসুল হক মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক গবেষণাকর্মী, সম্পাদক-ইতিহাসের খসড়া।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট