চট্টগ্রাম শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

ফুটপাতে হকার, অলিগলিতে আবর্জনার স্তূপ
ফুটপাতে হকার, অলিগলিতে আবর্জনার স্তূপ

ফুটপাতে হকার, অলিগলিতে আবর্জনার স্তূপ

আয়তন : ১ বর্গ কিলোমিটার জনসংখ্যা : ৫৮ হাজার ৯শ ভোটার : ১৭ হাজার ৭শ জন

আল-আমিন সিকদার

১ মার্চ, ২০২০ | ৩:০৮ পূর্বাহ্ণ

আন্দরকিল্লার সাথে জড়িয়ে আছে মোঘলদের চট্টগ্রাম বিজয়ের ইতিহাস। একসময় এই কিল্লা বা কেল্লা ছিল মগ ও পর্তুগিজ জলদস্যুদের আস্তানা। ১৬৬৬ খ্রিস্টাব্দে নবাব শায়েস্তা খাঁ’র সন্তান উমেদ খা মগ ও পর্তুগিজ জলদস্যুদের পরাজিত করে কেল্লার অন্দরে বা ভিতরে প্রবেশ করে। আর সেই থেকেই এই কিল্লার নাম হয় আন্দরকিল্লা।

চট্টগ্রাম বিজয়ের স্মৃতি ধরে রাখতে সম্রাট আওরঙ্গজেবের নির্দেশে শায়েস্তা খাঁ এখানে ১৬৬৭ সালে নির্মাণ করেন আন্দরকিল্লা শাহী জামে মসজিদ। মসজিদটির পাশ ঘিরে গড়ে ওঠা প্রাচীন এই জনপদটি এখন চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের ৩২ নম্বর ওয়ার্ড। এটি এখন নগরব্যাপি পরিচিত বই পাড়া হিসেবে। আন্দরকিল্লাতে গেলে মিলবে না এমন বই নেই বললেও চলে। অন্যদিকে বই পাড়া খ্যাত এই আন্দরকিল্লার চারপাশে যেমন রয়েছে বইয়ের দোকান তেমনি ছাপাখানাও।
শুধু কি বই, প্রাচীনতম এই জনপদটিতে রয়েছে নগরীর গুরত্বপূর্ণ সব স্থাপনা। চট্টগ্রাম আদালত, চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসকের কার্যালয়, চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয়, চট্টগ্রাম জেলা পরিষদসহ অনেক গুরুত্বপূর্ণ সরকারি দপ্তর রয়েছে এই ওয়ার্ডে। আছে ঐতিহ্যবাহী লালদিঘীর মাঠ, আমনাত শাহ ও বদর আউলিয়ার মাজার। এমনকি চট্টগ্রামের কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার ও কেন্দ্রীয় কারাগারটিও এই ওয়ার্ডেরই অন্তর্ভুক্ত। বিনোদনের জন্য রয়েছে থিয়েটার ইনস্টিটিউট ও সিনেমা প্যালেস।

ওয়ার্ডটি শুধু যে সরকারি কার্যালয় আর ঐতিহ্যবাহী স্থাপনার জন্য সমধিক পরিচিত তা কিন্তু নয়। ওয়ার্ডটিতে হাজারী গলি নামে যে এলাকাটি আছে সেটিরও পরিচিতি রয়েছে নগরজুড়ে। এটাকে ফার্মেসি গলি ও জুয়েলারি পাড়াও বলা হয়।
এক বর্গকিলোমিটারেরও কম আয়তনের এই ওয়ার্ডটি প্রশাসনের খাতায় জায়গা করে নিয়েছে নগরীর সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ ওয়ার্ড হিসেবে। এতসব সরকারি দপ্তর যেখানে রয়েছে তার নিরাপত্তায় ১৯২২ সালে এখানে গড়ে তোলা হয় কোতোয়ালী থানা। প্রায় শত বছরের পুরনো এই থানাটি যেমন সাজানো হয়েছে নতুন আঙ্গিকে তেমনি সরকারি দপ্তরগুলোও। কিন্তু এত আলোর মাঝেও আলোকিত হয়নি আনন্দরকিল্লার অলিগলিগুলো। অন্ধকারে অলিগলির পথ খুঁজতে এখানকার স্থানীয়দের সমস্যা হলেও ফুটপাতে সে কষ্ট করতে হয় না তাদের। কারণ, ফুটপাতগুলো দখলে নিয়ে দোকান বসিয়েছে হকাররা। সে দোকানের আলোয় সন্ধ্যা থেকেই আলোকিত থাকে ফুটপাত। তবে সড়ক আলোকিত হলেও হাঁটার অধিকার হারায় পথচারীরা।

শুধু যে রাতেই হকারদের উৎপাত বাড়ে তা কিন্তু নয়, সকাল থেকেই ফুটপাত দখলে নেয়ার প্রতিযোগিতায় নামে হকাররা। খোদ কোতোয়ালী থানার সামনেই চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের ফুটপাতটি দখলে নিতে দেখা যায় হকারদের। যার বিস্তার ছড়িয়েছে চট্টগ্রাম আদালত গেট পর্যন্ত। হকারদের উৎপাতই এই ওয়ার্ডের প্রধান ও অন্যতম সমস্যা। পাশাপাশি স্থানীয়দের অভিযোগ ছিল আর্বজনা অপসারণে গাফিলতি ও সরু সড়ক নিয়ে।
মো. নাসির নামে এলাকার এক বাসিন্দা পূর্বকোণকে বলেন, ‘এলাকার রাস্তাগুলো খুবই সরু। ফলে দুটি গাড়ি পাশাপাশি যেতে পারে না। এছাড়া সব জায়গায় ময়লা-আবর্জনা ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকে। ঠিকমতো আবর্জনা অপসারণ করা হয় না, যার কারণে পুরো ওয়ার্ড অপরিচ্ছন্ন হয়ে থাকে’।
মো. আলমগীর ইসলাম নামে আরও এক বাসিন্দা বলেন, ‘এই ওয়ার্ডে ২টি মাজার আছে কিন্তু এর আশেপাশে প্রচুর আবর্জনা থাকে। বর্তমান কাউন্সিলর এই বিষয়ে কোনো পদক্ষেপ নেননি। বদরপাতি কাঁচাবাজারের ময়লা-আবর্জনার কারণে আমাদের খুবই সমস্যায় পড়তে হয়। এই বাজারের সংস্কার প্রয়োজন। আর আনসার ক্লাবের মোড়ে সবসময় যানজট লেগেই থাকে। একটা ট্রাক আসলে পুরো রোডে জ্যাম লেগে যায়। আর সড়কবাতির অভাবে সন্ধ্যার পর সম্পূর্ণ এলাকা অন্ধকার হয়ে থাকে, ফলে আমাদের চলাচল করতেও অসুবিধায় পড়তে হয়। ভবিষ্যৎ কাউন্সিলরের কাছে আমার আশা থাকবে তিনি যাতে আমাদের এই সমস্যাগুলোর সমাধান করেন’।

ফুটপাতে হকারদের রাজত্বের মেয়াদ আর কত কাল এমনই প্রশ্ন রেখেছিলাম এই ওয়ার্ডের বর্তমান কাউন্সিলর জহর লাল হাজারীর কাছে। পাশাপাশি প্রশ্ন ছিল আলোকবাতির অভাব ও আবর্জনা অপসারণে ঘাটতির কারণ নিয়েও। উত্তরে তিনি বলেন, ‘কখনো কোনো হকারকে আমি ফুটপাত দখলে সমর্থন দেই নি। আমরা প্রতিনিয়ত প্রশাসনের সাথে এই বিষয়ে যোগাযোগ রাখি। কোনো না কোনো জায়গায় আমরা প্রতিদিন হকার উচ্ছেদ করি। তারপরও হকাররা চলে আসে। তবে আমাদের এই উচ্ছেদ কার্যক্রম চলমান থাকবে’।
এলাকাবাসীর অভিযোগ ছিল অপর্যাপ্ত সড়কবাতি নিয়ে। এই বিষয়ে তার ভূমিকা সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘অনেক বাতি আছে যা যান্ত্রিক গোলযোগের কারণে অকেজো হয়ে আছে। বর্তমানে ১১শ’ টি সড়ক বাতি আছে ওয়ার্ডে। তবে ভবিষ্যতে সিটি কর্পোরেশনের অর্থায়নে প্রত্যেক অলি-গলিতে এলইডি বাল্ব স্থাপন করার পরিকল্পনা রয়েছে’।
মাদকের প্রভাব রয়েছে এই ওয়ার্ডে। এমন অভিযোগের ভিত্তিতে তাকে প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, ‘মাদকের বিরুদ্ধে আমার জিরো টলারেন্স পলিসি রয়েছে এবং এই বিষয়ে আমরা কমিনিউটি পুলিশের সাহায্য পাচ্ছি। আমার ওয়ার্ডে নির্দিষ্ট কোনো এলাকায় মাদক পাওয়া যায় না। তবে বাণিজ্যিক ওয়ার্ড হওয়ার কারণে অনেক ভাসমান মানুষ এখানে থাকে বলে কিছুটা মাদক থাকলেও পুলিশের চোখকে তারা ফাঁকি দিতে পারে না’।
সংকীর্ণ সড়ক প্রশস্ত করার কোনো পরিকল্পনা আছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘সড়ক সংকীর্ণ হওয়ার চেয়ে বড় সমস্যা হলো যত্রতত্র গাড়ি পার্কিং। যেগুলো বিভিন্ন সময় ট্রাফিকের মাধ্যমে আমরা সরিয়ে থাকি। পার্কিং থাকলে এই সমস্যা অনেকটাই কমে আসবে বলে আমি মনে করি’।
এছাড়াও গত ৫ বছরে ওয়ার্ডের উন্নয়নে ৫০ কোটি টাকার কাজ করেছেন বলে জানিয়েছেন তিনি। তিনি বলেন, ‘সিটি কর্পোরেশন থেকে যে বরাদ্দ আমি পেয়েছি তার মধ্যে ৫০ কোটি টাকার কাজ আমি শেষ করেছি। যার মধ্যে রয়েছে, ২.৫ কোটি টাকা ব্যয়ে বদর পুকুর সংস্কার, ১০টি প্রধান ও ৫ টি ছোট সড়কের সংস্কার কাজ এবং লালদিঘির পাড়ে স্মৃতি সৌধ নির্মাণ কাজ করেছি’।
এই ওয়ার্ডে বিভিন্ন দপ্তর বা মাধ্যমে আরও শতকোটি টাকার কাজ চলমান আছে বলে জানান তিনি। তিনি বলেন, ‘শতকোটি টাকার কাজ চলমান রয়েছে। আর এই চলমান কাজের মধ্যে রয়েছে, সিটি কর্পোরেশনের সেবকদের জন্য ৩ টি ভবন নির্মাণের কাজ। এছাড়াও ৫টি সড়ক ও ৫টি ড্রেনের কাজ এবং ২ কোটি টাকা বরাদ্দে লালদিঘির মাঠের আধুনিকায়ন কাজ’।

অন্যদিকে খুব শীঘ্রই ২০ কোটি টাকা ব্যয়ে মুসলিম উচ্চ বিদ্যালয়, সিটি কর্পোরেশন মেনেকা বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়, মুসলিম এডুকেশন সোসাইটি এবং এম. ওয়াই. উচ্চ বিদ্যালয়ের সংস্কার কাজ শুরু হওয়ার পাশাপাশি ডিসি’র মাধ্যমে এসি দত্ত লেনে একটি ভূমি অফিস নির্মাণের ইচ্ছা পোষণ করেন তিনি।
তিনি আরও বলেন, ‘শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল মহোদয়ের মাধ্যমে কদম মোবারক প্রাথমিক বিদ্যালয় ও কদম মোবারক উচ্চ বিদ্যালয়ের ৬ তলা নতুন ভবন এবং সিডিএর অর্থায়নে কোর্টবিল্ডিং এলাকায় স্মৃতি সৌধ নির্মাণ করেছি’।
ওয়ার্ডের উন্নয়নে নিজেকে ৮৫ ভাগ সফল দাবি করেছেন এই কাউন্সিলর। আগামী সিটি নির্বাচনে এই ওয়ার্ডে আওয়ামী লীগের সমর্থিত প্রার্থী হিসেবে লড়বেন তিনি।

অন্যদিকে তার বিপক্ষে লড়বেন বিএনপির সমর্থিত প্রার্থী বদরপাতি ইউনিট বিএনপির সাবেক সভাপতি নূর মোহাম্মদ লেদু। বিএনপি থেকে দলীয় সমর্থন পাওয়ায় প্রথমবারের মত কাউন্সিলর পদে লড়তে যাচ্ছেন তিনি। নির্বাচনকে সামনে রেখে এলাকাবাসীর সার্বিক উন্নয়নে তিনি ৪টি বিষয়ের উপর জোর দিয়েছেন। এগুলো হলো- এলাকা থেকে মাদক, সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ নির্মূল, মশার উপদ্রব কমাতে নিয়মিত নালা-নর্দমা ও সময় মতো আবর্জনা অপসারণ, সড়কে পর্যাপ্ত আলোকবাতির ব্যবস্থা করা, ফুটপাত দখলমুক্ত করতে প্রশাসনকে সাথে নিয়ে কাজ করার কথা জানিয়েছেন তিনি। এছাড়া মাদক থেকে যুবসমাজকে রক্ষা করতে নিজ উদ্যোগে বিভিন্ন ক্রীড়া প্রতিযোগিতার আয়োজন করার আশা ব্যক্ত করেছেন তিনি।
এই ওয়ার্ডে আরও মনোনয়ন জমা দিয়েছেন সুজিত সরকার, মো. হাবিব উল্লাহ, মোহাম্মদ নোমান লিটন ও এ কে এম জাবেদুল আলম।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট