চট্টগ্রাম সোমবার, ০৬ মে, ২০২৪

সর্বশেষ:

দায়ীদের আইনের আওতায় আনা হোক আমদানির নামে টাকা পাচার

২২ ডিসেম্বর, ২০১৯ | ৪:৪২ পূর্বাহ্ণ

সাম্প্রতিক সময়ে অর্থপাচারের বিষয়টি নানা রূপেই সামনে আসছে। পেঁয়াজ আমদানির নামে অর্থপাচার করার ব্যাপারটি কেউ ভাবেনি কখনো। অথচ শুল্ক গোয়েন্দা রিপোর্ট বলছে, পেঁয়াজ আমদানির আড়ালে ২০০ কোটি টাকা দেশের বাইরে পাচার করেছেন আমদানীকারকরা। এভাবে বৈধ ও অবৈধ উপায়ে বাংলাদেশ থেকে প্রতি বছরই পাচার হচ্ছে বিপুল পরিমাণ অর্থ। পাচারকৃত এ অর্থের গন্তব্যে পরিণত হয়েছে কর অবকাশসহ বিভিন্ন ধরনের সুবিধা প্রদানকারী দেশগুলো। এজন্য মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে আমদানি-রফতানি কার্যক্রমকে। বিভিন্ন অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে দেখা যাচ্ছে, পণ্য আমদানীর নামে ব্যাংকে ঋণপত্র (এলসি) করে মূল্য পরিশোধ করা হচ্ছে, কিন্তু সেই পণ্য আসছে না। আসছে খালি কন্টেইনার, মাটি, ইট, পানি। কিন্তু এভাবে অর্থ পাচার করার ঘটনা বারবার সামনে আসলেও পাচারকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনগত পদক্ষেপ নেয়ার দৃষ্টান্ত নেই বললেই চলে। পরিণামে দিনদিন বেপরোয়া হয়ে উঠছে অর্থ পাচারকারীরা। অর্থপাচারের এমন চিত্র খুবই উদ্বেগকর।

এ কথা ঠিক যে, বাংলাদেশ থেকে অর্থপাচার কোনো নতুন বিষয় নয়। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে অর্থপাচারের ঘটনা ও পরিমাণ অবিশ্বাস্যভাবে বেড়ে গেছে। শুল্ক গোয়েন্দা প্রতিবেদনের সূত্র ধরে একটি সহযোগী দৈনিকে প্রকাশিত খবরে দেখা যাচ্ছে, মিয়ানমার থেকে প্রতি টন পেঁয়াজ ক্রয়ে আন্ডারইনভয়েসিং করা হয়েছে প্রায় ৭০০ ডলার। শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর মনে করছে এই আন্ডারইনভয়েসিংয়ের টাকা আমদানিকারকরা ব্যাংকিং চ্যানেলের বাইরে হুন্ডি ও মানি লন্ডারিং করে পাঠিয়েছে। চলতি বছরের আগস্ট থেকে নভেম্বর মাস পর্যন্ত চার মাসে দেশটি থেকে মোট ৩৪ হাজার ৮৬১ টন পেঁয়াজ আমদানি করা হয়েছে। দেশের শীর্ষ ৪৩ পেঁয়াজ আমদানিকারককে জিজ্ঞাসাবাদ ও তদন্ত শেষে শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর এ ব্যাপারে চূড়ান্ত প্রতিবেদন তৈরি করে। আর তাতেই উঠে এসেছে এই ভয়াবহ তথ্য। পণ্য আমদানির নামে আন্ডার ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে বিদেশে অর্থপাচারের যে অভিযোগটি দীর্ঘদিন ধরে শোনা যাচ্ছে তার সত্যতা মিললো শুল্ক গোয়েন্দা প্রতিবেদনে। ইতোপূর্বে দৈনিক পূর্বকোণসহ বিভিন্ন দৈনিকে আমদানীর আড়ালে ঘোষণা বহির্ভূত পণ্য ও খালী কন্টেইনার আসার বেশ কয়েকটি খবর প্রকাশিত হয়েছে। এভাবে ভুয়া এলসি করে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান পণ্য আমদানির নামে অর্থ পাচার করে যাচ্ছে দীর্ঘদিন ধরে। তবে নানা কারণে অর্থ পাচারের প্রায় ৯৫ ভাগ ঘটনাই অজানা থেকে যায়। ধরা পড়ে আমদানির আড়ালে অর্থপাচারের মাত্র ৫ ভাগ ঘটনা। আবার সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে মুদ্রাপাচার আইনে মামলা হলেও শেষ পর্যন্ত মামলার ভাগ্য কি হয় তা দেশবাসীর জানার সৌভাগ্য হয় না। আখেরে অর্থ পাচারকারীদের ভাগ্যই সুপ্রসন্ন হয় হয়তো। কিন্তু বিপরীতে চরম ক্ষতির শিকার হয় দেশ এবং জাতীয় অর্থনীতি।

সাম্প্রতিক সময়ে খেলাপী ঋণের পরিমাণ জ্যামিতিক হারেই বেড়ে চলেছে। নানা অনুসন্ধানী রিপোর্ট বলছে খেলাপীঋণের প্রায় ৯৫ শতাংশই পণ্য আমদানীসহ নানা কৌশলে পাচার হয়ে যাচ্ছে। ওয়াশিংটনভিত্তিক গবেষণা ও পরামর্শক প্রতিষ্ঠান গ্লোবাল ফিন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটির (জিএফআই) এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত ১০ বছরে বাংলাদেশ থেকে প্রায় ৬ লাখ কোটি টাকারও বেশি পাচার হয়ে গেছে। উল্লেখ্য, বাংলাদেশ থেকে পাচার হওয়া অর্থ পৃথিবীর নানা দেশে ছড়িয়ে আছে। কানাডায় বাংলাদেশি ধনীদের আবাস ‘বেগমপাড়া’ গড়ে উঠেছে পাচারকৃত অর্থে। অনেকে মালয়েশিয়ায় সেকেন্ড হোম বানিয়েছেন। সুইজারল্যান্ডের কেন্দ্রীয় ব্যাংক ‘সুইস ন্যাশনাল ব্যাংক’(এসএনবি) থেকে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে দেখা যাচ্ছে, দেশটির বিভিন্ন ব্যাংকে বাংলাদেশী নাগরিকদের জমা টাকার পরিমাণ জ্যামিতিক হারেই বেড়ে চলেছে। বাংলাদেশের মতো একটি উন্নয়নশীল দেশ থেকে যদি এত অর্থ পাচার হয় এবং বছরের পর বছর তা নির্বিঘেœ চলতে থাকে, তাহলে তো দেশের সাধারণ মানুষের জীবনে এর চরম নেতিবাচক প্রভাব পড়বেই। এটি জাতীয় অর্থনীতির জন্যও মারাত্মক হুমকি। অর্থপাচারের ঘটনা অব্যাহত থাকলে বিনিয়োগ, কর্মসংস্থান, বেকারত্ব ও দারিদ্র্যের হার দ্রুত হ্রাসকরণসহ নানা ক্ষেত্রে হতাশা দেখা দেবে। সংগতকারণে এ বিষয়ে নির্লিপ্ত থাকার সুযোগ নেই। ব্যবসায়ী, রাজনীতিক, আমলা যারাই অর্থ পাচারের সঙ্গে যুক্ত থাকুন না কেন, তারা দেশের অনিষ্টকারী। তাদের প্রতি সদয় হওয়ার কোনো কারণ নেই। যারা ভুয়া এলসি করে আমদানীর নামে বা অন্য কৌশলে অর্থপাচার করছে তাদের বিরুদ্ধে সরকারের কঠোর অবস্থানই কাম্য। এর সাথে যারা যুক্ত তাদের শনাক্ত করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির আওতায় আনা দরকার। একইসঙ্গে পাচার হওয়া অর্থ ফিরিয়ে আনতেও চাই সরকারের আইনানুগ, কার্যকর পদক্ষেপ। দেশের ব্যাংকগুলোর উন্নয়ন ও দেশে বিনিয়োগের অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টিতেও নিতে হবে যথাযথ পদক্ষেপ, যাতে ব্যবসায়ী-শিল্পপতিদের পুঁজি নিয়ে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হতে না হয়। আমাদের বিশ^াস দেশের অর্থনীতির স্বার্থেই অর্থপাচার রোধে কার্যকর পদক্ষেপ নেবে সরকার।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট