চট্টগ্রাম শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

বিদায় হজ্জের ভাষণ, মানবতার ঘোষণাপত্র ও আজকের অভিজ্ঞান

এজাজ ইউসুফী

৩০ অক্টোবর, ২০২০ | ১:৫১ অপরাহ্ণ

আমি নিজে ধর্ম বিষয়ে বলার মতো কোনো অভিজ্ঞজন নই। কিন্তু তুলনামূলক ধর্মতত্ত্ব বিষয়ে সাধারণ জ্ঞান থেকে এই লেখাটি তৈরি করেছি। আজ ঈদে মিলাদুন্নবী। এই দিনটি মুহাম্মদ (সা.) এর আগমন ও তিরোধান দিবস হিসেবে পালিত হয়। ‘রবিউল আউয়াল’ মাসেই তিনি এলেন এবং চলেও গেলেন। ‘রবিউল আউয়াল’ শব্দের অর্থ ‘প্রথম বসন্ত’। আরবে এই ঋতুতে প্রকৃতি রুক্ষ থেকে শ্যামল রূপ ধারণ করে। মুহাম্মদ (সা.) ১৪৪৬ বছর আগে জন্মগ্রহণ করেন যখন আরব দেশে ঘোর অন্ধকার যুগ চলছিলো। মানবতা চরমভাবে পতিত হয়েছিলো তখন তিনি সাম্যের ও ভ্রাতৃত্বের এবং বিশ্বশান্তির বাণী প্রচার করে তাদের উদ্ধার করতে আসেন।

চৌদ্দ’শ বছর আগের আরব দেশ ছিলো নিকৃষ্টতম বর্বরতার দেশ। যেখানে শিশুকন্যাকে জীবন্ত কবর দেয়া হতো। অধঃপতন এমন পর্যায়ে পৌঁছেছিলো যে, সামাজিক বিশৃঙ্খলা, রাজনৈতিক স্বৈরশাসন, অর্থনৈতিক দেউলিয়াপনা চূড়ান্ত স্তরে উপনীত হয়েছিলো। বর্বর আরবরা মানবিক সব গুণাবলি হারিয়ে ন্যূনতম মনুষ্যত্ব হারিয়ে বসেছিলো। “আইন, বিচার ও প্রশাসন সবক্ষেত্রে চলেছে তাগুতী শাসন, মানুষে মানুষে হানাহানি, উটকে পানি খাওয়ানোর মতো তুচ্ছ বিষয় নিয়ে চলেছিলো যুগের পর যুগ যুদ্ধ। জীবন্ত কবর দিচ্ছিল বাবা নিজ কন্যাকে, সুদ ছিল দুনিয়ার অর্থনৈতিক ভিত্তি, ব্যভিচার, মদ ও জুয়া ছিল সমাজের উপর তলার লোকদের নিত্যদিনের কাজ। অসহায়, ইয়াতিম, অনাথ বঞ্চিত মানবতা যখন করছিল গগনবিদারি ফরিয়াদ, নারী জাতি ছিল মর্যাদাহীন খেলনার বস্তু। আদর্শিক, নৈতিক অবস্থা বলতে কিছুই ছিল না। এসময় ৫৭০ খ্রিস্টাব্দের ১২ই রবিউল আউয়াল সুখময় বসন্তকাল হিসেবে তিনি আগমন করেছিলেন।” (ঈদে মিলাদুন্নবীর (সা.) এর গুরুত্ব ও শিক্ষা এ.কে.এম. মাহবুবুর রহমান)

এরকম এক মানবিক বিপর্যয়ের সময় মুহাম্মদ (সা.) পৃথিবীর ক্রম-বিকাশের ইতিহাসে একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেছিলেন। মধ্যযুগের বর্বরতার মধ্যে সেটি ছিলো মানবতা প্রতিষ্ঠার সুমহান বার্তা। নতুন কোনো কিছু প্রতিষ্ঠা করতে গেলে পুরনো সব প্রথাকে ভাঙ্তে হয়। তিনি তাই করতে গিয়ে তীব্র প্রতিরোধ ও আক্রমণের স্বীকার হয়েছিলেন। যেমন একই কারণে যিশুকে ক্রুশবিদ্ধ করা হয়। সক্রেটিসকে বিষপান করতে বাধ্য করা হয়। এরা সকলেই যুগে যুগে মানব সভ্যতার শিশুকালকে একটি পরিণতির দিকে নিয়ে গিয়েছিলেন। তারই পথ ধরে আজ আমরা জ্ঞান-বিজ্ঞান-প্রযুক্তির শীর্ষে অবস্থান করে নিতে সক্ষম হয়েছি। সেজন্যই কার্ল মার্কস বলেছিলেন, ‘ধর্ম হচ্ছে নিপীড়িত মানুষের আশ্রয়’। পৃথিবীর বিবর্তনে-পরিবর্তনে বহু মহাপুরুষের আগমন ঘটেছে বলেই আমরা আজকের অবস্থানে দাঁড়াতে সক্ষম হয়েছি। মুহাম্মদ (সা.) মাত্র ৬৩ বছরের জীবনে পৃথিবীতে জ্ঞানের আলো প্রজ¦লিত করতে পেরেছিলেন। আর যাবার বেলায়, বিদায় হজ্জের ভাষণে চৌদ্দ’শ বছর আগে যে দিক-নির্দেশনা দিয়ে গিয়েছিলেন তার অনেকগুলোর তাৎপর্য আজও সমান গুরুত্ব বহন করে। প্রফেট জানতেন এটাই তাঁর শেষ ভাষণ! তাঁর জীবনাভিজ্ঞতার সার কথাগুলো বলে গিয়েছিলেন ৬৩২ খ্রিস্টাব্দে আরাফাতের ময়দানে লক্ষ অনুসারীর সামনে। নির্দেশ দিয়েছিলেন তাঁর কথাগুলো যেন সবখানে পৌঁছে দেয়া হয়। তিনি সেই ভাষণের একটি অংশে বলেন, “কেননা অনেক জ্ঞানের বাহক নিজে জ্ঞানী নয় (সে অন্যের নিকট জ্ঞান বহন করে নিয়ে যায়) এবং অনেক জ্ঞানের বাহক তার চাইতে অধিকতর জ্ঞানীর নিকটে জ্ঞান বহন করে নিয়ে যায়।” এই একটি নির্দেশনা থেকে আমরা জানতে পারি তিনি জ্ঞানের (ঘ) সাধক ছিলেন। আজকের দিনেও ‘নলেজ ইজ পাওয়ার’ একথা সর্বজনস্বীকৃত। তিনি যেখানেই যেতেন, সেই এলাকার জ্ঞানী-ব্যক্তিদের ডেকে পাঠাতেন এবং তাদের জ্ঞানের কথা শ্রবণ করতেন। উপযোগী হলে তা তিনি নিজের জ্ঞানের সঙ্গে আত্মিকৃত করে নিতেন। আজকে আমাদের মধ্যে কী এই চর্চা আছে? আমরা কী জ্ঞান অর্জনের জন্য চীন (সে সময় চীন দর্শন-জ্ঞান-বিজ্ঞানে প্রাগ্রসর ছিলো) যেতে প্রস্তুত? না ব্যবসাটাই বড়। মূলধন কীভাবে এবং কী উপায়ে বাড়ানো যায় তার ধান্ধায় ব্যস্ত।

রসূল দূরদর্শী ছিলেন। আরাফাতের ময়দানে যে লক্ষ লোকের সমাবেশ হয়েছিলো তারা সকলেই ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত ছিলেন। কিন্তু তিনি তাঁর ভাষণ শুরু করলেন ‘হে মুসলমানগণ’ বলে নয়, ‘হে জনম-লী’ অথবা ‘হে মানবজাতি’ বলে। কারণ, তিনি যা বলতে চেয়েছেনÑ তা যেন পৃথিবীর সব শান্তিকামী এবং মানবতাবাদী মানুষের কাছে পৌঁছায়। অথচ চৌদ্দশ বছর আগের তাঁর জ্ঞানের কথাগুলো অনুসরণ না করে তাকে তথাকথিত বুদ্ধিজীবীরা ধর্মান্ধ হিসেবে চিহ্নিত করার চেষ্টা করে থাকেন। এই প্রচেষ্টা সাম্প্রতিক বিশ্বে আরও প্রবল হয়েছে। কারণ, মানবগোষ্ঠীর মুক্তির বাণী নিয়ে যে সাম্যবাদ পুঁজিবাদের বিপক্ষে দাঁড়িয়েছিলো তার অবনমন হয়েছে। বিশ^ একচ্ছত্র পুঁজিবাদের পক্ষতলে আশ্রয় নিয়েছে। গ্রামবিশ্বের (গ্লোবাল ভিলেজ) নামে তার শাসন-শোষণ পৃথিবীব্যাপী বিস্তৃত হয়েছে। পুঁজিবাদের বেঁচে থাকার জন্য একটি প্রতিপক্ষ লাগে। একসময় কমিউনিস্ট সোভিয়েত ইউনিয়ন তার প্রতিপক্ষ ছিলো। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে পড়ার পর আজ সে ইসলামকে তার পুঁজিতন্ত্র রক্ষার জন্য প্রতিপক্ষ হিসেবে দাঁড় করিয়েছে। দার্শনিক জর্জ বার্নার্ডশ’ The Genuin Islam গ্রন্থে (সম্ভবত) বলেন, পৃথিবীতে যদি সমাজতন্ত্রের পতন হয় তাহলে ইসলামই হবে পুঁজিবাদের প্রধান প্রতিপক্ষ। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, তাঁর ভবিষ্যৎবাণীই আজ সত্যরূপে প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে। অন্যদিকে, মুসলমানদের একটি সুবিধাবাদী অংশ তাদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে ইসলামী জঙ্গীগোষ্ঠী তৈরি এবং চৌদ্দশ বছর আগের সেই অন্ধকার যুগে ফিরে যাবার স্বপ্নে বিভোর।

একবার দেখা যাক বিদায় হজ্জের ভাষণের চুম্বক অংশগুলো কি বলছে। আমার মতে এটিই পৃথিবীর প্রথম ‘মানবিক মেনিফেস্টো’। কারণ, তিনি সেই সময়ের মানব-সমাজের জন্য একটি লাইফ লাইন (গাইড লাইন নয়) দিয়ে গিয়েছিলেন। তিনি সামাজিক পাপ ও অনাচারের বিরুদ্ধে খুবই কঠোর ছিলেন সেদিন। তাঁর ভাষণের কিছু সারকথা তুলে ধরছি ১. রাষ্ট্র ও সমাজের মধ্যে একটি শৃংখলার বন্ধন থাকবে। ২. সুদপ্রথা বন্ধ করতে হবে। সৎপথে আয় করে জীবন নির্বাহ করতে হবে। ৩. শোষণমুক্ত সমাজ গঠন। ৪. সমাজকে কুসংস্কার মুক্তকরণ। ৫. আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা। ৬. মানুষের জীবন ও সম্পদের নিরাপত্তা বিধান ও আমানত রক্ষা। ৭. সাম্য, স্বাধীনতা ও ন্যায়পরায়ণতা। ৮. উত্তরাধিকার আইনের উপর সর্বোচ্চ গুরুত্ব প্রদান। ৯. অন্যের উপর অত্যাচার না করা এবং নিজে অত্যাচারিত না হওয়া। ১০. স্ত্রীদের উপর স্বামীর যে অধিকার, স্বামীর উপর স্ত্রীদের একই অধিকারের স্বীকৃতি। ১১. কারও জন্য অন্যের সম্পদ বৈধ নয়। ১২. পরস্পর খুনোখুনি না করা। ১৩. নিরপরাধ মানুষের রক্তপাত চিরতরে বন্ধ করা। ১৪. আরবের উপর অনারবের এবং অনারবের উপর আরবের কোনো শ্রেষ্ঠত্ব নেই। সাদার উপর কালোর আর কালোর উপর সাদার কোনো মর্যাদা নেই। ১৫. মুসলিম সেই, যার যবনে ও হাত থেকে অন্যরা নিরাপদ থাকে। ১৬. অপরাধীর শাস্তি অপরাধী ব্যতিত অন্যের উপর বর্তাবে না। ১৭. দাসপ্রথা রহিতকরণ।

উপর্যুক্ত নির্দেশনাগুলো মানবজাতি দূরে থাক তাঁর অনুসারী মুসলমানেরা পালন করছে? এর উত্তর হবে ‘না’। “আজ আমাদের জীবন হয়ে উঠেছে চরম অশান্ত। অশান্তির দাবানল জ¦লছে সমাজের প্রতিটি স্তরে। মানবকলি শিশুরা আজ প্রতিপালনের ধারায় পরিবার, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অধিকার বঞ্চিত। মানব সভ্যতার মূল ভরসা যুব সমাজ আজ দিশেহারা। সমাজ-প্রবাহের উৎস বয়োবৃদ্ধরা চরম হতাশায় স্থবির। পরিবার-সমাজ, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কর্মস্থল, রাজপথ-বসতবাড়ি, মন্দির-গির্জা-প্যাগোডা কোথাও যে জীবনের স্বস্তি নেই, নেই নিরাপত্তা। প্রতারণা-ধোকাবাজি, প্রতিহিংসা-নিষ্ঠুরতা, মানব চরিত্রের অংশে পরিণত হয়েছে। ঘুষ, দুর্নীতি, সামাজিক রীতিতে পরিণত হয়েছে।
জুলুমবাজি-দখলদারি কৌলিন্যের প্রতীক হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। মিথ্যা সত্যের স্থান দখলে করে নিয়েছে। সমাজ সেবার নামে অসহায় জনগোষ্ঠীকে শোষণ করা হচ্ছে। ধর্মের নামে জীবন ও সম্পদের বিনাশকে পুণ্যময় বলে প্রচার করা হচ্ছে।” (খতীব, রাজশাহী কলেজ কেন্দ্রিয় মসজিদ)

মুহাম্মদ (সা.) তাঁর মানবজাতির জন্য একটি সার্বজনীন এবং যুগোপযোগী ঘোষণাপত্র দিয়ে গেছেন। এটি সর্বকালের শ্রেষ্ঠ মানবিক মেনিফেস্টোগুলোর একটি। পৃথিবীর উদার ও শান্তিকামী মানুষ এই যুক্তি মেনে নেবেন। তাঁর সবদিক বিবেচনা করেই Michael H.Hart,Muhammad-1, The 100 গ্রন্থে, “My choice of Muhammed to lead the list of the world’s most influential persons may surprise some readers and may be questioned by others, but he was the only man in history who was supremely successful on both the religious and secular levels.” মার্কিন জ্যোর্তিবিজ্ঞানীর এই উক্তির যথার্থতা কী তাঁর অনুসারীরা অনুধাবন করেন? যদি তাই হতো তা হলে আজ পৃথিবীর নিকৃষ্ট জাতির তাকমা তাদের কপালে জুটতো না। খুন-ধর্ষণ, পরস্বহরণ, রাষ্ট্রীয় সম্পদ লুঠ, দুর্নীতির মতো সামাজিক অপরাধে লিপ্ত হতে পারতো? তারা কী ধর্মান্ধ ও জঙ্গী হতে পারতো? কিন্তু পরিবর্তিত বিশে^ বাস্তবতা ভিন্ন। মুহাম্মদ (সা.) এর জন্ম ও মৃত্যু দিবসে তাঁকে শ্রদ্ধা জানাতে ইংরেজ কবি জন কীটসের উদ্ধৃতি দিয়ে শেষ করতে চাইÑ “পৃথিবীর যা কিছু মঙ্গলময়, যা কিছু মহৎ ও সুন্দর সবই নবী মুহাম্মদ। তাঁর তুলনা তিনি নিজেই।”

লেখক: এজাজ ইউসুফী, কবি ও সাংবাদিক।

পূর্বকোণ/এএ

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট