চট্টগ্রাম সোমবার, ০৬ মে, ২০২৪

সর্বশেষ:

ভারতের সংশোধিত নাগরিক আইন এবং বাংলাদেশ

নাওজিশ মাহমুদ

২২ ডিসেম্বর, ২০১৯ | ৪:৪৩ পূর্বাহ্ণ

ভারতে নাগরিক আইন সংশোধন করে নতুন আইন পাশ করেছে। এটি ভারতের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার। এখানে আমাদের আপত্তি থাকার কথা নয়। সেখানে মুসলিম ছাড়া পাকিস্তান, আফগানিস্তান এবং বাংলাদেশের অমুসলিমদের ভারতে সহজে নাগরিকত্ব দেয়ার ব্যাপারে শর্ত শিথিল করেছে। এই নিয়ে আমাদের উচ্চবাচ্য করার কোন কারণ না থাকলেও একটি বিষয়ে আমার উৎকন্ঠা বা উদ্বিগ্ন না হয়ে পারিনা। সেটা হলো আমাদেরকে পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের সাথে একই কাতারে ফেলে দিয়েছে। বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে জন্ম নেয়া একটি জাতিসত্ত্বার ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্রকে ধর্মীয় রাষ্ট্র হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। যেখানে সংখ্যালঘুরা দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক। পাকিস্তানে এবং আফগানিস্তানে ধরতে গেলে সংখ্যালঘু বিশেষ করে হিন্দু ধর্মাবলম¦ী একেবারে সামান্য। বাংলাদেশে মোট জনসংখ্যার ১০ শতাংশ সংখ্যলঘু। অর্থাৎ এই বিলের প্রধান লক্ষ্য হচ্ছে বাংলাদেশ, আসাম ত্রিপুরা এবং পশ্চিম বাংলার বাংলাভাষী। আসামের নাগরিক তালিকা করে প্রথমে ১৯ লক্ষ নাগরিককে বাদ দিয়েছে। তার মধ্যে ১২ লক্ষ ছিল হিন্দু ধর্মাবলম¦ী। ১২ লক্ষ এই হিন্দু ধর্মাবলম্বীকে সংশোধিত নাগরিক আইনের মাধ্যমে ৫ বছর অবস্থানের ভিত্তিতে প্রায় সকলকে নাগরিকত্ব প্রদানের সুযোগ করে দেয়া হয়েছে। কিন্তু মুসলিমরা এই সুযোগ পাবেনা। অর্থাৎ ভারত ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র থেকে এখন মুসলিমবিরোধী রাষ্ট্রে পরিণত হতে চলেছে। বাংলাদেশ এখন ভারতের এই মনোভাবের প্রতিবাদ করার নৈতিক ভিত্তি হারিয়ে ফেলেছে। বাংলাদেশের রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম এই কারণে। আর আইন সংসদে পেশ করার সময় সংখ্যালঘুদের নির্যাতনের যে চিত্র তুলে ধরেছে, তা বাংলাদেশের প্রতি ভারতে মনোভাবের একটি চিত্র পাওয়া যায়।

বাংলাদেশে সম্পত্তির জন্য শুধু সংখ্যালঘু নয়, সংখ্যাগুরুরাও নির্যাতনের শিকার হয়। সংখ্যাগুরুরা মনস্তাত্বিকভাবে এই ইস্যুটিকে ভিন্নভাবে মোকাবিলা করে। সংখ্যালঘুরা মানসিক দুর্বলতার কারণে এটাকে সংখ্যাগুরুর আচরণ হিসেব মনে করে। সংখ্যালঘুদের সম্পত্তি আত্মসাৎ করা অনেক বেশী সহজ। কারণ ওরাও মানসিকভাবে দুর্বল। সংখ্যালঘু কোন ধনী ব্যাক্তির সম্পদ এইভাবে আত্মসাতের ঘটনা তুলনামূলকভাবে অনেক কম। বরঞ্চ খাতুনগঞ্জ থেকে অনেক সংখ্যালঘু টাকা মেরে ভারতে পাড়ি দেয়ার অভিযোগ আছে। এই আইনের লক্ষ্য শুধু বাংলাদেশ নয়। এর লক্ষ্য হলো ভারতে বাঙালি জাতিকে তছনছ করে দেয়া, বিভক্তি আনা এবং ভবিষ্যতে গুজরাটি প্রাধান্য পুঁজির অবস্থানকে সংহত করা। ছলে বলে কৌশলে পশ্চিম বঙ্গে বিজেপিকে ক্ষমতায় আনা। গুজরাটি পুঁজির বিরুদ্ধে যদি কার্যকর কোন ভূমিকা রাখতে পারে এই বাঙালি পারবে। কারণ জ্ঞান-বিজ্ঞান সাহিত্য-সংস্কৃতিতে বাঙালি এখনও সেরা। ত্রিপুরায় বাঙালি সংখ্যগরিষ্ঠ, আসামে এখন প্রায় সংখ্যগরিষ্ঠ। পশ্চিম বাংলায় বাঙালি অধ্যুষিত কিন্তু বিজেপি এখনও ক্ষমতায় যেতে পারে নি। হিন্দুত্ববাদী রাজনীতি প্রসারের জন্য বাঙালি একটি বড় বাধা। কারণ বাঙালির বিরাট অংশ মুসলিম। এই হিন্দুত্ববাদী রাজনীতি জন্য এটা একটি নীলকন্ঠ। এদেরেকে গিলতেও পারছে না। আবার উগড়ে দিতেও পারছে না। আইনের মাধ্যমে তাঁদেরকে আতঙ্কের মধ্য দিয়ে রাখলে তাদের আত্মবিশ^াসে ঘাটতি থাকবে, তেমনি মানসিকভাবে পিছিয়ে থাকবে। মুসলিমদের ভারতে দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক বানিয়ে ভারতের বাঙালির মধ্যে যদি দ্বিধাবিভক্ত আনা যায়, সেই সাথে বাাংলাদেশকে যদি শুধু মুসলিম রাষ্ট্র বানানো যায় তা হলে ভারতের কেন্দ্রীয় হিন্দু নেতৃত্বের বিরোধীরা দুর্বল হয়ে পড়বে। তেমনি সমস্ত বাঙালি এক হয়ে নতুন কোন রাষ্ট্রের চিন্তাভাবনাও করতে অপারগ হবে। এর সাথে যোগ হয়েছে বিশ^ব্যাপী বাঙালির উত্থান। শুধু ভারতে নয়। সারা পৃথিবীতে উল্লেøখযোগ্য জনগোষ্ঠী হিসেবে বাঙালির অবস্থান দিন দিন সুদৃঢ় হয়ে উঠছে। বাংলাদেশ এর প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে কৌশলে। বাংলাদেশের পরাষ্ট্রমন্ত্রী এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ভারত সফর বাতিল করেছে। এটাকে নিরব প্রতিবাদ এবং অভিমানের ভাষা বলা যায়। বাংলাদেশকে বর্তমানে প্রতিবেশীর সাথে সংযত আচরণ করতে হবে, যাতে সম্পর্ক তিক্ততার দিকে না গড়ায়। ভাষা হতে হবে কৌশলি। বাংলাদেশকে কৌশলে এই পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে হবে। হিন্দু-মুসলিম-খৃষ্টান-বৌদ্ধ ধর্মের ভিত্তিতে যাতে বাংলাদেশ বিভক্ত না হয় সেজন্য প্রশাসনকে যেমন কঠোর হতে হবে, সেই সাথে কৌশলী হতে হবে। জনগণকে ধর্মীয় সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি কোন অবস্থাতেই যেন নষ্ট না হয়, সে ব্যাপারে সজাগ থাকতে হবে।

এই উপমহাদেশে বাংলাদেশ সবচেয়ে আধুনিক দেশ। নেপালে কমুনিস্ট পার্টিও ক্ষমতায় আসায় নেপাল ভারতের বদলে চিনের প্রতি ঝুঁকে পড়েছে। ভুটানও চিন-ভারতের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করে চলেছে। শ্রীলংকায় চিনের প্রতি বন্ধুভাবাপন্ন রাজনৈতিক শক্তি ক্ষমতায় এসেছে। বাংলাদেশ এখনও ভারতে প্রতি বন্ধুভাবাপন্ন। বিশেষ করে বর্তমানে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত সরকার ভারতের প্রতি অনেকবেশী বন্ধুসুলভ। কিন্তু জনগণ যদি ভারতের প্রতি বিরূপ হয়ে পড়ে, তা হলে ভারত ও বাংলাদেশের সম্পর্ক নতুন করে বিন্যাস করতে হবে। জনগণ সরকার পরিবর্তন করবে, না সরকার জনগণের আকাক্সক্ষার প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে ভারতের মনোভাবের প্রতিবাদ করবে তার উপর নির্ভর করবে এই অঞ্চলের রাজনীতির গতি-প্রকৃতি। ভারতের সাথে আমাদের যে ঐতিহাসিক সম্পর্ক আছে, তার সম্পর্ক বন্ধুত্বের সম্পর্ক। এই সম্পর্ক শত্রুতায় বা দাসত্বে যেন চলে না যায়। বাংলাদেশের রাজনীতিবিদদের সতর্ক এবং সংযত হতে হবে যাতে আমাদের অভ্যন্তরীণ সংহতি অটুট থাকে। ধমের্র ভিত্তিতে যাতে বাংলাদেশের বাঙালিদের মধ্যে কোন ভুল বুঝাবুঝি না হয়। সেই সাথে সংখ্যালঘু জাতিসমূহের প্রতিও আমাদের সহনুভূতি ও উদারতা দেখাতে হবে। বিশেষ করে বাংলাদেশের আশে পাশে ভারতের যে সপ্তকন্যা নামে রাজ্যসসমূহ আছে তাদের আস্থার জায়গাটা আমাদেরকে তৈরী করতে হবে। তাঁদের অর্থনীতি, রাজনীতি এবং সংস্কৃতি বিকাশে বাংলাদেশকে অগ্রগণ্য ভূমিকা রাখতে হবে। আমাদের খেয়াল রাখতে হবে বাংলাদেশ রাষ্ট্র এবং বাঙালি জাতি এই দুটোর মধ্যে যেন পার্থক্য সঠিকভাবে নির্ধারণ করতে পারি। তা হলে বাংলাদেশকে কেন্দ্র করে এই পুর্বাঞ্চলে একটি নতুন প্রত্যাশার জায়গা তৈরী হবে।

এর সাথে আরেকটি অপপ্রচার বাংলাদেশের বিরুদ্ধে করা হয়, সেটা হলো ১৯৭১ সালে এই দেশে হিন্দু ধর্মাবলম¦ীর সংখ্যা ছিল ২০%। বর্তমানে ১০% এই পরিসংখ্যানটি ব্যবহার করা হয়। অর্থাৎ ১০% হিন্দু ভারতে স্থানান্তর হয়েছে। প্রকৃত সত্য হলো, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে জনসংখ্যা ছিল ৭ কোটি। এর ২০% হিসেবে হিন্দুধর্মাবলম¦ীর সংখ্যা দাঁড়ায় ১কোটি ৪০ লক্ষ। বর্তমানের বাংলাদেশের জনসংখ্যা ১৬ কোটি। এর ১০% হিসেবে হিন্দু ধর্মাবলম¦ীর সংখ্যা দাঁড়ায় ১ কোটি ৬০ লক্ষ। সে হিসেবে ২০ লক্ষ লোক বেড়ে গিয়েছে। প্রজনন বৃদ্ধির দিক থেকে মুসলিমদের যে হারে বাড়ে হিন্দুদের সে হারে না বেড়ে বরং কমে যায়। কারণ মুসলিমদের ৩ থেকে ১০ জন পর্যন্ত সন্তান জন্ম দেয়। অপরদিকে হিন্দুদের অধিকাংশ ১ জন বা ২ জন সন্তান জন্ম দেন। তাহলে যেভাবে অপপ্রচার করা হয় সেভাবে হিন্দু স্থানান্তরের পরিসংখ্যান মোটেও বাস্তবসম্মত নয়। কলকাতা বাঙালিদের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক রাজধানী থাকায় সারা বাংলা অঞ্চল থেকে কলকাতামুখী স্রোত স্বাভাবিক গতিতে বিরাজমান ছিল। এর কারণ ছিল অর্থনৈতিক। ১৯৪৭ সালে ভারত বিভক্তির পর মুসলমানদের কলকাতা অভিমুখি স্রোত বন্ধ হলেও হিন্দুদের অব্যাহত থাকে। যে হারে অপপ্রচার হচ্ছে তার তুলনায় অনেক কম। ১৯৭১ সালে অনেক হিন্দু ভারতে গেলেও সবাই ফেরত আসে নি। যাদেরকে অন্ধ্রপ্রদেশ উত্তরপ্রদেশ এবং কর্ণাটকে পুনর্বাসন করা হয়েছিল। কিন্তু ১৯৭১ সালের পর সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ভারতে স্থানান্তর ধরতে গেলে যৎ সামান্য। এরকম করাচী শহরে প্রায় ১৫ লক্ষ বাঙালি বাস করে। ৭১ এর পরেও অনেকে স্থানান্তরিত হয়েছে। এই স্থানান্তরের পুরাটায় কর্মসংস্থানের কারণে। বাঙালি কর্মসংস্থানের কারণে সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ছে। সুতরাং কলকাতাও কর্মসংস্থানের একটি গন্তব্য স্থান। ১৯৭১ সালের পূর্বে একই পরিবারে কোন সন্তান ভারতে অভিবাসী হলে তাঁর সূত্র ধরে পরে গোটা পরিবার স্থানান্তর যেমন হয়েছে তেমনি অনেককে ফেরতও আসতে হয়েছে। কর্মসংস্থানের সুযোগ ভারতের চেয়ে বাংলাদেশে অনেক বেশী। তাইতো ভারতের ৫ লক্ষাধিক নাগরিক বাংলাদেশে চাকরি করছে। বছরে পাঁচ হাজার কোটি টাকারও বেশী ভারতে রেমিটেন্স আকারে যাচ্ছে। তাই মনে হচ্ছে বাংলাদেশে সংখ্যালঘু নির্যাতনের কথা বলে বাংলাদেশকে চাপে ফেলার কৌশল নেয়া হচ্ছে। সেই সাথে সংশোধিত আইন পাশের মাধ্যমে এ দেশের সংখ্যালঘুদের স্থানান্তরে যদি প্রলুব্ধ করতে চায় তাহলে তা হবে বিজেপির ভোটব্যাংক বৃদ্ধি করার কৌশল। এর মাধ্যমে ভোটের মেরুকরণে ১৯৭১ সালের পূর্বে যারা পূর্বপাকিস্তান ছেড়ে ভারতে গমন করেছে তাদের সমর্থন পাওয়ার জন্যে এই আইন। যাতে

পশ্চিম বঙ্গে হিন্দু-মুসলিম বিভক্তি এনে সকল হিন্দুকে পক্ষে এনে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিল করতে পারে।

তবে ভারতে নাগরিক সংশোধনী আইনের পরে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে রাজনৈতিক অর্থনৈতিক এবং সংস্কৃতি ক্ষেত্রে নতুন পুনর্বিন্যাস ঘটবে। যার কিছু পূর্বাভাস দেখা যাচ্ছে সংশোধিত আইনের প্রতিবাদে মিছিল অবরোধ ও আন্দোলনের মধ্য দিয়ে। যা এখনো স্বাভাবিক হয়নি। এই আন্দোলন সরকারের বিরুদ্ধে থাকলেও জাতিগত দ্বন্দ্ব এবং ধর্মীয় দ্বন্দ্বের স্বরূপ এখনো স্পষ্ট নয়। এই দ্বন্দ্বের মাধ্যমে হিন্দু-মুসলিম এক হয়ে বাঙিালি জাতিসত্তার ভিত্তিতে লড়াই করে নাকি সমস্ত হিন্দু এক হয়ে মুসলমানবিরোধী অবস্থান নেয়, এর উপর এই অঞ্চলের ভবিষ্যৎ নির্ভর করবে। এটার জন্য বাংলাদেশকে অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক পরিস্থতি আরো উন্নয়ন ঘটাতে হবে যাতে এই সপ্তকন্যা এবং পশ্চিম বাংলা বাংলার কাছে মডেল হিসেবে বাংলাদেশ দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারে। এই অঞ্চলে সকল কর্মকা-ের কেন্দ্রবিন্দু যাতে বাংলাদেশকে ঘিরে আবর্তিত হয়, সে ব্যাপারে সুদূরপ্রসারি চিন্তা-ভাবনা ও কর্মকা- পরিচালনা করতে হবে। বাংলাদেশের দূরদর্শিতার উপর নির্ভর করবে ভারতে সংশোধিত নাগরিক আইনে পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের সাথে বাংলাদেশকে একই কাতারে ফেলে পরিমাপ করা ভারতের সিদ্ধান্ত ভুল ছিল।

নাওজিশ মাহমুদ রাজনীতি বিশ্লেষক ও কলামিস্ট।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট