চট্টগ্রাম বুধবার, ১১ ডিসেম্বর, ২০২৪

সর্বশেষ:

সাকার ফিশের ভয়ংকর আগ্রাসন

মোহাম্মদ আলী

২৪ সেপ্টেম্বর, ২০২৩ | ১১:৫৯ পূর্বাহ্ণ

পুরো গায়ে কাঁটা, মুখ ও পুরো শরীর দেখতে খুবই ভয়ংকর। সহজে জাল ছিঁড়ে ফেলে। কম অক্সিজেন ও দূষিত পানিতে বাঁচতে পারে। পাশাপাশি বংশবিস্তার করতে পারে দ্রুত। এমনকি রোদে রাখলে সহজে মরে না। কোন জেলে কিংবা মৎস্যচাষীকে এমন ক্লু দিলে সহজে উত্তর মিলবে ‘সাকার ফিশ’ এর কথা। বিগত কয়েক বছরে এ মাছটি চট্টগ্রামের নদী, খাল-বিল ও পুকুরসহ প্রাকৃতিক উৎসে ভয়ংকর রূপে বিস্তৃতি ঘটছে।

 

আজ ‘বিশ্ব নদী দিবস’। নদী রক্ষায় সচেতনতা বাড়াতে প্রতিবছর সেপ্টেম্বরের চতুর্থ রবিবার বিশ্বব্যাপী দিবসটি পালিত হয়ে আসছে। বাংলাদেশেও দিবসটি উপলক্ষে নানা কর্মসূচির আয়োজন করেছে জাতীয় নদীরক্ষা কমিটি ও বিভিন্ন পরিবশেবাদী সংগঠন।

 

এদিকে চট্টগ্রামের নদী, খাল-বিল ও পুকুরে জাল ফেললে মিলছে রাক্ষুসি সাকার মাছ। যে মাছ পেয়ে জেলেদের খুশি হওয়ার কথা, সেখানে তারা হতাশ হয়ে বাড়ি ফিরছেন। কারণ এ মাছ মানুষ খায় না। চট্টগ্রামের হালদা, কর্ণফুলী, সাঙ্গুসহ বিভিন্ন খাল-বিল, পুকুরে আগ্রাসীরূপে সাকার মাছের বংশ বিস্তার ঘটছে। এটি দ্রুত বংশ বিস্তার করে বলে আশপাশে খাল-বিল ও পুকুরে ছড়িয়ে পড়ছে। এ মাছ অন্যান্য দেশীয় মাছের খাবার খেয়ে ফেলে। এ কারণে রুই, কাতলা, মৃগেল, চিতল, বোয়ালসহ অন্য মাছগুলো সাকার মাছের ধারের কাছেও যায় না। বিজ্ঞানীরা জানায়, সাকার ফিশের আসল নাম সাকার মাউথ ক্যাটফিশ। এর বৈজ্ঞানিক নাম হিপোসটোমাস প্লেকাসটোমাস। আশির দশকে একুয়ারিয়ামের  শেওলা ও ময়লা পরিষ্কার করতে এই মাছ বিদেশ থেকে আনা হয়। এই মাছ দক্ষিণ আমেরিকায় ব্যাপকভাবে দেখা যায়। তবে কয়েক বছর ধরে তা ভারত, চীন, মিয়ানমার ও বাংলাদেশের জলাশয়ে দেখা যাচ্ছে। সাকার মাছের পিঠের ওপরে বড় ও ধারালো পাখনা আছে। দুই পাশেও রয়েছে একই রকমের দুটি পাখনা। এর দাঁতও বেশ ধারালো। সাধারণত জলাশয়ের আগাছা, জলজ  পোকামাকড় ও  ছোট মাছ এদের প্রধান খাবার। যেসব পানিতে দূষণের কারণে অক্সিজেনের পরিমাণ প্রায় শূন্যের  কোঠায়  নেমে আসে,  সেখানে অন্য মাছ বাঁচতে পারে না, তবে এই মাছ পারে। পানি ছাড়াও মাছটি ২৪ ঘণ্টা দিব্যি বেঁচে থাকতে পারে।

 

মৎস্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলছেন, সাকার মাছ প্রতিকূল পরিস্থিতিতে বা খারাপ পানিতে ও কম অক্সিজেনেও বাঁচতে পারে। পাশাপাশি এটি দ্রুত প্রজনন ঘটায়। এই মাছ যদি দেশের মানুষ খেত, তাহলে এত বাড়ত না। এভাবে যদি বাড়তে থাকে তাহলে অন্যান্য মাছের সঙ্গে সাকার মাছের জায়গা ও খাবার নিয়ে প্রতিযোগিতা শুরু হবে।

 

এ প্রসঙ্গে চট্টগ্রাম জেলা মৎস্য অফিসার শ্রীবাস চন্দ্র চন্দ দৈনিক পূর্বকোণকে বলেন, ‘দ্রুত বংশবিস্তারকারী সাকার মাছটি জলাশয়ের তলদেশের ময়লা-আবর্জনা পাশাপাশি দেশীয় প্রজাতির মাছের ডিম ও রেণু খেয়ে মাছের বংশবিস্তারে বাধা সৃষ্টি করে। এ মাছটি জলজ জীববৈচিত্র্যের জন্য মারাত্মক হুমকি। যে কোন পরিবেশে এরা বাঁচতে পারে এবং দেশীয় প্রজাতির মাছের সঙ্গে খাদ্য ও বাসস্থান নিয়ে প্রতিযোগিতা করার কারণে দেশীয় মাছগুলো সাকার মাছের সাথে পেরে উঠে না। বিষয়টির গুরুত্ব বিবেচনায় নিয়ে এই ক্ষতিকর জাতের মাছটি নিষিদ্ধ করে ইতিমধ্যে প্রজ্ঞাপন জারি করেছে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়। প্রজ্ঞাপন জারি হওয়ায় কোন ব্যক্তি এখন থেকে আর মাছটি আমদানি, চাষ, একুরিয়ামে পালন, প্রজনন, পরিবহন, বিক্রি, সংরক্ষণ, প্রদর্শন বা এর মালিক হতে পারবেন না।’

 

শ্রীবাস চন্দ্র চন্দ বলেন, ‘মৎস্য অধিদপ্তর থেকে মানুষকে সচেতন করার জন্য হাজার হাজার লিফলেট বিতরণ করা হচ্ছে। চাষ করা বা উন্মুক্ত জলাশয়ে এ মাছ পাওয়া গেলে তা জলাশয়ে ছেড়ে না দিয়ে মাটিতে পুঁতে ধ্বংস করার জন্য পরামর্শ দেয়া হচ্ছে। এ বিষয়ে জেলা, উপজেলাসহ সংশ্লিষ্ট সকল কার্যালয়গুলোতে লিফলেট, পোস্টার বিতরণ অব্যাহত আছে। মৎস্য অধিদপ্তরের পাশাপাশি বিভিন্ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান এ বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারে।’

 

নদী বিশেষজ্ঞ প্রফেসর ড. মো. মনজুরুল কিবরীয়া দৈনিক পূর্বকোণকে বলেন, ‘নদী, খাল-বিলসহ প্রাকৃতিক উৎসে বর্তমানে যে হারে সাকার মাছের আগ্রাসন বাড়ছে, সেটা প্রতিরোধের ব্যবস্থা না নিলে ভয়ংকর রূপ নিতে পারে। এ মাছ নিয়ে মৎস্য অধিদপ্তরের শুধু নিষেধাজ্ঞা নয়, মাঠ পর্যায়ে কার্যকর ভূমিকা পালন করতে হবে।’

 

পূর্বকোণ/আরডি

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট