চট্টগ্রাম শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

হলি ক্রিসেন্ট হাসপাতাল নাকি ‘মৃত্যুকূপ’!

ইমাম হোসাইন রাজু

২৩ জুন, ২০২০ | ৬:১২ অপরাহ্ণ

মাইনুল ইসলাম। সরকারের অবসরপ্রাপ্ত যুগ্ন সচিব ছিলেন তিনি। করোনা উপসর্গ নিয়ে চারদিন আগে ভর্তি হন নগরীর খুলশীর হলি ক্রিসেন্ট হাসপাতালে। কিন্তু সেবার নিতে ভর্তি হলেও যেন মৃত্যুরকূপেই ডুবে যাচ্ছিলেন তিনি। যেখানে গেল চারদিনেই তাঁর সাথে দেখা হয়নি কোন চিকিৎসক কিংবা নার্স-স্বাস্থ্যকর্মীরও। সেবাতো থাক দূরের কথা, একটু খাবারও জোটেনি তাঁর ভাগ্যে। চারদিনেই ৭০ উর্ধ্ব এ বৃদ্ধ শুধুমাত্র পানি আর বিস্কিট খেয়ে দিন পার করেছেন।
গতকাল সোমবার দুপুরে প্রাক্তন এ সচিবের সাক্ষাতে গিয়ে এমন চিত্র তুলে ধরেন তৌহিদুল ইসলাম নামে এক স্বেচ্ছাসেবক। যা নিজের ফেসবুকেও পোস্ট করেন এ স্বেচ্ছাসেবক। সেখানে তিনি হাসপাতালটিকে মৃত্যুরকূপ হিসেবেও উল্লেখ করেন।
তৌহিদুল ইসলাম পূর্বকোণকে বলেন, ‘চট্টগ্রাম বিশ^বিদ্যালয়ের (চবি) সমাজবিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডিন ড. গাজী সালেহ উদ্দিন স্যার আমাকে মাইনুল ইসলামকে দেখে আসতে বলেন। পরে হাসপাতালে গিয়ে খোঁজ নিয়ে জানি তিনি ৯ নম্বর কেবিনে ভর্তি আছেন। কিন্তু কেভিনে গিয়েই পুরো বাকরুদ্ধ হয়ে যাই। পুরো রুম ময়লা দুর্গন্ধ। বাথরুমে পানি উপছে পড়ছে। উনার সাথে (সচিব) কথা বলার পর জানতে পারলাম, পরিস্কারতো দূরের কথা ঠিকমতো খাবারও পায় না। এসব বিষয়ে সংশ্লিষ্টদের অনেকবার বলার পরও কোন ব্যবস্থা নেয়া হয়নি বলেও তিনি আমাকে জানান। কি হাসপাতাল, পরিবারেরও কেউ আসেনি। চারদিন থেকেই তিনি শুধুমাত্র বিস্কিট আর পানি খেয়ে ছিলেন। সাথে নিয়ে যাওয়া স্যুপ ও জুস খাওয়াতে গিয়ে একটি গ্লাসও খুঁজে পাইনি’
‘বিষয়টি সালেহ উদ্দিন স্যারকে জানানোর পর তাঁর পরামর্শে সর্বশেষ বিকেলে তাকে হালিশহরের করোনা আইসোলেশন সেন্টারে নিয়ে যাই। বর্তমানে তিনি এখানে আছেন। আমরাই তার দেখভাল করছি।’ তিনি অভিযোগ সুরে বলেন, ‘হলি ক্রিসেন্ট একটি হাসপাতাল না, এটি একটি মৃত্যুকূপ। এখানে স্বজনহীন যে কেউ করোনায় মারা যাবার আগে না খেয়ে মারা যাবে। যেখানে দুইজন নার্স সবসময় থাকলেও তারা এক মিনিটের জন্যও রুম থেকে বের হন না।’
শুধু সরকারের উচ্চপদের এ কর্মকর্তাই নয়, নানা নাটকীয়তার পর বিশেষায়িত ঘোষণা দিয়ে বেসরকারি হাসপাতাল মালিকদের গড়া হলি ক্রিসেন্ট হাসপাতালের চিত্র এখন এমনই। যদিও হাসপাতালটির বর্তমানে সরকারিভাবেই চালানো হচ্ছে। তবে অব্যবস্থাপনার অভিযোগের কমতির যেন শেষ নেই।
অভিযোগ রয়েছে, কোন রকম জোড়াতালি দিয়েই সরকারকে হাসপাতালটি হস্তান্তর করেছেন বেসরকারি হাসপাতাল মালিকরা। শুরু থেকেই ১২ শয্যার ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিট (আইসিইউ) ও ৮০টি সাধারণ শয্যাসহ একশ শয্যার বিশেষায়িত হাসপাতালের গল্প শোনালেও পুরো চিত্রই ভিন্ন। আইসিইউ শয্যা চালুতো থাক দূরের কথা, সাধারণ কেবিনগুলোও নোংরা ও জর্জরিত অবস্থায় আছে। নেই পানির কোন ব্যবস্থা। তবে যতটুকুই পাওয়া যায়, তা জোড়াতালি পাইপ দিয়ে পড়ে যায়। তারমধ্যে নেই পর্যাপ্ত চিকিৎসক-নার্স ও ওয়ার্ড বয়ও। সরকারিভাবে এসব জনবল নিয়োগ দেয়ার কথা থাকলেও বর্তমানে কাজ করছেন মাত্র ৩জন কনসালটেন্টসহ ১১জন চিকিৎসক। আছেন মাত্র দুইজন ওয়ার্ড বয় আর দুইজন সুইপার। এদের আবার সবাইকে রোস্টার করেই কাজ করতে হচ্ছে। যার কারণেই সব কিছু করা সম্ভব হচ্ছে না বলে দাবি সংশ্লিষ্টদের।
জানতে চাইলে হাসপাতালের দায়িত্বরত সহকারী পরিচালক ডা. মনোয়ার হোসেন চৌধুরী পূর্বকোণকে বলেন, ‘শুরু থেকেই আমাদের জনবল নেই। তারমধ্যে কয়েকজন করোনায় আক্রান্ত হয়ে বাসায় আছেন। উপজেলা পর্যায় থেকে কিছু নার্স দেয়া হলেও তারা ভয়ে কাজ করতে অনিহা। যদিও চিকিৎসদের সাথে গিয়ে থাকেন। তারমধ্যে মাত্র দুইজন করে ওয়ার্ড বয় ও সুইপার দিয়ে পুরো হাসপাতাল পরিস্কার পরিচ্ছন্নতার কাজ করতে হচ্ছে। পুরো হাসপাতালে অবকাঠামো ঠিক নেই। মিস্ত্রী নিয়ে আসলেও তারা কোভিড রোগী আছে শুনে কাজ করে না। তারপারও কোন রকম জোড়াতালি দিয়ে চালিয়ে যেতে হচ্ছে। বাধ্য হয়ে রোগীরা ভর্তির সময় তাদের এসব বিষয়ে বলে দিচ্ছি। এরপর যারা ভর্তি হচ্ছেন, তারা নিজেরাই সব ব্যবস্থা করছেন বলেও উল্লেখ করেন তিনি।
এদিকে, হাসপাতালে রোগী-চিকিৎসকদের খাবার থেকে শুরু করে এখন পর্যন্ত সরকারি কোন বাজেট পাওয়া যায়নি বলে জানিয়েছেন হাসপাতালটির প্রধান দায়িত্বে থাকা চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক (ভারপ্রাপ্ত) ডা. শফিকুর রহমান। তিনি পূর্বকোণকে বলেণ, ‘রোগীর খাবার তো থাক দূরে, চিকিৎসকসহ অন্যান্য কোন বাজেটেই পাওয়া যায়নি। আর চিকিৎসার বিষয়ে এর আগেও অভিযোগ পেয়েছি। বিষয়টি নিয়ে কথা বলে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।’

পূর্বকোণ / আর আর

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট