চট্টগ্রাম সোমবার, ০৬ মে, ২০২৪

সর্বশেষ:

রমজানে বিশেষ ফজিলতপূর্ণ ইবাদত তারাবির নামাজ

২১ মার্চ, ২০২৩ | ১:৪৯ অপরাহ্ণ

রমজান মাসের বিশেষ ইবাদত সালাতুত তারাবিহ অর্থাৎ তারাবির নামাজ। তারাবি আরবি শব্দ ‘তারবিহাতুন’-এর বহুবচন। এর অর্থ হলো- আরাম বা বিশ্রাম করা। ইসলামি বিধান অনুযায়ী, তারাবির নামাজে প্রতি চার রাকাত পর পর কিছুক্ষণ বসে বিশ্রাম নেওয়ার নিয়ম রয়েছে। তাই এ নামাজকে তারাবির বা প্রশান্তির নামাজ বলা হয়।
রমজানে তারাবির গুরুত্ব অনেক। ইসলামী হুকুম অনুযায়ী এটি সুন্নাতে মোয়াক্কাদাহ। রমজানের চাঁদ দেখা গেলে রোজার এই তারাবির নামাজ আদায় করা সুন্নাত। এমনকি যাঁরা শরিয়তসম্মত কোন গ্রহণযোগ্য ওজরের কারণে রোজা পালনে অক্ষম, তাঁরাও সুযোগ ও সামর্থ্য থাকলে তারাবির নামাজ আদায় করবেন। পুরুষদের জন্য তারাবির নামাজ মসজিদে জামাতের সাথে আদায় কার সুন্নাত। নারীরা বাড়িতে আদায় করবেন। পর্দার সুযোগ থাকলে নারীদের মসজিদে পড়তেও কোন আপত্তি নেই।
৪ রাকাত তারাবি আদায় করে বিশ্রাম বা বিরতির পর ব্যাপক প্রচলিত একটি দোয়া রয়েছে। যা দেশ-বিদেশের প্রায় মসজিদে পড়া হয়। আর তাহলো-
‘সুবহানা জিল মুলকি ওয়াল মালাকুতি, সুবহানা জিল ইয্যাতি ওয়াল আঝমাতি ওয়াল হায়বাতি ওয়াল কুদরাতি ওয়াল কিব্রিয়ায়ি ওয়াল ঝাবারুতি। সুবহানাল মালিকিল হাইয়্যিল্লাজি লা ইয়ানামু ওয়া লা ইয়ামুত আবাদান আবাদ; সুব্বুহুন কুদ্দুসুন রাব্বুনা ওয়া রাব্বুল মালায়িকাতি ওয়ার রূহ।’
পবিত্র রমজানে তারাবির নামাজ আমাদের প্রিয় নবী হযরত মোহাম্মদ (সা) এর সবচেয়ে পছন্দের এবাদত ছিল, তাই এটি উম্মতে মোহাম্মদীর কাছেও পছন্দের। যুগ যুগ ধরে বিশ্ব মুসলিম অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে মাহে রমজানে তারাবির নামাজ আদায় করে আসছেন। মূলত রমজানে রাতের বেলায় এশার ফরজ ও সুন্নাত নামাজের পরে বিতরের আগে তারাবির নামাজ আদায় করতে হয়। তারাবি সাধারণ নফল ও সাধারণ সুন্নাতের চেয়ে অধিকতর মর্যাদাবান। গুরুত্বের দিক থেকে ওয়াজিবের কাছাকাছি। এটি অত্যন্ত ফজিলতপূর্ণ ইবাদত। এর ফজিলত সম্পর্কে রাসুলুল্লাহ (স.) এর অনেক হাদিস রয়েছে।
তাহাজ্জুদের নামাজ সারা বছর পড়া সুন্নাত বা মোস্তাহাব। কমপক্ষে ২ রাকাত। বেশি হলে ১২ রাকাত। আর স্বাভাবিকভাবে নবী (আ) নামাজ আদায় করতেন ৮ রাকাত। নবী (আ) ২, ৪, ৮, ১২ রাকাত ও তাহাজ্জুদের নামাজ পড়েছেন। কিন্তু বেশিরভাগ সময় পড়েছেন ৮ রাকাত। তাই তাহাজ্জুদ আর তারাবি ভিন্ন নামাজ। যদিও দুটিই রাতের নামাজ। তারাবির নামাজ পড়া হয় শুধুমাত্র রমজানে। তাহাজ্জুদের নামাজ পড়া হয় ১২ মাস ।
তারাবির নামাজের মূল সময় এশার পর, বিতরের আগে। কেউ যদি একাকি আগে বিতর পড়ে তারাবি পড়লে কোন সমস্যা নেই। অর্থাৎ বিতরের আগে পরে দু’ভাবেই পড়া যায়। তবে জামাতে পড়লে বিতর পরে পড়তে হবে।
নবী বলেছেন, আল্লাহপাক রমজানে দিনে রোজাকে ফরজ করেছেন, আর আমি তোমাদের জন্য কিয়ামে রমজান অর্থাৎ তারাবিকে সুন্নাহ করে দিলাম। রমজানে তোমরা তা আদায় কর। তারাবির নামাজ রাতের শেষেও পড়া যায়। এশার পর ঘুম যাওয়ার আগে পড়ার সুযোগ নাহলে সাহরীর আগে সেরে নেবেন।
মহানবী (সা.) এক বছর তারাবির নামাজ পড়েছেন। তিনি ২৩ বছর তাহাজ্জুদ নামাজ আদায় করেন। উম্মতের জন্য তাহাজ্জুদ নামাজ সুন্নাত হলেও মহানবীর জন্য ওয়াজিব ছিল। তাই তিনি ৫ ওয়াক্ত নামাজের মতো তাহাজ্জুদ নামাজও পড়তেন। কারণ তাঁর জন্য অতিরিক্তভাবে ওয়াজিব হবার কারণে ।
তারাবি ও তাহাজ্জুদ দুটি ভিন্ন নামাজ। অনেকে দুটিকে এক করে ফেলেন। তারাবি ঘুমের আগে আর তাহাজ্জুদ পড়া হয় ঘুম যাওয়ার পরে। তাহাজ্জুদের নামাজ ২ থেকে ১২ রাকাত। স্ভাবিক নিয়মে ৮ রাকাত। আর তারাবির নামাজ কমপক্ষে ২০ রাকাত। কেউ অতিরিক্ত পড়তে চাইলেও পড়তে পারেন।
তারাবির নামাজ অনুমোদিত হয়েছে ১০ম হিজরীতে। মুসলিম শরীফে এসেছে মুহাম্মদ (সা) জীবনে তারাবির নামাজ জামাতে পড়েছেন ৩বার। এরপর তিনি মৃতুবরন করেন। রাসূল (সা) এর শেষ বয়সে তারাবি এসেছে। আল্লাহপাক তারাবি ওয়াজিব করে দিলে উম্মতের কষ্ট বাড়ার আশংকায় তিনি বেশি দিন জামাতে তারাবি আদায় করেননি। তাহাজ্জুদের নামাজের কথা কোরআনে আছে। কোরআনের আয়াত দ্বারা প্রমাণিত। আর তারাবির নামাজ হাদিস দ্বারা প্রমাণিত।
একাকি পড়ার চাইতে জামাতে তারাবির নামাজ পড়ায় সওয়াব ও রহমত বেশি। তারাবির নামাজ কয় রাকাত? কেউ বলেন ৮, কেউ বলেন ১২ আবার কেউ বলেন ২০ রাকাত। প্রকৃতপক্ষে ২০ রাকাত। যারা ৮ রাকাত বলেন, তারা বোখারী শরীফের একটি হাদিসের দলিল দেন। আয়েশা (রা) জিজ্ঞেস করা হলো, রাসূলের রাতের নামাজ কি? তিনি বলেছেন, রাসূল রমজানে ১১রাকাতের বেশি আদায় করতেন না। ১১রাকাতের মধ্যে ৩ রাকাত বেতর বাদ দিলে তখন ৮ রাকাত হয়ে যায়। কিন্তু হাদিসবিদরা বলেন , এটি আসলে তারাবি নয়, এটি তাহাজ্জুদ সম্পর্কে বলা হয়েছে।
এই হাদিস লিখেছেন ইমাম বোখারী । তিনি যে অধ্যায়ে এটি লিখেছেন, সেটি তাহাজ্জুদের অধ্যায়ে রয়েছে। উনি বুঝাতে চেয়েছেন তারাবি নয়, তাহাজ্জুদ। তারাবি হলে ওই অধ্যায়ে রাখতেন না। যে হাদিসের মধ্যে ৮ রাকাত আছে এটি সহীহ হাদিস, বিন্তু এটি তারাবি নয় । সেই কারণে ইমাম বোখারী (রা) সেটি তাহজ্জুদ অধ্যায়ে রেখেছেন। আসলে রাসূল (সা) যে জামাতের সহিত তারাবি পড়িয়েছেন সেটা কয় রাকাত ছিল? ২০ রাকাত ছিল, এমন একটি হাদিসে আছে। তবে তা সহীহ নয়। কিন্তু যেটা ৮ রাকাত সহীহ, সেটা আবার তাহাজ্জুদ, তারাবি নয়। রাসুলুল্লাহ (সা.) আসলে কত রাকাত পড়েছেন সেটা সহীহ হাদিস দ্বারা প্রমাণিত নয়। রাসূলের ইন্তেকালের পর ১৩ বছর বিচ্ছিন্নভাবে তারাবির নামাজ পড়া হতো। ১৪ হিজরীতে ওমর (রা) জামাতে তারাবির নামাজের ব্যবস্থা করেন। তখন থেকে ২০ রাকাত চালু হয়েছে। আজ ১৪ শতাধিক বছর পর্যন্ত তা চলমান। কেয়ামত পর্যন্ত এটি চলমান থাকবে।
এটি গ্রহণ করা যাবে সুন্নতে সাহাবা হিসেবে। কারণ নবী বলেছেন, তোমরা আমার আদর্শ সুন্নাহকে গ্রহণ কর এবং খোলাফায়ে রাশেদীনের সুন্নাহকেও গ্রহণ কর। ওমর (রা) খোলাফায়ে রাশেদীনের একজন। তাই আমাদের ওমর (রা) তারাবি মানা প্রয়োজন। ২০ রাকাত না মানলে রাসূলের ওই হাদিস মানলাম না। তিনি শুধু ৪ খলিফার সুন্নাহকে গ্রহণ করার কথা বলেছেন, অন্যদের নয়। কোরআন শরীফের বর্তমান পান্ডুলিপি ওসমান (রা) এর সুন্নাহ। তাই ৪ মাজহাবসহ আলেম সমাজের ঐক্যমতের ফয়সালা হলো-তারাবির নামাজ কমপক্ষে ২০ রাকাত সুন্নাত। তাই মক্কা-মদীনায় ও ২০ রাকাত তারাবি আদায় করা হয়।
রাসুলুল্লাহ (সা.) সালাতুত তারাবিহকে কতখানি গুরুত্ব দিতেন এবং উম্মতি মোহাম্মদীর জন্য তারাবি যাতে ফরজ হয়ে না যায়, সেজন্য কী করেছেন তা নিচের হাদিস পড়লেই বুঝতে পারবেন। হাদিসের তথ্যমতে রাসুলুল্লাহ (স.) তিনদিন মসজিদে নববীতে জামাতের সঙ্গে তারাবির নামাজ আদায় করেছেন। অতঃপর রাসুলের যুগে এবং হজরত আবু বকর (রা.)-এর খিলাফতকালে এবং হজরত ওমর (রা.)-এর খিলাফতের প্রথম দিকে মুসলমানরা একাকী অথবা খণ্ড খণ্ড ছোট জামাতে তারাবির নামাজ আদায় করতেন।
অবশেষে হজরত ওমর (রা.) হজরত উবাই ইবনে কা’ব (রা.)-কে ইমাম নির্ধারণ করে সম্মিলিতভাবে জামাতের সঙ্গে ২০ রাকাত তারাবির নামাজ আদায়ের স্থায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। (সহি বোখারি : ২০১০ )।
রমজানে তারাবির নামাজের গুরুত্ব সীমাহীন। কারণ মাহে রমজান যেসব বিশেষ বৈশিষ্ট্যের জন্য মহিমান্বিত, তার মধ্যে অন্যতম হলো তারাবির নামাজ। তারাবির নামাজ মুসলমানদের ওপর সারা বছরের মধ্যে শুধুই রমজান মাসের জন্য সুন্নাত বিধান হিসেবে স্থিরকৃত। যেহেতু রমজান মাস ছাড়া বছরের অন্য কোনো সময়ে তারাবির নামাজ আদায় করার সুযোগ নেই, তাই বার্ষিক ইবাদত হিসেবে এর গুরুত্ব অন্যান্য সুন্নাত নামাজ অপেক্ষা বেশি। রাসুলে কারিম (স.) তারাবির নামাজকে অত্যন্ত গুরুত্বসহ আদায় করতেন বলে সহিহ হাদিস দ্বারা প্রমাণিত।
আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহকে (সা.) রমজান সম্পর্কে বলতে শুনেছি, যে ব্যক্তি ঈমানের সঙ্গে সওয়াব (পুণ্য) লাভের আশায় কিয়ামে রমজান তথা তারাবির নামাজ আদায় করবে, তার পূর্ববর্তী সব গুনাহ মাফ করে দেওয়া হবে।
তাই মাহে রমজানের বিশেষ ফজিলতপূর্ণ তারাবির নামাজকে কোনোভাবেই অবহেলা করা উচিত নয়। আসুন! মহানবী (সা.) এর ঘোষণামতে তারাবির নামাজ আদায় করে মহান আল্লাহ পাকের কাছে গুনাহ মাফের বিশেষ সুযোগকে কাজে লাগাই।
আল্লাহপাক আমাদের সবাইকে ইসলামী হুকুমমতে তারাবির নামাজ আদায় করার তওফিক দিন- আমিন।

লেখক: ব্যুরোচিফ, বাংলাভিশন, চট্টগ্রাম

পূর্বকোণ/এএইচ

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট