চট্টগ্রাম সোমবার, ০৬ মে, ২০২৪

সর্বশেষ:

অর্থপাচার রোধে করণীয়

চিকিৎসা শ্রমিকের দিনলিপি

ডা. হাসান শহীদুল আলম

২১ ডিসেম্বর, ২০১৯ | ৪:১২ পূর্বাহ্ণ

অগ্রহায়ণের তৃতীয় সপ্তাহ। ১৪২৬ বঙ্গাব্দ। কুয়াশার চাদরে ঢাকা পটিয়া আদালত পুকুরের পাড় ধরে প্রতিদিনের ঘণ্টা দেড়েকের প্রাতঃকালীন হাঁটা সমাপ্তি করে লেখার টেবিলে বসেছি। ভোর ৭-০০টা প্রায়।

নি¤েœর সংবাদচিত্রসমূহের প্রতি সম্মানিত পাঠকবৃন্দের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি : ১) ‘বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহীম খালেদ বলেন, সুইসব্যাংকে এ টাকা পাচার দীর্ঘমেয়াদী প্রক্রিয়ারই অংশ। আগেও পাচার হয়েছে। কিন্তু এ সবের বিরুদ্ধে জোরালো কোন ভূমিকা আমরা দেখিনি (খোলাকাগজ, ২৮-৬-১৯)’। ২) ‘অন্তত পাঁচ লাখ বাংলাদেশী মালয়েশিয়ায় সেকে- হোম প্রকল্পের সুযোগ গ্রহণ করেছে। কানাডায় বিপুল সংখ্যক বাংলাদেশী বসবাস করে এমন একটি এলাকার নামকরণ হয়েছে বেগমপাড়া। যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে বাংলাদেশীদের এমনই একটি সেকে- হোম গড়ে উঠেছে, যার নাম সচিবপাড়া। থাইল্যা-, হংকং, সিঙ্গাপুর প্রভৃতি দেশেও অনেক বাংলাদেশী ব্যবসায়ীর অফিস রয়েছে। সেখানে তারা পুঁজি পাচার করে নিয়মিত ব্যবসা করছেন বলে তথ্য পাওয়া গিয়েছে। সিঙ্গাপুর, সৌদি আরবেও এদেশের প্রভাবশালী ব্যবসায়ীরা কিনেছেন দামী এ্যাপার্টমেন্ট। অনুসন্ধান করে দেখা যায়, শুধু ব্যবসায়ীরা নয়, টাকা পাচার থেকে পিছিয়ে নেই রাজনীতিক আমলারাও। মক্কার জমজম টাওয়ারে যেখানে একটি এ্যাপার্টমেন্টের দামই এক কোটি ডলার, সেখানে বাংলাদেশীদের একাধিক ফ্ল্যাট রয়েছে (সিসি নিউজ, ২২-৮-১৪)।’ ৩) যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন ভিত্তিক জিএফআই কর্তৃক ২০১৫ সালের প্রকাশিত রিপোর্ট অনুযায়ী ২০০৪ সাল থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত এই দশ বছরে বাংলাদেশ থেকে ৪১৯১০০ কোটি টাকা পাচার হয়েছে। শুধুমাত্র ২০১৩ সালে পাচার হয়েছে ৭২৫২৫ (বাহাত্তর হাজার পাঁচশত পঁচিশ) কোটি টাকা (ছাত্র সংবাদ, মার্চ, ১৬)।

উল্লিখিত সংবাদচিত্রসমূহের পর্যালোচনায় দেখা যাচ্ছে, ২০০৪ সাল থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত ৪১৯১০০ কোটি টাকা এবং ২০১৪ সাল থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত এই পাঁচ বছরে প্রতি বছর ৭২৫২৫ কোটি টাকা হিসেবে মোট ৩৬২৬২৫ কোটি টাকা, অর্থাৎ ২০০৪ সাল থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত মোট (৪১৯১০০+৩৬২৬২৫) বা ৭৮১৭২৫ কোটি টাকা বাংলাদেশ থেকে পাচার হয়েছে। এই টাকা যদি পাচার না হয়ে দেশে থাকতো এবং বিনিয়োজিত হতো তবে ২২টি পদ্মা সেতু তৈরী করা যেতো অথবা বড় আকারের কমপক্ষে ৩০০০টি শিল্পকারখানা প্রতিষ্ঠা করা যেতো। প্রতিটি শিল্পকারখানায় গড়ে ২০০জন মানুষের কর্মসংস্থান হলে ৩০০০ শিল্পকারখানায় মোট ৬০০০০০ জনের কর্মসংস্থান হতো। ফলে দেশে বেকারত্ব কমতো। ঐ ৩০০০টি কারখানায় যদি ১০০০টি পণ্য উৎপাদিত হতো তবে ঐ ১০০০টি পণ্য বিদেশ থেকে আমদানী করতে হতো না। ফলে ঐ ১০০০টি পণ্য আমদানীতে কোন অর্থ ব্যয় হতো না। ফলে দেশ অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ হতো এবং আমাদের জিডিপি বাড়তো। বাংলাদেশ ধাপে ধাপে উন্নতির দিতে এগিয়ে যেতো। আমরা আমদানীপ্রধান না হয়ে রফতানীপ্রধান উন্নত শিল্প সমৃদ্ধ দেশে পরিণত হতাম। বেকারত্বের অভিশাপ থেকে মুক্তি পেতে দেশের লাখো মানুষকে রুজি রোজগারের জন্য বিদেশে যেতে হতো না। বরং দেশেই কর্মসংস্থান হতো। অপরদিকে ঐ সব অর্থ পাচার না হলে উন্নত দেশে এতো শিল্পকারখানা প্রতিষ্ঠিত হতো না। ঐ সব দেশের রফতানী আয় কমতো।
আমাদের সাথে তাদের ব্যবধান কমতো। ফলে তারা আমাদের উপর এতো খবরদারী করতে পারতো না। এই যে প্রতি বছর বিপুল পরিমাণ অর্থ পাচার হয়ে চলে যাচ্ছে, তার সাথে কিন্তু সমাজের উঁচু স্তরের ব্যক্তিরাই জড়িত। দেশের গরীব দুঃখী মানুষ কখনও বিদেশে টাকা পাচার করে না। বড় বড় ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিদের একটি অংশ ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে সেই ঋণের একটি অংশ উন্নত দেশে পাচার করছে। সেখানে বাড়ী-গাড়ী সম্পত্তি কিনছে ব্যবসা-বাণিজ্য গড়ে তুলছে। ফলে আমাদের অর্থে বিদেশে উন্নত হচ্ছে আর দেশ দিন দিন ফতুর হচ্ছে।
আজকের লেখায় অর্থ পাচার রোধে সরকারের করণীয় সম্পর্কে আলোচনা করছি।
অর্থপাচার রোধে সরকারের করণীয় সমূহ:
ক) অর্থপাচার রোধে নীতিমালা প্রণয়ন করতে হবে : ১) অর্থপাচার রোধে এনবিআর-এর ভূমিকা আরও কার্যকর করতে মানি লন্ডারিং আইনের সংশোধন করতে হবে এবং দুদকসহ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সমঝোতা চুক্তি ও এর কার্যকারীতা নিয়ে আইনের সীমাবদ্ধতা দূর করতে হবে। ২) টাকাপাচারকারীদের শাস্তির আওতায় আনতে হবে।
খ) সরকারের রাজনৈতিক সদিচ্ছা থাকতে হবে : ১) বাংলাদেশ ফিনানশিয়াল ইনটেলিজেনস্ ইউনিট বা বিএফআইইউ আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনী, কেন্দ্রীয় ব্যাংক কর্মকর্তা ও গোয়েন্দা সংস্থার দক্ষ সদস্যদের দ্বারা গঠিত ও সমন্বিত হতে হবে ২) বিএফআইইউ যেন দেশীয়, বৈদেশিক, সরকার বা রাজনৈতিক চাপ ছাড়া কাজ করতে পারে সেরূপ ব্যবস্থা থাকতে হবে।
গ) অর্থপাচার রোধে দায়িত্ব প্রাপ্ত সংস্থাগুলোর মধ্যে সমন্বয় থাকতে হবে : ১) অর্থপাচার প্রতিরোধ আইন অনুযায়ী কেন্দ্রীয় ব্যাংক, দুদক, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড এবং সিআইডি পুলিশের দায়িত্ব বণ্টন করে দেয়া হলেও উক্ত সংস্থাগুলোর কার্যক্রমে সমন্বয় থাকতে হবে ২) ফিন্যানশিয়াল একশন টাস্ক ফোর্স প্রদত্ত সুপারিশসমূহ বিবেচনা করতে হবে ৩) বিদেশে কারা অর্থ পাচারের সঙ্গে জড়িত, কোন কোন বিত্তবান সেকে- হোমের মালিক ইত্যাদি বিষয় চিহ্নিত করতে বিদেশের ফিনানশিয়াল ইনটেলিজেনস ইউনিট এর সঙ্গে চুক্তির আওতায় কাজ করতে হবে। ৪) দুদককে অর্থপাচাররোধে আরো কার্যকর ভূমিকা পালন করতে হবে। ৫) আমদানীকারক ও রফতানীকারকদের নজরদারীতে রাখতে হবে ৬) সীমান্ত এলাকার ব্যাংকগুলোতে টাকার প্রবাহ কেন বেড়ে যাচ্ছে এবং টাকার উৎস সম্পর্কে যথাযথ মনিটরিং করে হু-ি ব্যবসার গোপন রহস্য উন্মোচন করতে হবে। ৭) সব আমদানীকৃত দ্রব্যাদি যথাযথ স্ক্যানিং করতে হবে। ঘ) সংসদে জবাবদিহিমূলক কার্যক্রমের ধারা প্রতিষ্ঠা করতে হবে এবং দেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার পরিবেশ বজায় রাখতে হবে।
উপসংহার : এ পর্যন্ত যেটুকু আলোচনা হলো তার সারমর্ম হিসেবে উপসংহারে বলতে চাই যে, সরকারকে দেশে বিনিয়োগের উপযুক্ত পরিবেশ তৈরী করতে হবে। সে সঙ্গে অবশ্যই দুর্নীতিমুক্ত সুশাসন প্রতিষ্ঠা করার মাধ্যমে কালো টাকার উৎস বন্ধ করতে হবে এবং অর্থ পাচারের সাথে ক্ষমতার সম্পৃক্ততার বিরুদ্ধে কঠিন অবস্থান গ্রহণ করতে হবে। কথা নয়, কাজেই হবে পরিচয়। অর্থ পাচার সম্পর্কে লেখা আপাতত এখানেই শেষ করছি।

ডা. হাসান শহীদুল আলম চর্মরোগ ও ডায়াবেটিস-এ ¯œাতকোত্তর প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত
চিকিৎসক, চট্টগ্রাম।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট