চট্টগ্রাম শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

রেলওয়ের যাত্রীসেবা: নিয়মে আছে, পালনে নেই

আল-আমিন সিকদার

৩০ ডিসেম্বর, ২০২০ | ১:২০ অপরাহ্ণ

ট্রেনে যাত্রীদের সেবা নিশ্চিতে নানা নিয়ম ও উদ্যোগ রয়েছে রেলের। এই যেমন যাত্রীসেবার মান বৃদ্ধিতে প্রতিটি ট্রেনে আছে খাবারের কোচ (ক্যান্টিন) তেমনি মালামাল বহনসহ নানান সমস্যা সমাধানে নিয়োগ দেয়া হয়েছে এটেন্ডেন্ট।

যারা ট্রেনের সামনে দাঁড়ানোর সাথে সাথে যাত্রীদের পৌঁছে দিবেন টিকিটে উল্লেখিত কোচের নির্ধারিত আসনে। মানসম্মত খাবার পরিবেশনের জন্যও কোচ প্রতি দায়িত্বপালন করবেন দুইজন। আর প্রতিটি বগির দু’পাশে থাকবে খাবারসহ মূল্য তালিকা। এমনকি ট্রেনের এই খাবার নিয়ে যাত্রীদের কোন অভিযোগ থাকলে তা নোট করতে হাতে রেজিস্ট্রার বই নিয়েও প্রতি কোচ ঘুরে বেড়াবেন একজন। তবে ট্রেনে যারা ভ্রমণ করেছেন তারা হয়ত কোনভাবেই ওপরের উল্লেখিত লাইনগুলোর সাথে একমত হবেন না। কারণ, ট্রেনে ভ্রমণ অভিজ্ঞতায় কোন যাত্রী এখন পর্যন্ত পাননি এ সেবা। যাত্রীদের এমন অভিযোগের সত্যতা মিলেছে সরেজমিন পরিদর্শনেও। তবুও এর সবকিছুই নিয়ম মত চলছে বলে রেলের সাথে বারবার চুক্তিপত্রে স্বাক্ষর করে কাজ হাতিয়ে নিচ্ছেন ঠিকাদাররা। কারণ, ট্রেনে এ সেবা নিশ্চিতে ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানকে দায়িত্ব দিয়েছে বাংলাদেশ রেলওয়ে। রেলের বাণিজ্যিক বিভাগের কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করে কাজ বাগিয়ে নেয়ার পাশাপাশি অনিয়ম চালিয়ে যাচ্ছে ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানগুলো।

রেলের বাণিজ্যিক (পূর্বাঞ্চল) বিভাগের তথ্য মতে, পূর্বাঞ্চলের ১৭টি আন্তঃনগর ট্রেনে ক্যাটারিং সার্ভিস (ক্যান্টিন) দিচ্ছে ১৫টি ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান। এসব প্রতিষ্ঠানগুলো দীর্ঘদিন ধরে যাত্রীদের খাবারের সেবা দিয়ে যাচ্ছে। তবে রেলের সাথে চুক্তিতে যা রয়েছে তা নয়, নিজের লাভ করতে যা প্রয়োজন তাই করছেন ঠিকাদাররা। একই কাজ করছে এটেন্ডেন্ট সরবরাহকারী ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানগুলো।

চুক্তিপত্রের তথ্য

ক্যাটারিং সার্ভিসের ঠিকাদার নেয়া প্রতিষ্ঠানটি সংশ্লিষ্ট ট্রেনে যাত্রীদের সরবরাহ করবেন মানসম্মত খাবার। প্রতিটি কোচে থাকবে খাবারের নাম (স্যান্ডউইচ, বার্গার, পাউরুটি, চিকেন কাটলেট, সবজি কাটলেট ও মিনারেল পানি) ও মূল্য তালিকা। যাত্রীদের প্রদান করা হবে ক্যাশ ম্যামো। যাত্রীসেবায় প্রতি কোচে থাকবেন দু’জন করে সার্ভিস ম্যান। তাদের সাথে থাকবে এয়ার ফ্রেশনার ও টিস্যু। প্রতিটি কোচে থাকবে অগ্নিনির্বাপণ যন্ত্রও। এছাড়া প্রতিটি ট্রেনে এ সার্ভিস নিশ্চিতকরণের মূল দায়িত্বে থাকবেন একজন করে ম্যানেজার। যিনি যাত্রীদের কাছে রেজিস্ট্রার বই নিয়ে জানতে চাইবেন খাবার ও সেবা সম্পর্কে কোন অভিযোগ আছে কি না। অন্যদিকে, যাত্রীদের মালামাল বহনসহ নানান সমস্যা সমাধানে রেলে নিয়োগ দেয়া হয়েছে এটেন্ডেন্ট। জনবল সংকটের মধ্যেও এ সেবা নিশ্চিত করতে ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানও নিয়োগ দিয়েছে রেল। যারা ট্রেনের সামনে দাঁড়ানোর সাথে সাথে যাত্রীদের মালামাল বহনের পাশাপাশি পৌঁছে দিবেন টিকিটে উল্লেখিত কোচের নির্ধারিত আসনে। তবে চুক্তির এ তথ্যের সাথে বাস্তবে কোন মিল নেই।

সরেজমিন পরিদর্শন

বিকাল ৫ টার সোনার বাংলা ট্রেনে ভ্রমণ করার জন্য স্টেশনে ৩টি ব্যাগ নিয়ে ছুটোছুটি করতে দেখা যায় এক ব্যক্তিকে। অবশেষে স্টেশনে থাকা যাত্রীদের সাথে কথা বলে তিনি নিশ্চিত হন তার বগিটি একেবারেই সামনে। ব্যাগগুলো নিয়ে বগির সামনে হাজির হলেও ট্রেনে প্রবেশ করতে বেশ বেগ পোহাতে হয় তাকে। ব্যাগগুলো একটি একটি করে সিটে রেখে আসেন তিনি। অথচ যাত্রীর এ কষ্ট দেখেও এগিয়ে আসেননি ওই বগির দায়িত্বে থাকা এটেন্ডেন্ট। শুধু তাই নয়, ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান হাবিব বাণিজ্য বিতানের মো. জাফর আহমদ নামের ওই এটেন্ডেন্ট এটি তার কাজ নয় বলেও প্রতিবেদককে জানান। এমনকি, একই ট্রেনের মুনমুন নামের একজন নারী যাত্রী তার বাচ্চার নিরাপত্তার কথা জানিয়ে জানালার চারদিকে জীবানুনাশক স্প্রে ছিটিয়ে দেয়ার অনুরোধ করলে তাও রাখেননি ওই এটেন্ডেন্ট। এটেন্ডেন্ট জাফর আহমদ পূর্বকোণকে বলেন, তার কাজ শুধু যাত্রীদের হাতে স্প্রে করা।

এদিকে প্রথম শ্রেণির এই ট্রেনটির প্রতিটি বগিতে যেমন ছিল না খাবারের নাম ও মূল্য তালিকা তেমনি চাঁদপুরগামী মেঘনা এক্সপ্রেসেও। ১৮ বগির এই ট্রেনটিতে ছিল না একজনও এটেন্ডেন্ট। বগি হিসেবে ক্যাটারিং সার্ভিসের বাবুর্চি ও ম্যানেজারসহ ৪০ জন থাকার কথা থাকলেও ট্রেনটিতে ছিলেন মাত্র ১১ জন। যারা যাত্রীসেবা নয়, স্টেশনে ট্রেন পৌঁছালেই ব্যস্ত হয়ে পড়েন বিনা টিকিটের যাত্রীদের খাবারের বগিতে বসাতে। ট্রেনটিতে ক্যাটারিং সার্ভিস প্রদান করছে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান বিল্লাল হোসেন এন্ড ব্রাদার্স। ট্রেনটিতে ওই প্রতিষ্ঠানের ম্যানেজার হিসেবে দায়িত্বরত হাশেম পূর্বকোণকে বলেন, ‘বগিতে দুইজন করে সার্ভিসম্যান থাকার কথা থাকলেও বেচা-বিক্রি কম থাকায় স্টাফও কম।’ চুক্তিপত্রে উল্লেখ থাকা অন্যান্য সেবাও কেনো যাত্রীদের দেয়া হচ্ছে না জানতে চাইলে চুপ করে থাকেন তিনি। এমনকি যাত্রীদের অভিযোগ রেকর্ড করে রাখা রেজিস্ট্রি বইতেও গত চার বছরে নেই একটিও অভিযোগ।

সরকারি এটেন্ডেন্ট

যাত্রীদের সেবা প্রদানে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি ট্রেনে দায়িত্ব পালন করেন রেলের নিয়োগপ্রাপ্ত সরকারি কর্মচারিরাও। তবে এ পদে ২২৪ জনের স্থানে কাজ করছেন মাত্র ১৪২ জন। তবে ট্রেনের তুলনায় এ সংখ্যা ৫ ভাগের একভাগ বলে মন্তব্য করেছেন রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের প্রধান যন্ত্র প্রকৌশলী ফকির মোহম্মদ মহিউদ্দিন। অন্যদিকে, কম সংখ্যার এই কর্মীরাও কাজ না করে হাতিয়ে নিচ্ছে সরকারি অর্থ। গত ৪ মাসে এমন অভিযোগের ভিত্তিতে ৪ জনকে বরখাস্ত করেছে দপ্তরটি।

যাত্রী কল্যাণ সমিতি :

সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক বলেন, ২০১৫ সালে সরেজমিন পরিদর্শনে এসব বিষয়গুলো আমাদের নজরে এসেছিলো। প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরে এ নিয়ে অভিযোগ দেয়ার পর বেশকিছু পরিবর্তন দেখতে পেয়েছিলাম। এখন আবার সেই একই অবস্থা। যাত্রীদের সেবা দেয়ার নাম করে চুক্তির পর রেলের অসাধু কতিপয় কর্মকর্তাকে ম্যানেজ করা হয়। আর এভাবে কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানগুলো। এগুলোর বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ করার পাশাপাশি যাত্রীদের সেবা নিশ্চিত করা দাবি জানান তিনি।

পূর্বকোণ/এএ

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট