চট্টগ্রাম রবিবার, ২৮ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

কুম্ভমেলা : হরিদ্বার থেকে ঋষিধাম

নিজস্ব প্রতিবেদক

২৪ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ | ৮:৪০ অপরাহ্ণ

রাস্তাঘাটে গাড়ির তীব্র জটলা। মানুষের চাপ আর স্রোতে অচল হয়ে পড়েছে যানবাহন। মানুষের স্রোতে ঘা ভাসিয়ে সিঁড়ি বেয়ে পাহাড় পাদদেশে উঠতেই সুদৃশ্য ঋষিধাম মন্দির। কুম্ভমেলা উপলক্ষে এই ঋষিধামে ঋষি-মুনি, সাধু-সন্ন্যাসী, বৈঞ্চব ও পুণ্যার্থীদের মহামিলনমেলা বসেছে। এমন দৃশ্য দেখা যায় বাঁশখালীর ঋষিকুম্ভমেলায়।

 

ভারতের আদলে বাংলাদেশে একমাত্র কুম্ভমেলা হয় এই ঋষিধাম মন্দিরে। তিন বছর অন্তর বসে এই কুম্ভমেলা। দেশ-বিদেশ থেকে হাজার হাজার সনাতনী ধর্মাবলম্বীরা পুণ্য অর্জনের আশায় ছুটে আসেন বাঁশখালীর ঋষিধাম মন্দিরে।

 

মন্দির প্রতিষ্ঠাতা : বাঁশখালী উপজেলার সাধনপুর ইউনিয়নে বাণীগ্রামে জন্মগ্রহণ করেন স্বামী অদ্বৈতানন্দ পুরী মহারাজ। তাঁর পিতার নাম প্রতাপ চন্দ্র মিত্র চৌধুরী ও মাতার নাম সচীরাণী। মাতা-পিতা ও পুত্র পরিবারের সবাই ছিলেন ধার্মিক ব্যক্তি। স্বামী অদ্বৈতানন্দ পুরী মহারাজ তিনি ভগবৎ সাধনায় আত্মনিয়োগ করেন। গুরুদেব স্বামী জগদানন্দ পুরী মহারাজের নির্দেশনায় জঙ্গল কোকদণ্ডী গ্রামে গড়ে তুলেন এই ঋষিধাম মন্দির। ১৯৪৮ সালে নিরিবিলি-নির্জন ও জনকোহালমুক্ত মনোরম প্রাকৃতিক পরিবেশে ১৫ একর জায়গাজুড়ে নির্মিত হয় ঋষিধাম মন্দির। কালের পরিক্রময়ায় মন্দিরের খ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছে দেশ-বিদেশে।

 

মন্দিরের মূল ফটকে রয়েছে শিব মন্দির। তার পাশেই ভৈরব মন্দির, ধ্যান মন্দির, গঙ্গাস্নানের জন্য ঘাট, সাধু-সন্ন্যাসীদের ধ্যান-সাধর জন্য ধ্যানঘর, অতিথিদের জন্য বিশ্রামাগার ও প্রসাদকেন্দ্র। মন্দির প্রতিষ্ঠাতা স্বামী অদ্বৈতানন্দ পুরী মহারাজের আশীর্বাদ ও তুলশীধামের মোহন্ত স্বামী সুদর্শনানন্দ পুরী মহারাজের সান্নিধ্য এবং পুণ্য লাভের আশায় লক্ষ লক্ষ পুণ্যার্থী-ভক্ত দেশ-বিদেশ থেকে ছুটে আসেন এই মন্দিরে।

 

ঋষিকুম্ভমেলা : স্বামী অদ্বৈতানন্দ পুরী মহারাজ উপমহাদেশের সনাতনী সম্প্রদায়ের পরম পূজনীয় গুরু। শিব কল্পতরু স্বামী অদ্বৈতানন্দ পুরী মহারাজ আর আরাধ্য গুরুদেব জগদানন্দপুরী মহারাজের কৃপা লাভ করে পূর্ণকুম্ভের অধিকারী হয়ে বাঁশখালীর ঋষিধামে ভক্ত-পুণ্যার্থীদের দর্শনে ঋষিকুম্ভ প্রবর্তন করেন ১৯৫৭ সালে। কুম্ভমেলা হয় ভারতের চারটি স্থানে। সেখানে গিয়ে তীর্থ করতে অক্ষম সনাতনী ধর্মাবলম্বীদের কথা চিন্তা করে ঋষিধামে কুম্ভমেলার প্রবর্তন করেন। মাঘ মাসের ত্রয়োদশী তিথিতে কুম্ভমেলা অনুষ্ঠিত হয়। ১৯৬৬ সালে স্বামী অদ্বৈতানন্দ পুরী মহারাজ দেহ ত্যাগ করেন। গত ২৭ জানুয়ারি থেকে ৬ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ১১ দিনব্যাপী ২১তম কুম্ভমেলা অনুষ্ঠিত হয়।

 

ঋষিধামের প্রধান পুরোহিত মোহন্ত মহারাজ স্বামী সুদর্শনানন্দ পুরী মহারাজ বলেন, ‘বাংলাদেশের বাঁশখালীর কালীপুরের কোকদণ্ডী গ্রামে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের মহাপুরুষ সাধক ঋষি অদ্বৈতানন্দ পুরী মহারাজ পরম পুণ্যপীঠ ঋষিধামে কুম্ভমেলার সূচনা করেন। ঋষিধামের নামের সাথে সঙ্গতি রেখেই যুগে যুগে ঋষিপুরুষের স্মরণ, মনন ও স্মৃতি বহনের মানসে এ মেলাকে (ঋষিকুম্ভ) নামকরণ করা হয়েছে।

 

কুম্ভমেলার ইতিবৃত্ত : পুরাণ মতে, কুম্ভ শব্দের অর্থ অমৃতের পাত্র বা কলস। সমুদ্রমন্থনের সময় অমৃত ভরা একটি কুম্ভ আবিষ্কার করেন দেবতা ও রাক্ষসেরা। এই অমৃত নিয়ে অসুর আর দেবতারা নিজেদের মধ্যে ঝগড়া শুরু হলে নারায়ণ মোহিণী (অপূর্ব নারী মূর্তি) রূপ ধারণ করে আসেন। অমৃতকুম্ভ অসুরদের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য দেবরাজ ইন্দ্রপুত্র জয়ন্তকে নির্দেশ দিলেন, অমৃতকুম্ভ নিয়ে পালাতে। একটানা তিন দিন পর ছুটার পর ফিরে এক জায়গায় উপস্থিত হয়েছিলেন। এবং ফিরে এসেছিলেন বারো দিন পর। জয়ন্ত কুম্ভ নিয়ে পালানোর সময় হরিদ্বার, প্রয়াগ, নাসিক ও উজ্জয়িনীতে অমৃতকুম্ভ নামিয়ে বিশ্রাম করেছিলেন। এসময় চার ফোঁটা অমৃত পৃথিবীতে পড়েছিল। অমৃতপূর্ণ কুম্ভের নাম হতেই চার জায়গায় কুম্ভমেলার প্রচলন হয়।

 

গঙ্গা-যমুনা-সরস্বতী এই তিন নদীর ত্রিবেণী সঙ্গমে পুণ্যতিথিতে শাহীস্নান ও নাগা সাধুসহ সাধুসন্তদের মিলনমেলা হয়। উপমহাদেশের সনাতনীরা আধ্যাত্মিক দিব্যসম্পর্শ লাভ করেন। সেই কুম্ভমেলা অনুকরণে বাঁশখালীতে শ্রীমৎ স্বামী অদ্বৈতানন্দ পুরী মহারাজ ঋষিকুম্ভ মেলার আয়োজন করেন।

 

গঙ্গার আদলে পুণ্যস্নান : ভারতে কুম্ভমেলা হয় গঙ্গাপাড়ে। পুণ্য লাভের আশায় গঙ্গাস্নান করেন পুণ্যার্থীরা। সনাতনী শাস্ত্রে বলা হয়েছে, ‘কুম্ভযোগে হরিদ্বারে ত্রিদিবস স্নান করলে যে মহৎ ফল লাভ হয়, সে ফল সহস্র অশ্বমেধ যজ্ঞ করলেও লাভ হয় না।’ ঋষিধামে গঙ্গার আদলের দিঘি বা পুকুর খনন করে গঙ্গাস্নানের ব্যবস্থা করেন স্বামী অদ্বৈতানন্দ পুরী মহারাজ। কিংবদন্তী রয়েছে, গঙ্গা অববাহিকা থেকে পূর্ণতিথিতে গঙ্গার পানি এনে পুকুরের পানি গঙ্গার আদলে পবিত্র করেন মহারাজ। সেই থেকে গঙ্গার আদলে পবিত্র স্নান হয় এখানে।

 

গঙ্গা আরতি : প্রতি কুম্ভে গঙ্গার আদলে এই মন্দিরে গঙ্গা আরতি করা হয়। এবারের কুম্ভমেলায় গঙ্গা আরতিতে ৫১ হাজার মঙ্গল প্রদীপ প্রজ্জলন করা হয় বলে জানান কুম্ভমেলা উদযাপন পরিষদের সভাপতি সুকুমার চৌধুরী।

 

কুম্ভমেলার আবহ: সম্প্রতি কুম্ভমেলায় দেখা যায়, হাজার হাজার ভক্ত, সাধু-সন্ন্যাসী ও বৈঞ্চবেরা ধ্যান-সাধনা, গুরু ভক্তিদের মগ্ন রয়েছে। অতিথিশালায় দলবেঁধে অস্থায়ী আখড়া গেড়েছেন দূর-দূরান্ত থেকে আসা সাধু-সন্ন্যাসী ও ভক্তরা। ১১ দিনের প্রস্তুতি নিয়ে এসেছেন অনেকেই। ধর্মীয় আলোচনা ছাড়াও গুরু ভক্তি, প্রণাম-প্রণামী দিচ্ছেন ভক্তরা। চলছে পূজা-অর্চনা, ধর্মীয় আলোচনা ও প্রসাদ আস্বাদন। দেশ-বিদেশের সাধু-সন্ন্যাসী ও ভক্তদের থাকা-খাওয়া এবং অবস্থানের জন্য মাঠে মাঠে টাঙানো হয় ত্রিপল। ঋষি ধ্বজা উত্তোলন, বেদমন্ত্র পাঠ, মঙ্গলপ্রদীপ প্রজ্বলন, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানসহ নানা আয়োজনে সাজানো হয়। প্রতিদিনই ধর্মীয় আলোচনা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানসহ নানা আয়োজনে ভরা থাকে এই মেলা। হাজারো পুণ্যার্থীদের মহাসমাগমে পরিপূর্ণ হয়ে ওঠেছে ঋষিধামভ।

 

গ্রামীণ-লোকজমেলা : কুম্ভমেলা উপলক্ষে মন্দিরকে ঘিরে বসে গ্রামীণ লোজকমেলা। মেলায় বাঁশ-বেতের জিনিসপত্র, তৈষজপত্র, দা-বঁটি, হাতপাখা, শিশুদের খেলনা থেকে মণ্ডা-মিঠাই ও মিষ্টান্নসামগ্রীর নানা পসরা সাজিয়ে বসেন দোকানিরা। লোকজমেলায় সনাতনী ধর্মাবলম্বীরা ছুটে আসেন মেলায়। অন্যান্য ধর্মের লোকজনও ছুটে যান লোকজমেলায়।

 

 

পূর্বকোণ/জেইউ

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট