চট্টগ্রাম সোমবার, ০৬ মে, ২০২৪

সর্বশেষ:

সবচেয়ে উত্তম ইবাদত কোরআন তিলাওয়াত

১৭ মার্চ, ২০২৩ | ৪:০৫ অপরাহ্ণ

ত্রিশ পারা আল কুরআন সংরক্ষিত আছে লৌহে মাহফুজে। আল্লাহপাক লিপিবদ্ধ এই কোরআন নাজিল করেন শবে কদরে । কাবার ঘর বরাবর প্রতিটি আসমানে রয়েছে কাবা ঘর। যেখানে ফেরেশতারা ইবাদত করেন। প্রথম আসমানের কাবা ঘরকে বলা হয় বাইতুল ইজ্জত। সপ্তম আসমানের কাবা ঘরকে বলা হয় লৌহে মাহফুজ। বাইতুল ইজ্জত থেকে ২৩ বছরে আমাদের প্রিয় নবীর উপর ৩০ পারা কোরআন নাজিল করেন আল্লাহপাক। প্রাথমিক যুগে কোরআন গাছের ছালে, পাথরে, খেজুর গাছের বাকলে লিখে সংরক্ষণ করা হতো। কোরআন মাজিদ লেখার পাশাপাশি সাহাবিগণ মুখস্থ করে তার সংরক্ষণ করতেন। এরপর ধারাবাহিকভাবে ৪ খলিফা, সাহাবায়ে কেরাম, তাবেইন, তবে তাবেইন, তাদের সংরক্ষনের মাধ্যমে এই কোরআন আমাদের মাঝে এসেছে।
পবিত্র কোরআনের প্রথম নির্দেশ ‘পড়ো’। পড়া আর লেখার সমন্বয়ই শিক্ষা। আর লিখতে হলে দরকার কলমের। তাই কলমের গুরুত্ব অনুধাবনের জন্য কোরআনের একটি সুরার নামকরণ করা হয়েছে ‘আল কলম’। আর আল্লাহ কোরআনের নাম রেখেছেন ‘আল কিতাব’ । বলা হয়েছে, “এটা সেই কিতাব, যাতে কোনো সন্দেহ নেই, আল্লাহভীরুদের জন্য এটি পথনির্দেশ।” (সুরা : বাকারা, আয়াত : ২)

পৃথিবীর ইতিহাস সাক্ষী, ইসলামই সর্বপ্রথম মূর্খতা, নিরক্ষরতা ও অজ্ঞতার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। বরং সব অধিকার ও কর্তব্য ছাপিয়ে ইসলাম শিক্ষাকে সর্বপ্রধান ও সর্বপ্রথম কর্তব্য ও অধিকার বলে ঘোষণা করেছে। বিশ্বমানবতার মুক্তির উদ্দেশ্যে উচ্চারিত ইসলাম ধর্মের প্রথম আহ্বান : ‘পড়ো, তোমার প্রতিপালকের নামে, যিনি সৃষ্টি করেছেন। সৃষ্টি করেছেন মানুষকে রক্তপিণ্ড থেকে। পড়ো, তোমার প্রতিপালক মহিমান্বিত; যিনি কলমের সাহায্যে জ্ঞান দান করেছেন। মানুষকে শিখিয়েছেন, যা সে জানত না।’ (সুরা : আলাক, আয়াত : ১-৫)

মানুষের ওপর আল্লাহর যত নিয়ামত ও অনুগ্রহ রয়েছে, শিক্ষার নিয়ামতকে কোরআনে সবার ওপরে স্থান দেওয়া হয়েছে। বলা হয়েছে, ‘দয়াময় আল্লাহ, তিনিই শিক্ষা দিয়েছেন কোরআন। সৃষ্টি করেছেন মানুষকে। তিনিই তাকে শিখিয়েছেন ভাব প্রকাশ করতে।’ (সুরা : আর-রহমান, আয়াত : ১-৪)। এখানে মানব সৃষ্টির বিষয়টির ওপরে শিক্ষাকে স্থান দেওয়া হয়েছে।
শিক্ষার জন্য প্রয়োজন শিক্ষকের। তাই আল্লাহ মানুষকে শেখানোর জন্য শিক্ষকও পাঠিয়েছেন। রাসুল (সা.) বলেন, ‘নিশ্চয়ই আমি শিক্ষক হিসেবে প্রেরিত হয়েছি।’ (দারেমি) আর মহান শিক্ষক মহানবী (সা.) এসে ঘোষণা করলেন, ‘প্রত্যেক মুসলমানের জন্য জ্ঞান অর্জন করা ফরজ।’

নবীর যুগে কোরআন সংরক্ষণ করা হয়েছে প্রথমে মুখস্থ করার মাধ্যমে । যখন কোরআনের কোন আয়াত নাজিল হতো সাহাবায়ে কেরাম মুখস্থ করে ফেলতেন। এরপর দক্ষ সাহাবীরা লিপিবদ্ধ করার কাজ শুরু করেন। নবী যখন ইন্তেকাল করলেন, তখন আবু বক্কর (রা) কে ওমর (রা) বললেন, কোরআনের হাফেজ যদি যুদ্ধে অব্যাহতভাবে মারা যায়, তাহলে কোরআনের আয়াত এলোমেলো হয়ে যেতে পারে। তাঁর পরামর্শ পুরো কোরআন মজিদের একটি ফান্ডুলিপি তৈরী করুন। তখন তিনি ৩০ প্যারা কোরআনের ফানডুলিপি তৈরী করেছিলেন। এরপর ওমর (রা) এর যুগেও সেই পান্ডুলিপি ছিল। এরপর ওসমান (রা) এর যুগে সাহাবায়ে কেরাম বিভিন্ন পদ্ধতিতে, বিভিন্ন ভাষার উপর কোরআন তেলওয়াত করতেন। তৈরি হলো মতানৈক্য । এসব কথা যখন ওসমান (রা) এর কানে আসলো। তিনি সাহাবীদের সাথে পরামর্শ করলেন। তখন তারা পরামর্শ দিলেন কোরআনকে একটি পঠন পদ্ধতির উপর সংকলন করুন। তখন তিনি আগের ৬ পঠন পদ্ধতি বাদ দিয়ে একটি পঠন পদ্ধতির উপর অর্থাৎ কোরাইশের ভাষার উপর তিনি কোরআন সংকলন করেন। কোরআনের বাকী সব পঠন পদ্ধতি পুড়িয়ে ফেলেন। কারণ ভবিষ্যতে এগুলো নিয়ে যেন আর কোন মতানৈক্য তৈরি না হয়। সেই কারণে ওসমান (রা) কে বলা হয় কোরআন সংকলক।

বর্তমানে আমাদের কাছে যেই কোরআন আছে, সেটা হলো ওসমান (রা) এর সংকলন করা কোরআন। তিনি সংকলনের জন্য ৪ প্রখ্যাত সাহাবীকে দায়িত্ব দিয়েছিলেন। ৪জনের প্রধান ছিলেন জাহিদ বিন সাবিদ (রা) । এবং তিনি রাসূলের যুগে যে ৪২জন লেখক ছিলেন তাদের প্রধান ছিলেন। কেয়ামত পর্যন্ত ওসমান (রা) এর সংকলন করা কোরআন থাকবে। তবে হ্যা তার যুগে নোকতা, হরকত দেয়া ছিল না। পরবর্তীতে সাজ্জাদ বিন ইউসুফ কোরআনের মধ্যে নোকতা, হরকত এর ব্যবস্থা করেন। যাতে আরবের বাইরের মানুষেরাও সহজে এই কোরআন তেলওয়াত করতে পারেন।

কোরআন তেলওয়াত না বুঝে করলেও সওয়াব, শুনলেও সওয়াব । এই জন্য সুরা বাকারা এর পরে আল্লাহপাক কোরআনের প্রথম শব্দ ‘আলিফ লাম মিম’ এর অর্থ আমরা অকাট্যভাবে জানি না। আলিফ লাম মিম এর সঠিক অর্থ আল্লাহপাকই জানেন। এমন ১৪টি বর্ণ আল্লাহপাক কোরআনে ব্যবহার করেছেন। তাই না বুঝে পড়লেও সওয়াব দেবেন। প্রতি বর্ণে ১০টি করে নেকি। বর্তমানে এই কোরআনকে সংরক্ষণকারী কোটি কোটি হাফেজ তৈরী হয়ে আছে। কেয়ামত পর্যন্ত আল্লাহপাক এই কোরআন সংরক্ষণ করবেন এর একটি নোকতাও পরিবর্তন হবে না।

সেই কারণে আল্লাহপাক কোরআনে নিজেই ঘোষণা করেছেন, “কোরআনকে আমি নাজিল করেছি এবং এই কোরআনকে আমি নিজে হেফাজত করব”। ভুলভাবে কোরআন পাঠে নামাজ নষ্ট হবে। তাই কমপক্ষে নামাজ আদায় করার মতো ছোট ছোট সূরা শিখা আপনার জন্য ফরজ। যদি আপনি না শিখে ভূল কেরাত দিয়ে নামাজ পড়েন তা শুদ্ধ হবে না। ওই নামাজ কবুল হবে না। কোরআন বিশুদ্ধভাবে পড়া প্রত্যেক মুমিনের জন্য ফরজে আইন। আলেম হওয়া ফরজে আইন নয়, বিশুদ্ধভাবে কোরআন তেলওয়াত ফরজে আইন। বিশুদ্ধভাবে না পড়লে আপনার নামাজের কোন গুরুত্ব আল্লাহর নিকট থাকবে না।
চার মাযহাবের প্রখ্যাত ইমাম, আহমাদ বিন হাম্বল (রা) বলেছেন, “আমি ৯৯বার আল্লাহকে স্বপ্নে দেখেছি। আল্লাহকে জিজ্ঞেস করেছি, কোনটি উত্তম ইবাদত? প্রত্যেকবার আল্লাহ বলেছেন, সবচেয়ে উত্তম ইবাদত কোরআন তেলওয়াত ”। সুবহানাল্লাহ। কোরআন দামি বানিয়েছে শবে কদরকে। কোরআন দামি বানিয়েছে রমজান মাসকে। কোরআন দামি বানিয়েছে নামাজকে। নামাজের মধ্যে কোরআন তেলওয়াত না থাকলে নামাজের মর্যাদা রোজার বেশি হতো না। জাকাতের উপর হতো না। কোন ইবাদতের উপর হতো না। রমজানে যদি কোরআন নাজিল না হতো রমজান মাসের মর্যাদা অন্য মাসের উপর হতো না। শবে কদর হাজার রাতের চাইতে উত্তম। বছরে ৩৬৫ রাতের মধ্যে সেরা রাত লাইলাতুল কদর। এটাও একমাত্র কোরআনের কারণে । সুবহানাল্লাহ।
কারণ কোরআনের মর্যাদা সমস্ত মাখলুকাতের উপর। সমস্ত নবী- রাসূলদের উপর। কারণ এটি আল্লাহর কালাম, আল্লাহর সিফাত। কোরআন সৃষ্টি নয়, এটি আল্লাহর গুণাবলির অর্ন্তভুক্ত। তাই কোরআনের মর্যাদা সবার উপরে।
মহানবী (সা) একটি হাদীসে বলেছেন, সবচেয়ে উত্তম ব্যক্তি হলো- যারা কোরআন শিখে এবং অপরকে শেখায়। তাই নবী বলেছেন, তোমরা কোরআন তেলওয়াত করো, আখেরাতের কল্যাণের পাশাপাশি দুনিয়ার কল্যাণও এর মাঝে নিহিত। তেলওয়াতে আপনি শুধু সওয়াবই পাবেন না, মনে আসবে প্রশান্তি। কারণ এটি উত্তম জিকির। জিকির এর মাধ্যমে মানুষের মনে প্রশান্তি আসে। তাই আমাদের উচিত প্রত্যেকদিন কোরআনের কিছু অংশ তেলওয়াত করা। এভাবে তেলওয়াত করলে এই কোরআন আমাদের জন্য কেয়ামতের দিন সুপারিশ করবে। হে আল্লাহ আমি সুপারিশ করছি তাঁকে জাহান্নাম থেকে মুক্তি দিন, জান্নাতে যাওয়ার ব্যবস্থা করে দিন।

মহানবী (সা) হাদীসের মধ্যে রয়েছে, তোমরা দুই আরোগ্য প্রদানকারী আগলে ধরো। একটি হলো কোরআন, আরেকটি হলো মধু। মধুর মধ্যে মানুষের অনেক রোগের শিফা আছে। ঠিক তেমনি কোরআন তেলওয়াতের মধ্যেও মানুষের অনেক রোগের শিফা হয়ে যায়। আল্লাহপাক আমাদের সকলকে এই কোরআন আঁকড়ে ধরার, তৎমতে আমল করার, নিয়মিত প্রতিদিন কোরআন তেলওয়াত করার তৌফিক দান করুন। আমিন।

লেখক: ব্যুরোচিফ, বাংলাভিশন, চট্টগ্রাম

পূর্বকোণ/এএইচ

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট