বিনিয়োগের টাকা দ্বিগুণ হবে পাঁচ মাসেই। এমনকি মিলতে পারে পাঁচগুণ লাভও। এমএলএম ব্যবসায় বিনিয়োগের বিনিময়ে আকর্ষণীয় মুনাফা লাভের এমন প্রতিশ্রুতি দিয়ে আড়াই সহস্রাধিক নিরীহ মানুষের কাছ থেকে ১৮ বছরে কমপক্ষে ১৫ কোটি টাকা গ্রহণ করেন রাঙামাটির পুলিশ সদস্য টারজান খীসা। লাভ তো থাক দূরের কথা, একটি কানা-কড়িও ফেরত পাননি গ্রাহকরা। সব টাকা নিজের একাধিক ব্যাংক একাউন্টে স্থানান্তর করেন সাবেক এ পুলিশ সদস্য। টাকা হাতিয়ে এক পর্যায়ে লাপাত্তা হয়ে যান পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির সভাপতি জোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমার (সন্তু লারমা) সাবেক এ নিরাপত্তারক্ষী। এদিকে, সরকারি কর্মচারী হওয়া সত্ত্বেও বরখাস্ত হওয়া পুলিশ সদস্য টারজান খীসার বিরুদ্ধে এমএলএম ব্যবসার নামে বিভিন্ন গ্রাহকের ১৫ কোটি টাকারও বেশি অর্থ হাতিয়ে নেওয়ার প্রমাণ মিলেছে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) অনুসন্ধানে। কমিশন এ বিষয়ে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য ইতোমধ্যে নির্দেশ দিয়েছেন। যে কোন সময় পুলিশের সাবেক এ সদস্যের বিরুদ্ধে মামলা হতে পারে বলেও দুদকের বিশ্বস্ত সূত্র নিশ্চিত করেছে।
দুদক সূত্রে জানা যায়, রাঙামাটি সদরের কল্যাণপুরের যতীন প্রকাশ খীসার ছেলে টারজান খীসা পুলিশে কর্মরত থাকা অবস্থায় রাঙামাটি শহরের বনরূপার সবজি বাজারে একটি অফিস চালু করেন। সেখানে মাল্টিলেভেল মার্কেটিং (এমএলএম) ব্যবসা চালু করলে সাধারণ মানুষ ২০ হাজার থেকে সর্বোচ্চ ২০ লাখ টাকা পর্যন্ত বিভিন্ন গ্রাহক বিনিয়োগ করেন। আদায়কৃত এসব অর্থ তার ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান মেসার্স রিবেং এন্টারপ্রাইজ (এমএলএম) প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগ করেছেন। কিন্তু বিনিয়োগকৃত কোন টাকা ফেরত প্রদান করেননি। গ্রাহকদের নিকট হতে বিনিয়োগের টাকা গ্রহণের সময় কোন রশিদ বা ডকুমেন্ট প্রদানও করেননি। কেবলমাত্র ‘বিটমানিগ্লোবাল ডট নেট’ নামক একটি ওয়েবসাইটে সংশ্লিষ্ট গ্রাহকের হিসাব প্রদর্শিত হয়েছিল বলে সাধারণ গ্রাহককে বুঝ দিতেন।
দুদকের অনুসন্ধানে ওঠে আসে, গ্রাহকদের থেকে অর্থ গ্রহণ করলেও টারজান খীসা সবগুলো অর্থই নিজের নামে খোলা বিভিন্ন ব্যাংকের ২৩টি একাউন্টে জমা করেন। এরমধ্যে ডাচ বাংলা ব্যাংকে ১৭টি, ইসলামী ব্যাংকে ৩টি, আইএফআইসি ব্যাংকে ২টি এবং ব্র্যাক ব্যাংকের ১ টি একাউন্ট খোলা হয়। যাতে ২০০৯ সাল থেকে ২০১৭ সালের অক্টোবর পর্যন্ত সাড়ে ১৫ কোটি টাকার লেনদেন করেন পুলিশের এ সদস্য। এরমধ্যে ইসলামী ব্যাংকের রাঙামাটি শাখায় একটিতে ৯ কোটি ১৩ লাখ টাকা ও অন্যটিতে ১২ লাখ ৭৬ হাজার টাকা, আইএফআইসি ব্যাংকের রাঙামাটি শাখার একটি একাউন্টে ৪ লাখ ৬৯ হাজার টাকা, ডাচ বাংলা ব্যাংক ওআর নিজাম রোড শাখার খোলা ৯টি একাউন্টে যথাক্রমে ১৪ লাখ ৬৭ হাজার টাকা, ৯৫ লাখ ৮০ হাজার, ১ লাখ ২ হাজার, ৮৭ হাজার ৬ টাকা, ৩৮ লাখ ৫০ হাজার টাকা, ৬৩ হাজার ৪৬৫ টাকা, ১ লাখ টাকা, ৩ লাখ টাকা, ৫ লাখ টাকা এবং মেসার্স রিবেং এন্টারপ্রাইজের নামে একই ব্যাংকে খোলা ৮টি একাউন্টে যথাক্রমে ১০ লাখ ৫০ হাজার টাকা, ৯ হাজার ৫২৫ টাকা, ৮০ লাখ ৭২ হাজার টাকা, ৮৩ লাখ ৮৮ হাজার, ২ কোটি ৯১ লাখ, ২৮ হাজার ৮৯ টাকা, ১ হাজার ৮ টাকা এবং ৮ লাখ ৭৮ টাকা লেনদেন করেন।
সূত্র জানায়, দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) সমন্বিত জেলা কার্যালয়, চট্টগ্রাম-২ এর উপ-পরিচালক মো. আতিকুল আলম ও সহকারী পরিচালক মো. নুরুল ইসলামের যৌথ অনুসন্ধানে ওঠে আসে, টারজান খীসা পুলিশ সদস্য (বরখাস্তকৃত) হয়ে সরকারি কর্মচারী হওয়া সত্ত্বেও অসৎ উদ্দেশ্যে নিজের প্রকৃত পরিচয় গোপন করে প্রতারণা ও জালিয়াতির মাধ্যমে ব্যবসায়ী পরিচয়ে ব্যাংকে হিসাব খোলা, লেনদেন করা এবং এলএমএম ব্যবসার নামে বিভিন্ন ব্যক্তির নিকট হতে পাঁচগুণ লাভের প্রলোভন দেখিয়ে ১৫ কোটি টাকারও বেশি অর্থ লেনদেন করে তা স্থানান্তর ও রূপান্তর করে আত্মসাৎ করেছেন। যা দুদক আইনে শাস্তিযোগ্য অপরাধ করেছেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দুদকের এক কর্মকর্তা জানান, ‘দুর্নীতি দমন কমিশন এ বিষয়ে টারজান খীসার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দিয়েছেন। ইতোমধ্যে এ সংক্রান্ত আদেশ দুদক চট্টগ্রাম কার্যালয়-২ এ এসে পৌঁছেছে। শীঘ্রই তার বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’
পূর্বকোণ/পিআর