চট্টগ্রাম শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

পর্যটনের অপার সম্ভাবনা

মো. ফারুক ইসলাম

১৭ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ | ৭:০৫ অপরাহ্ণ

ইতিহাস ঐতিহ্যের ক্ষেত্রে চট্টগ্রাম দেশের কোনো জেলার চেয়ে পিছিয়ে নেই। এখানে রয়েছে বৃটিশবিরোধী আন্দোলনের অনেক সাহসী পুরুষ। রয়েছেন পীর আউলিয়ার আগমনের ইতিহাস। তেমনি ইতিহাস এবং ঐতিহ্যের একটা অংশ জুড়ে আছে শহরতলী নামে খ্যাত কর্ণফুলীর কূল ঘেঁষে গড়ে ওঠা বোয়ালখালী উপজেলা। এ উপজেলায় রয়েছে বিভিন্ন ধর্মীয় স্থাপনা এবং নানা দর্শনীয় স্থান। এসব দর্শনীয় ও তীর্থ স্থান দেখতে প্রতিদিন ছুটে আসছে লোকজন। পর্যটনের অপার সম্ভাবনাময় এই উপজেলাটি উন্নয়নের ক্ষেত্রে অনেকটা পিছিয়ে।

 

অধিকাংশ মানুষের অভিমত, একটি মাত্র ব্রিজের কারণে থমকে আছে বোয়ালখালীর উন্নয়ন। তবে এই উপজেলার পর্যটনকে বিকশিত করতে সাবেক সাংসদ মইন উদ্দিন খান বাদল তাঁর একটা স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে চেয়েছিলেন। তিনি কড়লডেঙ্গার তিন তীর্থ ভূমি হযরত বু-আলী কলন্দর শাহ’র (রা.) আস্তানা শরীফ, দুর্গাপূজার উৎপত্তিস্থল চণ্ডীতীর্থ মেধসমুনি আশ্রম ও বৌদ্ধদের আর্য কুঠির ভাবনা কেন্দ্রকে নিয়ে একটি লেক খনন করতে চেয়েছিলেন। তাঁর স্বপ্ন ছিলো উক্ত লেকে মুসলমানরা ওযু করে হযরত বু-আলী কলন্দর শাহ’র মাজার জেয়ারত করবেন, সনাতন ধর্মের লোকেরা লেকের পানিতে পূণ্য স্নান করবেন এবং বৌদ্ধ ধর্মের লোকেরা তাদের ধর্মীয় কাজে এই লেক ব্যবহার করবেন। এক কথায় একটিমাত্র লেকের মাধ্যমে তিন ধর্মের মানুষের মধ্যে দারুণ এক মেলবন্ধন রচনা করার স্বপ্ন ছিলো তাঁর। কিন্তু তা বাস্তবায়নের আগেই তিনি মৃত্যুবরণ করেন।

 

বর্তমানে ধর্মীয় স্থান ছাড়াও বোয়ালখালীর পূর্বাঞ্চলের কড়লডেঙ্গা, আমুচিয়া ও জ্যৈষ্ঠপুরার পাহাড়ি এলাকাকে ঘিরে পর্যটনের সম্ভাবনা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। কালুরঘাট ভাণ্ডালজুড়ি হয়ে জ্যৈষ্ঠপুরা থেকে রাঙ্গুনিয়ার সরফভাটা পর্যন্ত নির্মিত সড়কটিকে ঘিরে বোয়ালখালীতে বেড়েছে পর্যটকের আনাগোনা। সবুজ পাহাড়ের বুক চিরে নির্মিত এই সড়কের কারণে জ্যৈষ্ঠপুরার পাহাড়ি এলাকাকে এখন মিনি বান্দরবান বলা হয়। এখানকার পাহাড়ি ছড়া, মন ভোলানো প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখতে প্রতিদিন শতশত মানুষ ছুটে আসছেন। অপরদিকে, কর্ণফুলী নদীর পূর্ব প্রান্তে পশ্চিম কধুরখীলে গড়ে ওঠা মুক্তিযোদ্ধা রিভার ভিউ বোয়ালখালীর জনসাধারণ ছাড়াও দেশ-বিদেশের মানুষের কাছে বহুল পরিচিতি লাভ করেছে। এখান থেকে দাঁড়িয়ে বিকেলের অসাধারণ সূর্যাস্ত দেখা, নদীতে নৌকা ভ্রমণ করা, নদীর তীরে বসে পরিবার পরিজন নিয়ে সময় কাটাতে প্রতিদিন হাজার হাজার দর্শনার্থী ভিড় করেন এখানে। রিভার ভিউকে কেন্দ্র করে এখানে গড়ে ওঠেছে আকর্ষণীয় রেস্টুরেন্ট। এগুলোর মধ্যে ক্যাফে রিভার ভিউ, ক্যাফে ৭১ ও ঘরোয়া কার্নিভাল উল্লেখযোগ্য। এছাড়া শ্রীপুর ইউনিয়নের কর্ণফুলী নদীর বুকে জেগে উঠা নাজিরচর বোয়ালখালীর সবজির ভাণ্ডার হিসাবে পরিচিত। এই চরের সৌন্দর্য দেখতে প্রতিনিয়ত ভিড় করেন মানুষ।

 

বোয়ালখালীর ঐতিহ্যের আরেক ধারক ও বাহক শত বছরের পুরোনো শ্রীপুর বুড়া মসজিদের নাম শুনেননি এমন মানুষ খুব কমই আছেন। প্রতি শুক্রবার জুমার দিনে হাজার হাজার মুসল্লির আগমন ঘটে এখানে। এক কথায় নানা জেলার মানুষের সমাবেশ ঘটে মসজিদকে ঘিরে। বর্তমানে উপজেলার আমুচিয়া ইউনিয়নে গড়ে উঠা বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের তীর্থস্থান অর্হৎ মাহাসি সতিপট্ঠান মহারণ্য নজর কাড়ছে সকল ভ্রমণপিপাসু মানুষের। এই মহারণ্যে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে মহামুনি গৌতম বুদ্ধের জন্ম থেকে সিদ্ধি লাভ পর্যন্ত জীবনের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। সবুজ পাহাড়ের বুকে গড়ে ওঠা এই তীর্থস্থানটিতে দিন দিন মানুষের সমাগম বৃদ্ধি পাচ্ছে।

 

একই পথে রয়েছে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি বিজড়িত ঐতিহ্যবাহী সেনবাড়ি। যেখানে আশ্রয় নিয়ে বাংলার দামাল ছেলেরা দেশ মাতৃকাকে রক্ষায় পাক হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। সবুজ ও ছায়াঘেরা বাড়িটি দেখতে দূর-দূরান্ত থেকে লোকজন ছুটে আসেন। বোয়ালখালীর আহলা কড়লডেঙ্গা ইউনিয়নের বৈদ্যপাড়ার সার্বজনীন বিহারে রয়েছে বুদ্ধগয়া থেকে আনা গৌতম বুদ্ধের স্মৃতি বিজড়িত ঐতিহাসিক বোধিদ্রুম বৃক্ষের মূলশাখা। এটি ১৮৭৯ সালে রাধাচরণ মহাস্থবির বুদ্ধগয়া থেকে এনে বৈদ্যপাড়া সার্বজনীন বিহারে রোপণ করেন। এই বৃক্ষটি দর্শন করতে প্রতিদিন শত শত লোকজন আসেন। এছাড়া বিহারের সামনে স্থাপিত গৌতম বুদ্ধের অসাধারণ মূর্তিটি নজর কাড়ে সকল দর্শনার্থীর। উপজেলার পোপাদিয়া ইউনিয়নে রয়েছে ঐতিহ্যবাহী কালাচাঁদ ঠাকুর বাড়ি। সনাতন ধর্মাবলম্বীদের এই তীর্থস্থানের রয়েছে অনেক গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস। শিশুদের অন্নপ্রাসনের জন্য এখানে বহু মানুষের সমাগম ঘটে। জ্যৈষ্ঠপুরার শত বছরের সূর্যব্রত মেলার খ্যাতি দেশজুড়ে।

 

প্রতি বছর মাঘ মাসের শুক্লপক্ষের শেষ রবিবার সূর্যপূজা উপলক্ষে তিনদিন ব্যাপী আয়োজিত এই মেলায় মানুষের মিলন মেলা ঘটে। দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে মেলা দেখতে হাজার হাজার মানুষ ছুটে আসেন এখানে। ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান ছাড়াও এখানে রয়েছে কানুনগোপাড়ায় অবস্থিত ঐতিহ্যবাহী স্যার আশুতোষ সরকারি কলেজ। চট্টগ্রাম কলেজের আগে প্রতিষ্ঠিত এই বিদ্যাপীঠটি এখনো সগৌরবে শিক্ষা বিস্তার করে যাচ্ছে। উপজেলার পূর্ব গোমদণ্ডীতে রয়েছে একুশে পদকপ্রাপ্ত মরমী কবি, কবিয়াল রমেশ শীলের সমাধি, আরো আছে ছন্দারিয়ায় একুশে পদকপ্রাপ্ত বিখ্যাত ঢোল বাদক বিনয়বাঁশি জলদাসের বাড়ি। আমুচিয়ায় আছে একুশে পদকপ্রাপ্ত আঞ্চলিক গানের সম্রাজ্ঞী শেফালি ঘোষের বাড়ি ও দেশবরেণ্য সংগীত পরিচালক বাসুদেব ঘোষের স্মৃতি বিজড়িত বাড়ি।

 

উত্তরভূর্ষিতে জন্মগ্রহণ করা বিপ্লবী বিনোদ বিহারী চৌধুরীর স্মৃতি বিজড়িত মাটির ঘরটি দেখতে প্রতিনিয়ত দেশ বিদেশের লোকজন ছুটে আসেন। আরো আছে সারোয়াতলী ইউনিয়নে বিপ্লবী তারেকেশ্বর দস্তিদার, শ্রীপুরে কল্পনা দত্তের স্মৃতি এবং মধ্য শাকপুরার বিশ্বজয়ী শ্রী চিন্ময়ের ঐতিহ্যবাহী বাড়ি। বর্তমানে কড়লডেঙ্গা, আমুচিয়া ও জ্যৈষ্ঠপুরায় ব্যক্তি উদ্যোগে গড়ে ওঠেছে অনেক বাগান। যেখানে বরই, মাল্টা, বিভিন্ন জাতের আম, সবজিসহ অনেক কিছুই পাওয়া যায়। সেই সাথে এসব বাগানে সময় কাটাতে ছুটির দিনে মানুষের আনাগোনা বেড়ে যায়। আমুচিয়ায় রয়েছে বিশাল এক রাবার বাগান। সবুজ ও মাথা উঁচু করে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে থাকা রাবার গাছের সৌন্দর্যে প্রকৃতির প্রেমে পড়বে অনেকেই। জ্যৈষ্ঠপুরায় ভান্ডালজুড়ি ছড়া ও কর্ণফুলী নদীতে সনাতন ধর্মের লোকদের বারুণী স্নান চলে আসছে বহু বছর ধরে। বর্তমানে জ্যৈষ্ঠপুরায় গড়ে ওঠা চট্টগ্রাম ওয়াসার ভান্ডালজুড়ি পানি প্রকল্প ওই এলাকার সৌন্দর্যকে বাড়িয়ে দেয়ার পাশাপাশি দূর-দূরান্তের ভ্রমণ পিপাসু মানুষকে বোয়ালখালী উপজেলায় ভ্রমণ করতে উৎসাহ জোগাচ্ছে।

 

একদিকে নদী, অপরদিকে সবুজ পাহাড় বোয়ালখালীকে এক অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছে। এখানকার দর্শনীয় স্থান, মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি বিজড়িত জায়গা, বিখ্যাত ব্যক্তিগণের জন্মস্থান সব মিলিয়ে পর্যটনের এক অপার সম্ভাবনা বিরাজ করছে বোয়ালখালীতে। উপরোক্ত স্থানগুলো ছাড়াও এই উপজেলার আনাচে কানাচে রয়েছে আরো অনেক ঐতিহাসিক স্থাপনা। এসব স্থাপনাকে যথাযথভাবে সংরক্ষণ এবং রক্ষণাবেক্ষণের ব্যবস্থা নেয়া হলে নতুন প্রজন্ম বোয়ালখালীর অতীতের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস দেখে বোয়ালখালী সম্পর্কে অনেক কিছুই জানবে। সেই সাথে দেশ-বিদেশের লোকজনও বোয়ালখালী উপজেলার এসব জায়গা দেখতে ছুটে আসবেন।

 

লেখক : শিক্ষক

 

 

পূর্বকোণ/জেইউ

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট