চট্টগ্রাম শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

বৃদ্ধ ছালামের দুঃসহ স্মৃতি রোমন্থন

স্ত্রী মা ছেলে কারোলাশ খুঁজে পাইনি

ইমরান বিন ছবুর

২৯ এপ্রিল, ২০১৯ | ২:৪৬ পূর্বাহ্ণ

আবদুর ছালাম। বয়স ৭২। ২৯ এপ্রিলে বেঁচে যাওয়াদের মধ্যে একজন। ওই রাতেই তিনি হারিয়েছেন পরিবারের তিন সদস্যকে। মা, স্ত্রী ও তিন বছরের এক ছেলে। খুঁজেও পাননি তাদের লাশ। তবে ঘূর্ণিঝড়ের ১০-১২ দিন পর স্ত্রীর পরনের একটুকরা কাপড় কুড়িয়ে পান তিনি। এটাই তার স্ত্রীর একমাত্র স্মৃতি। কথাগুলো বলতে গিয়ে চোখ দুটি ঝাপসা হয়ে পড়ে বৃদ্ধা আবদুর ছালামের। দীর্ঘ ২৮ বছর পর এখনো ভুলতে পারেনি সেই ভয়াল রাতের স্মৃতি। বঙ্গোপসাগর ঘেঁষা আনোয়ারা উপজেলার রায়পুর ইউনিয়নের উঠান্নের বাড়ির বাসিন্দা আবদুর ছালাম।
দৈনিক পূর্বকোণের কাছে সেই রাতের দুঃসহ স্মৃতি বর্ণনার এক পর্যায়ে ঢুকড়ে কেঁদে উঠেন আবদুর ছালাম। তিনি বলেন, সেদিন বিকেলে বাজারে গিয়েছিলাম। সন্ধ্যায় বাজার থেকে ফিরে দেখি আকাশের অবস্থা ভালো না। রাতের দিকে ঘরের উঠানে পানি চলে এসেছে। সেই সাথে প্রচন্ড বাতাস। এক পর্যায়ে কোনো উপায় না দেখে পরিবারের সবাই পাশের বাড়ির ছাদে আশ্রয় নিই। সাগরের বিশাল একটা ঢেউ এসে আমাকে ছাদ থেকে নিচে ফেলে দেয়। এরপর একটা আম গাছে আশ্রয় নিই কিছুক্ষণ। এরপর কি হয়েছে আমার আর কিছু মনে নেই। সকালে জ্ঞান ফিরলে দেখি, আম গাছটির পাশে শুয়ে আছি।
পায়ের ক্ষত স্থান দেখিয়ে বলেন, টিনের আঘাতে বাম পায়ের গোড়ালি কেটে যায়। তখন নড়াচড়া করার শক্তি নেই আমার। এলাকার কয়েকজন এসে আমাকে ধরে বাজারের একটি চায়ের দোকানে নিয়ে যায়। সেখানে শুইয়ে রাখে। খাওয়ার জন্য কিছু নেই। কে যেন এসে এক বোতল পানি দিয়ে যায়। তবে পানি কে দিয়ে গেছে তাও মনে নেই। গুন্দ্বীপ পাড়া (বারশত ইউনিয়ন) থেকে আত্মীয়-স্বজনরা কিছু খাওয়ার পাঠান। তিনি আরো বলেন, ১৯৯১ সালের ২৯ এপ্রিলের পর যে আর বাঁচবো এটা কল্পনা করিনি। আমার চাচাতো এবং জেটাতো ভাইয়ের পরিবারের মোট ৩২ জনকে ওই এক রাতেই হারিয়েছি। আমরা সবাই এক ভিটেতে ছিলাম। কারো কারো লাশ পেয়েছি, কারো লাশ পাইনি।
হাতের ইশারায় বঙ্গোপসাগরের কূলে নৌকা দেখিয়ে দীর্ঘ নিঃশ^াস ছেড়ে বলেন, এক সময় ওইখানে আমাদের ঘর ছিল। ৯১’র ২৯ এপ্রিলের এরপর তা সাগরে চলে যায়। এই সাগর আমাদের সবকিছু কেড়ে নিয়েছে। এখন যে ভিটেয় আছি, ৯১’র আগে কিনে রেখেছিল আমার বাবা।
কোনো সাহায্য পেয়েছে কিনা জানতে চাইলে আবদুর ছালাম বলেন, আমার পা কাটা থাকায়, ঘর থেকে বের হতে পারিনি। তাই কারো সাহায্য নিতে পারিনি। ছেলেমেয়েরা ছোট থাকায় তারাও কারো কাছে সাহায্যের জন্য যায়নি। তবে অনেকে সাহায্য পেয়েছে। ঘূর্ণিঝড়ের প্রায় মাসখানেক পর এলাকার একজন আমার হাতে ১০০ টাকা দিয়ে বলেন, টাকাগুলো আখতারুজ্জামান বাবু দিয়েছেন। আর প্রায় পাঁচ থেকে ছয় মাস পর বিদেশি এক সংস্থা একটা টিনের ঘর করে দিয়েছে।
উল্লেখ্য, ‘১৯৯১ সালের ২৯ এপ্রিল প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড়ে আনোয়ারার সবচেয়ে বেশি প্রাণহানি ঘটে রায়পুর ইউনিয়নে। ভয়াল রাতে এই ইউনিয়নে মারা গেছে তিন হাজার ৩৮৫ জন মানুষ। এরমধ্যে শুধু ময়নাগাজীর বাড়ির মারা গেছে ১২৯ জন। ১২ পরিবারের বেঁচে নেই একজন লোকও। নিহত বেশিরভাগ মানুষের লাশ পাওয়া গেলেও সাগরে ভেসে গেছে অনেকে।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট