চট্টগ্রাম সোমবার, ০৬ মে, ২০২৪

সর্বশেষ:

আমার মা

ডা. মোহাম্মদ ওমর ফারুক

২০ ডিসেম্বর, ২০১৯ | ৪:০০ পূর্বাহ্ণ

আজ থেকে ঠিক পাঁচ বছর আগে আমরা হারিয়েছি আমাদের প্রিয় আম্মাজানকে। প্রখর স্মৃতিশক্তির অধিকারিনী আমার মা ছিলেন একটি অনুপম আদর্শ, একটি প্রতিষ্ঠান। বহুগুণে গুণান্বিত এ’ মহিলার সারা জিন্দেগীই কেটেছে দুঃস্থদের সাহায্যার্থে, তাদের সুখে-দুঃখে। জীবনের কঠিন সময়গুলো তাঁকে বিমুখ করতে পারেনি মানবিক কর্মকা- থেকে। আমরা ৮জন আগলে ধরে রাখতাম আমাদের প্রিয় আম্মাজানকে। অতীত জীবনের চাষাবাদ হতো প্রতিনিয়ত, হঠাৎ ২০১৪ সালের ২৩ নভেম্বর এক দুঃসহ যন্ত্রণা শেষে চিরবিদায় নিলেন আমার মা। তখন মনে পড়ে গেল সূরা আল-আন্য়াম এর ২নং আয়াতটি, ‘তিনি তোমাদের মাটি থেকে সৃষ্টি করেছেন, অতঃপর তিনি (প্রত্যেকের জন্যে বাঁচার একটি) মেয়াদ নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন, (তেমনি তাঁদের মৃত্যুর জন্যেও) তাঁর কাছে একটি সুনির্দিষ্ট মেয়াদ রয়েছে, তারপরও তোমরা সন্দেহে লিপ্ত আছো’।

প্রত্যেক মা’ই চান তাঁর সন্তানেরা দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তান হবে, আলোকিত মানুষ হবে, সততা আর জবাবদিহিতার মূর্ত প্রতীক হবে। তেমনি আমার মাও চাইতেন তাঁর সন্তানেরা উচ্চশিক্ষিত হোক, সৎ ও ভালো চরিত্রের মানুষ হোক। মা’র সেই স্বপ্নের ছায়াপথ ধীরে ধীরে দীর্ঘ হলো। সবাই নিজস্ব অবস্থানে দৃঢ় হলেন। ছোটবেলায় দেখতাম আমার বড় ভাই মরহুম আবু তাহের চৌধুরী (যিনি ৯ সেপ্টেম্বর ২০১৬ দুনিয়ার মায়া ছেড়ে চলে গেলেন না ফেরার দেশে) চেয়ারে বসে আছেন আর মেঝ ও সেঝ ভাই টেবিলে বসে বড় ভাইকে পড়া দিচ্ছেন। চেয়ার ছিল মাত্র একটা। অভাবের সংসার, মরহুম আব্বাজান প্রাইমারী স্কুলের সহকারী শিক্ষক। পাশাপাশি কাপড়ের ব্যবসা করতেন ফকিরহাট বাজারে। কঠিন বাস্তবতা আর অদম্য আগ্রহ ভাইদের পড়াশোনাকে বাধাগ্রস্ত করতে পারেনি। আজ মনে পড়ে, কি অমানবিক পরিশ্রম করে আমার মা এ’ সংসারটিকে সাজিয়ে তুলেছিলেন।
ধর্মীয় ভাবাবেগে পরিপূর্ণ একটি পরিবারে আমার মা’র অবস্থান। প্রখ্যাত বুজুর্গানে দ্বীন মাওলানা আমির আলী সাহেবের দ্বিতীয়া কন্যা আমার মা-ভাইবোনদের খুব কাছাকাছি থাকতে পছন্দ করতেন তিনি। কেউ দূরে চলে গেলে চোখের পানি ধরে রাখতে পারতেন না। ব্যবসার খাতিরে বড় ভাই প্রায় সময় বাইরে থাকতেন। আমরা দেখেছি, অবসাদগ্রস্ত ও বিষণœ মনে দিনের পর দিন কাটিয়ে দিয়েছেন মা’ আমার ভাইয়ের ফেরার অপেক্ষায়। সমাজের নি¤œশিক্ষিত, নিরক্ষর মানুষদের জন্যে আমার মরহুম আব্বা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ‘মক্তব’। এতে এলাকার অনেক ছেলেমেয়ে আসত পবিত্র কোরআনের ছবক নেয়ার জন্যে। সেখানেও আব্বাকে উৎসাহ যোগাতেন এই মহীয়সী নারী। হৃদয় জুড়িয়ে যায় মা নামটি বলার সাথে সাথে। কিন্তু নাহ্ আর কোনদিন ডাকতে পারবো না মা শব্দটি। সমস্ত মায়া-মমতা আর ভালবাসা উজাড় করে দিয়ে যে মা আমাদের বুকে ধারণ করেছিলেন, তিনি আর কোনদিন ফিরে আসবেন না। যাঁদের মা বর্তমান, তাঁরা হয়তো মা’ এর মর্যাদা বুঝতে পারবেন না এখনও। পাঁচটি বছর ধরে শোক-গাঁথা লিখে আসছি দিবা-নিশি।

যেন মা’র ভালবাসার দীর্ঘ সড়ক এখনও অনেক দূর। এরি মধ্যে ২০১৬ সালের ৯ সেপ্টেম্বর শাদা ধবধবে আলোয় উদ্ভাসিত আমাদের সবার মুরুব্বী বড় ভাই আবু তাহের চৌধুরী ফাঁকি দিয়ে চলে গেলেন মাটির দেশে। যেখান থেকে সৃষ্টি করা হয়েছে আমাদের মহান রাব্বুল আ’লামীন। এলোমেলো আমাদের মন ও মনন। অসম্ভব অনুরাগ ও ব্যর্থ সমীকরণে বিধে আছে জ্যোতির্ময় চেরাগ।

যোজন যোজন দূরে মিশে যায় অহর্নিশ মুহূর্তগুলো। মাতৃবিয়োগের পর ছায়ার মতন ছিলেন এই মানুষটি। তিনিও চলে গেলেন কষ্টের পাহাড়ে ঠেলে দিয়ে আমাদের। আমরা এখন হাতড়ে বেড়াই উচ্ছ্বাসের বর্ণময় শরীর, বেজোড় সংখ্যায় জুবুথুবু সমগ্র আয়োজন। মাথার উপর থেকে বিশাল আকাশটা সরে গেল, শুধু চাঁদের বিচ্ছুরণ উঁকি দেয় আমাদের। দু’দুজন অতি প্রিয় মানুষকে হারিয়ে আমরা ৭ ভাইবোন নির্বাক, অসহায়। একই ছাদের নীচে আর কোনদিন পুনর্মিলন হবে না, বলা হবে না অব্যক্ত পংক্তিমালা। বাবাকে হারিয়েছি ১৯৯০ সালের ১৫ মার্চ, আমি মেডিকেলের ৩য় বর্ষের ছাত্র তখন, অপরিপক্ক আয়োজনে বেসামাল উচ্ছল সংসার। তবুও বাবার অভাবটা তিলে তিলে লালন করেছি ২৯ বসন্ত। একজন আদর্শ বাবার ছেলে হয়ে আমি গর্বিত। তিন জন প্রিয় মানুষের আবাস একই অঞ্চলে। নানা মরহুম আমির আলি ছাহেব প্রতিষ্ঠিত রাউজান এমদাদুল ইসলাম মাদ্রাসার জমিনে-শুয়ে আছেন চিরদিনের জন্যে, একদিন এমনি ভাবেই চলে যেতে হবে আমাদের সবাইকে। সূরা বাকারার ২৮১ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ্ তায়ালার সেই অমোঘ বাণীটি আজ খুব বেশি মনে পড়ছে-‘সেদিনটিকে ভয় করো, যেদিন তোমাদের সবাইকে আল্লাহর দিকে ফিরিয়ে নেয়া হবে। অতঃপর সেদিন প্রত্যেক মানবসন্তানকে (জীবনভর) কামাই করা পাপ-পূণ্যের পুরোপুরি ফলাফল দিয়ে দেয়া হবে। তাদের (ওপর) (সেদিন) কোন ধরনের জুলুম করা হবে না’।
ব্যর্থতা শুধু কুরে কুরে খাচ্ছে, আম্মার অতি কাছাকাছি থেকেও দু’দন্ড কথা বলার সুবর্ণ সুযোগটা হাতছাড়া করেছিলাম, আমরা ভীষণ স্বার্থপর-সামাজিক, রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন কার্যক্রমে সগর্ব পদচারণা, অথচ প্রিয় মানুষের সাথে মনভরে কথা বলার সময়টুকুর অভাব। আফসোস এ’অভাগাজনের, অঘোষিত রত্নাগর্ভা মা’ কে কাছে পেয়েও কষ্টের নহরে কঠিন দীপ্যমান।
একজন পরহেজগার মা’কে আর কোনদিন ফিরে পাবো না। সূরা আত্-তুর এর ২১ নং আয়াতে মহান আল্লাহ্ তায়ালার সেই ঘোষণাটি যেন চোখের সামনে জ্বল জ্বল করছে- ‘যে সব মানুষ আল্লাহর উপর ঈমান এনেছে এবং তাদের সন্তানরাও এ ঈমানের ব্যাপারে তাদের অনুবর্তন করেছে, আমি (সেদিন জান্নাতে) তাদের সন্তান-সন্ততিদের তাদের (নিজ নিজ পিতা-মাতার) সাথে মিলিয়ে দেবো। আর এ জন্যে আমি তাঁদের (পিতামাতার) পাওনার কিছুই হ্রাস করবো না। (বস্তুত) প্রত্যেক ব্যক্তিই নিজ নিজ কর্মফলের হাতে বন্দী হয়ে আছে’।

বেলা অবেলায় আম্মার অনিন্দ্যসুন্দর মুখখানি যেন ভাসমান। স্বপ্নেও দেখেছিলাম একদিন, চিরাচরিত সেই বাঙালি রমণীর মতন শাদা শাড়ী গায়ে চালাচ্ছেন মোটর গাড়ী। পাশে আমি-কিছুক্ষণ পরই শুনি পবিত্র কোরআন তেলওয়াতের সুমধুর কন্ঠ। আমার জান্নাতবাসিনী মা’ এর সাথে কি দেখা হবে পরপারে? আল্লাহতায়ালার সেই ঘোষণাতেই যেন বর্ণিল হয়ে ওঠে আমার শরীরসমগ্র। আখেরাতের জন্য বিনিয়োগের আশায় ছুটে চলে বিনিদ্র রজনী। অপ্রতিরোধ্য রাজপথের বহুমাত্রিক পদচিহ্ন ছুঁয়ে যায়, ছুঁয়ে যায় বারবার। নাড়িছেঁড়া ধন ছিলাম আমার মা’র। আদর করে ডাকতেন ‘অ-ফারু’- লুকিয়ে হাতের পঞ্চমাংশে গুঁজে দিতেন অকৃত্রিম ললাট। অবিশ্বাসী আঁচল।
আমি মা’র সবচে’ ছোট সন্তান, বায়নার কোন জুড়ি ছিল না, মেঠো পথে রুপোলী সন্ধ্যেয়, ঝিঁ ঝিঁ পোকার শব্দে কোলাহল থেমে যেত, আত্মীয়ের উঠোনে যাওয়া অন্যরকম শিহরণ, আবার ফিরে আসা- যেন স্বপ্নীল চৌহদ্দির ঘেরাটোপ। আমি হারিয়েছি একজন ব্যতিক্রমী মা’কে, যিনি জীবনের পুরোটাই লেপটে দিয়েছেন মহান আল্লাহতায়ালার সান্নিধ্যে, নফল নামায, তাহাজ্জুদ, দান-খয়রাত ছিল যাঁর নেশা।

ভালো কাজগুলোকে অতি প্রিয় করে নিয়েছিলেন তিনি। আমরা এখন তিন জন ছাড়া- মা, বাবা আর বড় ভাই। তাঁদের আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে গড়তে চাই নিজেদের সারাবেলার সংসার। গোছাতে চাই অগোছালো জীবন। ফরিয়াদ-মহান মালিকের কাছে শুধুই। আবারো মনে পড়ে যায় সূরা লোকমান-এর ১৪ নং আয়াতটি- ‘আর আমি মানুষকে তার পিতা-মাতার সাথে সদ্ব্যবহারের জোর নির্দেশ দিয়েছি। তার মাতা তাকে কষ্টের পর কষ্ট করে গর্ভে ধারণ করেছে। তার দুধ ছাড়ানো দু’বছরে হয়। নির্দেশ দিয়েছি যে, আমার প্রতি ও তোমার পিতা-মাতার প্রতি কৃতজ্ঞ হও। অবশেষে আমারই নিকট ফিরে আসতে হবে’।

ডা. মোহাম্মদ ওমর ফারুক সভাপতি, রাউজান ক্লাব, জুনিয়র কনসালটেন্ট (ইএনটি), জেনারেল হাসপাতাল, রাঙ্গামাটি।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট