চট্টগ্রাম শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

পরিবেশবান্ধব শিল্পাঞ্চল কোরিয়ান ইপিজেড

নিজস্ব প্রতিবেদক

১৯ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ | ১:২১ অপরাহ্ণ

চট্টগ্রাম শাহ আমানত সেতু পার হয়ে আনোয়ারা-বাঁশখালী সড়ক ধরে ১৫ কিলোমিটার ডানে কোরিয়ান এক্সপোর্ট প্রসেসিং জোন (কেইপিজেড)। পুরো এলাকাটি প্রকৃতি তার নিজের খেয়ালে সাজিয়েছে। চারদিকে সবুজের সমারোহ, রাস্তার দুই পাশে ছোট ছোট টিলা, নানা জাতের গাছের সারি। এভাবেই বন-বনানীর সবুজ শ্যামলিমায় গড়ে উঠেছে দেশের একমাত্র বেসরকারি রপ্তানি প্রক্রিয়াজাতকরণ অঞ্চল কেইপিজেড।

 

১৯৯৬ সালে দক্ষিণ কোরিয়ার ব্যবসা সফল কোম্পানি ইয়ংওয়ান কর্পোরেশন লিমিটেডকে বাংলাদেশে একটি বেসরকারি ইপিজেড প্রতিষ্ঠার অনুমোদন দেওয়া হয়। এই প্রেক্ষিতে ইয়ংওয়ান এর অধীনস্থ কোরিয়ান ইপিজেড কর্পোরেশন (বিডি) লিমিটেড এই বেসরকারি ইপিজেড স্থাপনের মাধ্যমে কার্যক্রম পরিচালনা করছে। ১৯৯৬ সালে কেইপিজেড এর আবেদনের প্রেক্ষিতে আনোয়ারা উপজেলায় প্রায় ২৫০০ একর জমি হুকুম দখল করে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন, যার বেশির ভাগই খাসজমি। ১৯৯৯ সালের অক্টোবরে তৎকালীন ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই প্রকল্পের উদ্বোধন করেন।

 

শুরুতে এই এলাকাটি ছিল জঙ্গলাকীর্ণ। কিন্তু কেইপিজেড কর্তৃপক্ষের প্রচেষ্টায় সবুজ প্রকৃতির মাঝে পরিকল্পিত এক শিল্প-এলাকায় পরিণত হয়েছে। এখানে একটি শান্ত, সুনিবিড় এলাকার আমেজ খুঁজে পাওয়া যায়। বর্তমানে একে পরিবেশবান্ধব অঞ্চলে রূপান্তর করতে নানা পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে। পরিবেশ সংরক্ষণে সরকারের বেঁধে দেয়া শর্ত অনুযায়ী অর্ধেকের বেশি জমি ছেড়ে দিয়ে কেইপিজেডে বিভিন্ন অবকাঠামো নির্মাণকাজ করা হচ্ছে। ৪৩টি শিল্পকারখানার মধ্যে ৪০টি কারখানায় উৎপাদন শুরু হয়েছে যেখানে ২৬ হাজারের বেশি স্থানীয় শ্রমিকের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। মোট কর্মীর মধ্যে প্রায় ৭৫ শতাংশই নারী, যে কারণে পরিবার ও সমাজে নারীর মর্যাদা বেড়েছে। কেইপিজেড কর্মীরা বছরে প্রায় ২৫০ কোটি টাকার বেশি বেতন-বোনাস পান, এতে তাঁদের পরিবারে আর্থিক স্বচ্ছলতা এসেছে, পাশাপাশি পুরো এলাকার অর্থনৈতিক কর্মকা-ে প্রাণপ্রবাহ সৃষ্টি হয়েছে।

প্রকৃতি সংরক্ষণে কোরিয়ান ইপিজেড কর্তৃপক্ষের নেয়া পদক্ষেপ

পরিবেশ অধিদপ্তরের দিকনির্দেশনা অনুযায়ী কেইপিজেড কর্তৃপক্ষ উন্নয়ন-কার্যক্রম পরিচালনা করছে। একে আন্তর্জাতিক মানের পরিবেশবান্ধব এলাকা হিসেবে গড়ে তোলার লক্ষ্যে সরকারি নির্দেশনা অনুযায়ী সম্পূর্ণ জোনের ৫২ শতাংশ জায়গায় সবুজায়ন ও জলাধার তৈরির কাজ সম্পন্ন করা হয়েছে। বাকি ৪৮ শতাংশ জায়গায় শিল্প প্লটসহ অন্যান্য অবকাঠামো নির্মাণের কাজ চলমান রয়েছে। কেইপিজেড কর্তৃপক্ষের প্রচেষ্টায় এই এলাকাটি গ্রিন জোনে পরিণত হয়েছে যেখানে নানা প্রজাতির জীবজন্তু অবাধে বিচরণ করতে পারে।

 

২০০৯ সালের নভেম্বরে পরিবেশ ছাড়পত্র (ইসিসি) পাওয়ার পর পুরো অঞ্চলটিকে পরিবেশবান্ধব শিল্প জোনে রূপান্তর করার উদ্যোগ নেয় কেইপিজেড কর্তৃপক্ষ। এই লক্ষ্যে ইতোমধ্যে এখানে ২৫ লক্ষ গাছ রোপণ করা হয়েছে এবং ২৫টি জলাশয় তৈরি করা হয়েছে যেখানে ৫০০ মিলিয়ন গ্যালন বৃষ্টির পানি সংরক্ষিত থাকে। এতে উক্ত এলাকার পানির সংকট দূর হয়েছে। জলাশয়গুলোতে প্রায় ১৩৭ প্রজাতির পাখি বসবাস করে। বিভিন্ন প্রজাতির প্রাণিও রয়েছে। চট্টগ্রাম বিশ^বিদ্যালয়ের এক গবেষণায় কেইপিজেডে প্রায় ৪০০ এর অধিক প্রজাতির গাছপালা ও উদ্ভিদের সন্ধান পাওয়া গেছে। দুর্লভ প্রজাতির গাছপালা ও উদ্ভিদ রক্ষায় কেইপিজেডে একটি বোটানিক্যাল গার্ডেন গড়ে তোলার কাজ শুরু হবে।

আন্তর্জাতিক মানের অবকাঠামো

 

বিনিয়োগকারীদের চাহিদা অনুযায়ী কেইপিজেডে অবকাঠামোগত উন্নয়ন চলছে। কেইপিজেড জোন জুড়ে ৩৮ কিলোমিটার রাস্তা নির্মাণ করা, ১০০ একরের আইটি পার্ক, মানসম্মত এবং পরিবেশবান্ধব শিল্প-দালান তৈরি করা এবং সহযোগী শিল্পের জন্য আলাদা জায়গার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। ইতোমধ্যে ২৯ কিলোমিটার বৈদ্যুতিক লাইন স্থাপনের কাজ সম্পন্ন হওয়ার পাশাপাশি সাব-স্টেশনের মাধ্যমে বিদ্যুৎ-সঞ্চালন ব্যবস্থা চালু আছে। প্রায় ৭ কিলোমিটার গ্যাস-লাইন নেটওয়ার্ক স্থাপন করা হয়েছে। কেইপিজেড কর্তৃপক্ষ অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে প্রায় ৪০ মিলিয়ন ডলার ব্যয়ে ৪০ মেগাওয়াট ক্ষমতা সম্পন্ন সৌরবিদ্যুৎ-প্রকল্প স্থাপনের মাধ্যমে। এখানে দৈনিক ২২ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদিত হয়। নিজস্ব চাহিদা পূরণের পর উদ্বৃত্ত বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে সরবরাহ করা হয়। ছুটির দিনগুলোতে উৎপাদিত পুরো বিদুৎ জাতীয় গ্রিডে যুক্ত করা হয়। কেইপিজেডে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের জন্য দু’টি গেস্ট হাউজ নির্মাণ করা হয়েছে। কর্মচারীদের আবাসন সুবিধার জন্য ৯টি ডরমিটরির মধ্যে ৩টির কাজ শেষ হয়েছে। ১০টি ডিজাইন ডেভেলপমেন্ট সেন্টারের মধ্যে তিনটিতে শিল্পকারখানা চলমান রয়েছে, বাকিগুলোর নির্মাণকাজও প্রায় শেষ পর্যায়ে। এছাড়া ১০০ একর জমির ওপর আইটি জোন ছাড়াও একটি আইটি ডেভেলাপমেন্ট কমপ্লেক্স গড়ে তোলার কাজ শুরু হয়েছে। এই কমপ্লেক্সে ২০টি ২২ তলা বিশিষ্ট বিশেষায়িত আইটি ভবন নির্মাণ করা হবে যেখানে প্রায় ৩৬০ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ হবে বলে আশা করা হচ্ছে।

অপারেশন লাইসেন্স ও পরিবেশ ছাড়পত্র

জানা গেছে, কেইপিজেড কর্তৃপক্ষের অনুকূলে অপারেশন লাইসেন্স ও পরিবেশ ছাড়পত্র প্রদানে দীর্ঘ কয়েক বছর লেগে যায়। এছাড়া এখনো পর্যন্ত কেইপিজেড এর অনুকূলে বরাদ্দ করা জমির নামজারি সম্পন্ন হয়নি। কেইপিজেড কর্তৃপক্ষ জানায়, প্রকল্পের কাজ শুরু করার উদ্দেশ্যে কেইপিজেড কর্তৃপক্ষ ১৯৯৯ সালে অপারেশন লাইসেন্স এবং পরিবেশ ছাড়পত্রের জন্য আবেদন করে। প্রায় ৮ বছর অপেক্ষার পর ২০০৭ সালের ২৯ মে কেইপিজেডকে অপারেশনাল লাইসেন্স প্রদান করা হয়। এরপর পরিবেশ অধিদপ্তরের বিশেষজ্ঞ দল কেইপিজেড এর কার্যক্রম যাচাই-বাছাইয়ের পর ২০০৯ সালের নভেম্বরে পরিবেশ ছাড়পত্র প্রদান করে।

ভূমির উন্নয়ন ও ব্যবহার

কেইপিজেড এর জায়গাটি ছিল মূলত একটি পরিত্যক্ত টিলা ও বালুর ঢিবি এলাকা। এই প্রকল্পের মোট জমির পরিমাণ হলো প্রায় ২৪৯২ একর (১০০৮ হেক্টর)। পরিবেশ ছাড়পত্রের মুল শর্ত হলো মোট জমির ৫২ শতাংশ জমি অর্থাৎ প্রায় ১৩০০ একর জমি সবুজ ও উন্মুক্ত রাখতে হবে। এর মধ্যে ৩৩ শতাংশ জমিতে গাছ লাগিয়ে সবুজায়ন করতে হবে এবং ১৯ শতাংশ জমি উন্মুক্ত রাখতে হবে। উক্ত শর্তের উপর ভিত্তি করে কেইপিজেড কর্তৃপক্ষ প্রায় ৮২২ একর জমিতে গাছ লাগিয়েছে এবং প্রায় ৪৭৮ একর জমিতে লেক ও সবুজ মাঠ এর মাধ্যমে উন্মুক্ত রেখেছে। উক্ত সবুজ মাঠের একাংশে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের চাহিদা ও বিনোদনের জন্য একটি গলফ কোর্ট করা হয়েছে, যেখানে শুধুমাত্র বিদেশি বিনিয়োগকারীরা খেলাধুলা করেন। পরিবেশ ছাড়পত্রের শর্ত অনুযায়ী বাদবাকী ৪৮ শতাংশ বা ১২০০ একর জমিতে কেইপিজেড শিল্পায়ন, অবকাঠামোগত উন্নয়ন ও রাস্তাঘাট তৈরি করতে পারবে। সে অনুযায়ী ইতোমধ্যে ১১২০ একর জমির উন্নয়ন করেছে। বাদবাকী ৮০ একর জমি আগামী শুকনো মওসুমে প্রস্তুত করা হবে।

শিল্প, বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান

কেইপিজেড কর্তৃপক্ষ জানায়, এখানে বর্তমানে মোট ৪০টি ফ্যাক্টরি ইউনিট উৎপাদন করছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো, কর্ণফুলী সু ইন্ডস্ট্রিজ লিমিটেড, কর্ণফুলী গার্মেন্টস লিমিটেড, কর্ণফুলী পলিয়েস্টার প্রোডাক্ট, এভারটপ প্রোডাক্ট ডেভেলাপমেন্ট কোম্পানি লি., গায়া প্রোডাক্ট ডেভেলাপমেন্ট কোম্পানি লি., পেক্সার বাংলাদেশ লি.। এসব কারখানায় প্রায় ২৬ হাজার স্থানীয় কর্মী কাজ করছেন, এর প্রায় ৭৫ শতাংশ নারী শ্রমিক। এর ফলে এই এলাকার ব্যাপক অর্থনৈতিক উন্নতি সাধিত হয়েছে। এছাড়াও ইয়ংওয়ান কর্পোরেশানের অন্তর্ভুক্ত সাংনাম এপ্যারেলস (বিডি) লি., আলফা প্রোডাক্ট ডেভেলাপমেন্ট কোম্পানি, টেকউইন (বিডি) লিমিটেড, কোরিয়ান ইপিজেডে তাঁদের শিল্প ইউনিট স্থাপন করেছে। এছাড়া নির্ধারিত ১০০ একরের আইটি জোন ছাড়াও জোনের পশ্চিম অংশে টেকভিশন (বিডি) লিমিটেড নামীয় প্রতিষ্ঠানের অধীন একটি আইটি ডেভেলাপমেন্ট কমপ্লেক্স গড়ে তোলার লক্ষ্যে কাজ শুরু হয়েছে। এই কমপ্লেক্সটিতে ২০টি ২২ তলা বিশিষ্ট বিশেষায়িত আইটি ভবন নির্মাণ করা হবে, এতে প্রায় ৩৬০ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ হবে। অন্যান্য শিল্প প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি কেইপিজেডে আইটি পার্ক ও রিসার্চ সেন্টার প্রতিষ্ঠিত হলে টেকনলজি ট্ধসঢ়;্রান্সফারের মাধ্যমে দক্ষ জনশক্তি তৈরি হবে এবং এই প্রকল্পের সফল বাস্তবায়ন শেষে প্রতি মাসে প্রায় কয়েক মিলিয়ন ডলার মূল্যের পণ্য রপ্তানি করা সম্ভব হবে।

 

কেইপিজেড করপোরেশন (বিডি) লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক কর্নেল (অব.) মোহাম্মদ শাহজাহান বলেন, সর্বস্তরের সহযোগিতা অব্যাহত থাকলে কেইপিজেড-এ নতুন নতুন বিদেশি বিনিয়োগ আহ্বানের মাধ্যমে আধুনিক শিল্প প্রতিষ্ঠান স্থাপন করে আরো বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা আহরণের সম্ভাবনা সৃষ্টি হবে। অর্থনৈতিক কার্যক্রম বৃদ্ধির সঙ্গে এখানে একটি নতুন উপশহর সৃষ্টি হবে। কারিগরি সহায়তা এবং টেকনলজি ট্রান্সফারের মাধ্যমে স্থানীয় শিল্প সমৃদ্ধশালী হবে। সর্বোপরি কেইপিজেড একটি পরিবেশবান্ধব আদর্শ শিল্প অঞ্চল হিসাবে প্রতিষ্ঠা পাবে।

লেখক : নিজস্ব সংবাদদাতা, আনোয়ারা

পূর্বকোণ/পিআর 

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট