চট্টগ্রাম শুক্রবার, ০৩ মে, ২০২৪

সর্বশেষ:

দোছড়িতে ‘শেকড়’ জঙ্গি শামীমের

নাজিম মুহাম্মদ, নাইক্ষ্যংছড়ি

২৪ অক্টোবর, ২০২২ | ১১:২৫ পূর্বাহ্ণ

ফের আলোচনায় জামায়াতুল মুজাহিদিন বাংলাদেশের (জেএমবি) নেতা শামীম মাহফুজ। তবে এবার জেএমবি নয়। নতুন পরিচয়ে সামনে এসেছেন তিনি। পার্বত্য অঞ্চলে কেএনএফ নামে সশস্ত্র সন্ত্রাসী সংগঠনের ছত্রছায়ায় ‘জামায়াতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া’ নামে জঙ্গি গ্রুপের সদস্যদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে শামীম মাহফুজের বিরুদ্ধে।

সূত্র বলছে- নতুন জঙ্গি গ্রুপটির প্রধান উপদেষ্টা ও প্রশিক্ষণের সার্বিক তত্ত্বাবধায়কের দায়িত্বে রয়েছেন শামীম। ‘জামায়াতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া’ সদস্যদের ২০২৩ সাল পর্যন্ত প্রশিক্ষণ দেওয়ার জন্য কেএনএফের সাথে চুক্তিও রয়েছে। বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ির দুর্গম দোছড়ির জারুয়ালছড়িতে খামার বাড়িও করেছেন তিনি। এখন সেখানেই শেকড় শামীমের।

 

জঙ্গি সম্পৃক্ততার অভিযোগে গত ৯ অক্টোবর রাজধানীর যাত্রাবাড়ী এলাকা থেকে শাহ মো. হাবিবুল্লাহ নামের একজনসহ মোট চারজনকে গ্রেপ্তার করে র‌্যাব। এরপর নাইক্ষ্যংছড়ির দোছড়ির একটি এবতেদায়ী মাদ্রাসায় হাবিবুল্লার যাতায়াত ছিল বলে র‌্যাবের পক্ষ থেকে জানানো হয়। সামান্তবর্তী দুর্গম দোছড়িতে হাবিবুল্লার যাতায়াতের বিষয়টি সরেজমিন খোঁজ নিতে গিয়ে শামীম মাহফুজের খামার বাড়ির তথ্য পাওয়া গেছে।

 

পূর্বকোণের অনুসন্ধানে জানা গেছে- দোছড়ির দুর্গম এলাকা জারুয়ালছড়িতে তিন বছর আগে পাহাড়ি জমি কেনেন শামীম। এসব জমিতেই খামার বাড়ি গড়ে তুলেন তিনি। স্থানীয়দের কাছে নিজেকে ঢাকার বাসিন্দা হিসেবে পরিচয় দেন শামীম। দোছড়ির লোকজন তাকে ‘ঢাকাইয়া শামীম’ হিসাবেই চেনেন। তবে কিছুদিন ধরে শামীমকে দেখা যাচ্ছে না। সর্বশেষ কয়েক মাস আগে ৬/৭ জন উপজাতিসহ শামীমকে সেখানে দেখা যায়।

 

দোছড়ির ইউপি চেয়ারম্যান মোহাম্মদ ইমরান পূর্বকোণকে জানান, দোছড়ির তুলাতলি এলাকার জনৈক সৈয়দ নুর একটি মামলায় প্রায় ১২ বছর চট্টগ্রাম ও বান্দরবান কারাগারে বন্দী ছিলেন। বান্দরবান কারাগারে বন্দী থাকা অবস্থায় শামীমের সাথে নুরের পরিচয় হয়। জামিনে বের হওয়ার পর সৈয়দ নুরের সাথেই শামীম মাহফুজ নাইক্ষ্যংছড়িতে আসেন। নাইক্ষ্যংছড়ির দুর্গম দোছড়ির জারুয়ালছড়িতে খামার বাড়ি করেন।

 

তিনি বলেন, শামীম লেবু বাগান করার কথা বলে জারুয়ালছড়ি এলাকার মানুষের কাছ থেকে একরের পর একর পাহাড়ি জমির দখলস্বত্ব কেনেন। তবে তাকে কখনো কোনো লেবু বাগান বা ফলদ বাগান করতে দেখা যায়নি। গত দুই-তিন মাস ধরে তাকে এলাকায় দেখা যাচ্ছে না। কয়েকমাস আগে ৬/৭ জন উপজাতি ছেলেসহ শামীমকে দেখা যায়। তখন তিনি বলেছিলেন, উপজাতি এসব ছেলেরা ধর্মান্তরিত হয়েছে।

 

‘ঢাকাইয়া শামীম’ই জঙ্গি শামীম : ২০১১ সালের ২৭ মার্চ গবেষণা ও কৃষি খামারের আড়ালে নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠনের প্রশিক্ষণকেন্দ্র গড়ে তোলার অভিযোগে গ্রেপ্তার হন শামীম মাহফুজ। তার বিরুদ্ধে বান্দরবানের থানচি থানায় মামলা হয়। ওই মামলায় ২০১৩ সাল পর্যন্ত তিনি চট্টগ্রাম কারাগারে ছিলেন। জামিনে মুক্তি পাওয়ার পর একটি এনজিওতে চাকরি নেন। ২০১৪ সালে ফের আত্মগোপনে চলে যান তিনি।

 

কয়েকদিন পর একটি অপরিচিত নম্বর থেকে তার ভাইকে ফোন করেন শামীম। বলেন, তিনি কিছু টাকা পাঠিয়েছেন। তার স্ত্রীর কাছে যেন টাকাগুলো পৌঁছে দেওয়া হয়। ২০১৪ সালের ৩০ জুন ঢাকার যাত্রাবাড়িতে গোয়েন্দা পুলিশের হাতে ফের গ্রেপ্তার হন শামীম। ২০১৭ সালে জামিনে মুক্তি পান তিনি। জামিনের দিনই ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের ফটক থেকে তিনি ফের নিখোঁজ হন।

 

চার দিন পর তার ভাই মুচলেকা দিয়ে মিন্টো রোডের গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) কার্যালয় থেকে শামীমকে নিয়ে আসেন। ২০১৭ সালের ২০ আগস্ট শামীম মাহফুজ বান্দরবান আদালতে মামলার হাজিরা দিতে যান। আদালত তাকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন। একই বছরের ১৪ ডিসেম্বর হাইকোর্ট থেকে জামিন নেন তিনি। জামিনে বের হয়ে ফের নিরুদ্দেশ হন শামীম।

 

পুলিশের হাতে বারবার গ্রেপ্তার জঙ্গি শামীমই দোছড়িতে খামার বাড়ি করা ‘ঢাকাইয়া শামীম’ কিনা তা নিশ্চিত হতে দোছড়ির ইউপি চেয়ারম্যান মোহাম্মদ ইমরানকে জঙ্গি শামীমের ছবি দেখানো হয়। ছবি দেখে ইমরান নিশ্চিত করেন, ছবির লোকটিই খামার বাড়ির মালিক শামীম। তার সাথে বেশ কয়েকবার দেখা হয়েছে। দুই-তিনবার তাকে বাজারে নাস্তাও করিয়েছি।

 

পার্বত্য এলাকায় জঙ্গি ও সন্ত্রাসবিরোধী অভিযান পরিচালনা করা এলিট ফোর্স র‌্যাবের জনসংযোগ বিভাগের পরিচালক খন্দকার আল মঈন পূর্বকোণকে জানান, শামীম মাহফুজ নতুন জঙ্গি সংগঠনের প্রধান উপদেষ্টা ও প্রশিক্ষণের সার্বিক তত্ত্বাবধায়কের দায়িত্বে রয়েছেন বলে আমরা তথ্য পেয়েছি। তিনি এর আগে থানচি এবং ঢাকায় গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। তাকে আমরা খুঁজছি।

কে এই শামীম মাহফুজ : শামীম মাহফুজ ওরফে সুমন ওরফে ম্যনরিং মুরং (ছদ্মনাম) জেএমবি নেতা ছিলেন। তিনি গাইবান্ধা জেলার সাঘাটা থানার কচুয়া সরদারপাড়ার বাসিন্দা। ১৯৯২ সালে এসএসসি পরীক্ষায় রাজশাহী বোর্ডে মেধা তালিকায় তিনি পঞ্চম হয়েছিলেন। ১৯৯৪ সালে এইচএসসি পরীক্ষায় মানবিক বিভাগে একই বোর্ড থেকে মেধা তালিকায় সপ্তম স্থান অধিকার করেন তিনি।

 

এরপর ১৯৯৫ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজ বিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হন শামীম। ২০০১ সালে এমএসএস করেন। ২০০৩ সালে প্রভাষক হিসেবে যোগদান করেন উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে। উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরির সময় জড়িয়ে পড়েন জঙ্গি কার্যক্রমে। ছাড়েন চাকরি। পাশাপাশি ছাড়াছাড়ি হয় প্রথম স্ত্রীর সঙ্গেও। মাঝে পিএইচডি করার জন্য সুইডেনে যাওয়ার সুযোগ পান। তবে জঙ্গি তৎপরতার কারণে সে সুযোগ প্রত্যাখান করেন।

উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরির সময় ২০০৫ সালে তিনি ‘আদিবাসী সম্প্রদায় খুমিদের’ উপর পিএইচডি করার কথা বলে থানচির বলিপাড়ায় আস্তানা গড়ে তোলেন। বলিপাড়া বিজিবি ব্যাটালিয়ন সদর দপ্তরের সংরক্ষিত পাহাড়ি জমি ইজারা নিয়ে ভুট্টার চাষ শুরু করেন। সেখানে চাষাবাদের আড়ালে শুরু করেন জঙ্গি প্রশিক্ষণ।

 

পূর্বকোণ/আর

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট