চট্টগ্রাম রবিবার, ২৮ এপ্রিল, ২০২৪

সুখ-দুঃখের বেড়িবাঁধ

নিজস্ব প্রতিবেদক

২৪ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ | ৮:১৭ অপরাহ্ণ

১৯৯১ সালের প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড়ে বাঁশখালীতে বেসরকারি হিসাবে প্রায় ৪০ হাজার মানুষ মারা যায়। আর জলোচ্ছ্বাসে তলিয়ে যায় হাজার হাজার ঘরবাড়ি ও কয়েক লাখ গবাদি পশু। উপকূলীয় বেড়িবাঁধ না থাকায় ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে জোয়ারের পানিতে দ্রুত লণ্ডভণ্ড হয়ে যায় বাঁশখালী। বিধ্বস্ত হয়ে যায় ১৯৬০ সালে নির্মিত ভঙ্গুর বেড়িবাঁধ।

 

সাঙ্গু নদীর মোহনা থেকে ছনুয়া পর্যন্ত সাত ইউনিয়ন হচ্ছে বঙ্গোপসাগর তীরবর্তী এলাকা। খানখানাবাদ, বাহারছড়া, কাথারিয়া, সরল, গণ্ডামারা, শেখেরখীর ও ছনুয়া ইউনিয়ন হচ্ছে সাগর লাগোয়া। এছাড়াও পুকুরিয়া, সাধনপুর ও খানখানাবাদ ইউনিয়ন হচ্ছে সাঙ্গু নদীর তীরবর্তী। বাঁশখালীর ১৪ ইউনিয়নের মধ্যে ১০ ইউনিয়ন হচ্ছে সাঙ্গু নদী তীরবর্তী ও বঙ্গোপসাগর উপকূলীয় এলাকা। আকাশে মেঘ দেখলেই উপকূলীয় বাসিন্দারা আতঙ্কে থাকেন।

 

পানি উন্নয়ন বোর্ড জানায়, বাঁশখালী উপকূলীয় এলাকা হচ্ছে ৩২ কিলোমিটার। বন্যা-ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাস থেকে উপকূলীয় এলাকার বাসিন্দাদের সুরক্ষায় এরমধ্যে ৯ দশমিক ৯ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ নির্মাণের উদ্যোগ নেয়া হয়। ২০১৬ সালে প্রকল্পের কাজ শুরু হয়। ২০১৮ সালে প্রকল্পটি শেষ হওয়ার কথা ছিল। কাজ শেষ না হলেও দফায় দফায় ফুলেফেঁপে ২০৯ কোটি টাকা থেকে প্রকল্পের ব্যয় বেড়ে ঠেকেছে ২৯৭ কোটি টাকায়। তবে প্রকল্প প্রায় শেষ পর্যায়ে।

 

বাঁশখালী আসনের সংসদ সদস্য মোস্তাফিজুর রহমান চৌধুরী বলেন, ‘উপকূলবাসীর জীবনমান রক্ষার জন্য প্রায় ৪শ কোটি টাকা ব্যয়ে বেড়িবাঁধ নির্মাণ করা হয়েছে। বাকি অংশেও স্থায়ী বাঁধ নির্মাণের ডিপিপি পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ে জমা দেওয়া হয়েছে।

 

পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী নাহিদ উজ জামান বলেন, ৩২ কিলোমিটার উপকূলীয় এলাকার মধ্যে প্রায় ১০ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ নির্মাণ করা হয়েছে। অবশিষ্ট ২৬ কিলোমিটার অংশে বাঁধ নির্মাণের জন্য নতুন প্রকল্প পানি উন্নয়ন বোর্ডে জমা দেওয়া হয়েছে। এরমধ্যে ১৩ কিলোমিটার অংশের অবস্থা খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ১১ ইউনিয়নের অন্তত ১০ লাখ মানুষ উপকৃত হবে।

নির্বাহী প্রকৌশলী নাহিদ-উজ-জামান বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সাগরের পানি উচ্চতা বেড়ে গেছে। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে পানির স্তর ৭ ফুট উচ্চতা ধরে টেকসই ও দীর্ঘস্থায়ী বাঁধ নির্মাণের প্রকল্প জমা দেওয়া হয়েছে। আগামী ৫০ বছরের পরিকল্পনা নিয়ে প্রকল্প প্রস্তুত করা হয়েছে।

 

পাউবো সূত্র জানান, বেড়িবাঁধ প্রকল্পের মধ্যে সাগর তীরের ৯ দশমিক ৯ কিলোমিটার এলাকায় বাঁধ ও ব্লক (প্রতিরক্ষা বাঁধ) ফেলা হয়েছে। এছাড়াও সাঙ্গু নদীর তীরে দুই কিলোমিটার বাঁধ পুনঃসংস্কার ও তিন দশমিক ৮৪৮ কিলোমিটার প্রতিরক্ষার কাজ করা হয়েছে।

 

অভিযোগ ছিল, নকশায় ত্রুটি, ঠিকাদার নিয়োগে অনিয়ম, নিম্নমানের কাজ, দুর্গম এলাকা ও উপ-ঠিকাদারিতে রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব-এই ৫ কারণে এখনো হাবুডুবু খাচ্ছে বাঁশখালী উপকূলীয় বাঁধ নির্মাণ প্রকল্প। টাস্কফোর্স কমিটি ও বুয়েটে পরীক্ষা-নিরীক্ষায় নিম্নমানের কাজের প্রমাণ পেয়েছিল। এজন্য বিপুল পরিমাণ ব্লক বাতিল করা হয়েছিল। ২০১৮ সালে প্রকল্পটি শেষ হওয়ার কথা ছিল। কাজ শেষ না হলেও দফায় দফায় ফুলেফেঁপে ওঠেছে প্রকল্পের ব্যয়। ২০৯ কোটি টাকা থেকে কয়েক দফায় বেড়ে ঠেকেছে ২৯৭ কোটি টাকায়।

 

শুধু তাই নয়, এই মেগাপ্রকল্পকে ঠেস দিতে সংস্কারের নামে ব্যয় হয় আরও কয়েক কোটি টাকা। জরুরি মেরামত বা সংস্কারের নামে ব্যয় বাড়ানো হয়। অভিযোগ রয়েছে, পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তা ও ঠিকাদারের যোগসাজশে অতিরিক্ত ব্যয় দেখিয়ে অর্থ নয়-ছয় করা হয়েছে।

ছনুয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. হারুন অর রশিদ বলেন, ‘ছোট ছনুয়া, বালুখালী, চেমদখালীর প্রায় ৪ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ এখনও অরক্ষিত। দুর্যোগ-মুহূর্তে বাঁধ ভেঙে লোকালয়ে পানি ঢোকার আশঙ্কা বেশি।’ তিনি বলেন, গত কয়েক বছর ধরে বাঁধ ভেঙে পানি ঢোকায় চাষাবাদেরও বিঘ্ন ঘটছে। বাঁধ নির্মাণ করা হলেও ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে ফসলি জমি, বসত বাড়িসহ কয়েক হাজার পরিবার।’

 

এলাকাবাসী জানান, মূল ঠিকাদার থেকে উপ-ঠিকাদারির মাধ্যমে প্রকল্পের কাজ শুরু হয়েছে। অনভিজ্ঞ ও রাজনৈতিক নেতাদের উপ-ঠিকাদারি বা উপকরণ সরবরাহের কাজ নিয়ন্ত্রণের কারণে প্রকল্পের কাজ শম্বুকগতিতে এগিয়েছে। এছাড়াও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধি ও পানি উন্নয়ন বোর্ডের প্রকৌশলীদের যোগসাজশে নিম্নমানের ব্লক নির্মাণ করা হচ্ছে। এরফলে বাঁধ ধসে যাচ্ছে। সরকারের বড় সাফল্য অনিয়মে ম্লান হচ্ছে।

সময় মতো কাজ শেষ না করা ও কাজের মান বজায় না রাখার অভিযোগে ১৬ ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানকে নতুন করে কাজ না দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। গত বছরের ১০ মার্চ পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপসচিব এ এইচ এম আনোয়ার পাশা এ বিষয়ে চিঠি পাঠিয়েছেন।
খানখানাবাদ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান জসিম উদ্দিন হায়দার বলেন, ‘খানখানাবাদ ইউনিয়নের প্রেমাশিয়া, কদম রসুল ও খানখানাবাদ এলাকার বেশ কিছু অংশে এখনো স্থায়ী বেড়িবাঁধ হয়নি। এখনো প্রায় ৩ কিলোমিটার অংশে বেড়িবাঁধ হয়নি। এছাড়াও নির্মিত বাঁধ ধসে পড়ায় বিশেষ সংস্কার করতে হবে। অন্যথায় বাঁধ আরও ধসে পড়ার শঙ্কা রয়েছে।’

 

সাধনপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান কে এম সালাহউদ্দিন কামাল বলেন, রাতা ও রাতাখোদ্দ, বৈলগাঁও এলাকায় বর্ষা মৌসুমে বাঁধ ভেঙে জোয়ারের পানি লোকালয়ে প্রবেশ করে। রাতাখোদ্দ এলাকায় ১ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ ভেঙে গেছে। তিনি বলেন, এই গ্রামে দুইটি সাইক্লোন শেল্টার, ২টি প্রাথমিক বিদ্যালয়, ৩টি মসজিদ, দেড় শতাধিক বসতবাড়ি, কয়েকশ একর ফসলি জমি নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। স্থায়ী বাঁধ নির্মাণ ছাড়া ভাঙন রক্ষার বিকল্প নেই।

 

পরিকল্পনা ও নকশা ত্রুটি : ২০১১-১২ সালে প্রকল্পের জরিপ করা হয়। ২০১৩ সালে বাঁধের নকশা চূড়ান্ত হয়। কিন্তু ২০১৬ সালে প্রকল্পের কাজ শুরু হয়। জরিপ ও নকশা প্রণয়নের সময়ে পানির রিডিউস লেভেল ধরে (পানির চেয়ে সমতল ভূমি) নকশা ও প্রকল্পের ব্যয় নির্ধারণ করা হয়েছে। নদী ও সাগরের গতিপথ পরিবর্তনে পানির স্তর বেড়ে যায়। এজন্য প্রকল্পের কাজ করতে গিয়ে ডিজাইন পরিবর্তন করতে হয়েছে।

 

লেখক : নিজস্ব প্রতিবেদক, দৈনিক পূর্বকোণ

 

 

পূর্বকোণ/জেইউ

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট