চট্টগ্রাম শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

সীতাকুণ্ডে কৃষি-শিল্পে অশনি সংকেত

ইমাম হোসাইন রাজু

১৩ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ | ১১:৩৯ পূর্বাহ্ণ

গেল চার মাস ধরে চাষাবাদ বন্ধ সীতাকুণ্ডের বারৈয়াঢালা ইউনিয়নের মহালঙ্কা ও টেরিয়াইল ব্লকের দেড়শ’ হেক্টর জমিতে। পানির অভাবে এসব জমি শুকনো মৌসুমে অনাবাদি হয়ে পড়ে আছে। শুধু এই এলাকায় নয়, সীতাকুণ্ডের মুরাদপুর, বাড়বকুণ্ড, বাঁশবাড়িয়া ইউনিয়ন ও তার আশপাশসহ বেশ কিছু এলাকাতেই বছরের পর বছর প্রায় আড়াই হাজার হেক্টর জমি অনাবাদি থাকছে। পানি সংকটের কারণে এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে বলে জানিয়েছেন কৃষির সাথে জড়িত সংশ্লিষ্টরা। অথচ এ সীতাকুণ্ডকে ঘিরেই রয়েছে কৃষি বিপ্লবের সম্ভাবনা।

 

শুধু কৃষি ক্ষেত্রেই নয়, সীতাকুণ্ডে অবস্থিত শিল্পোদ্যোক্তাদেরও দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে এ পানি। হাজার হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করেও কেবল পানির সংকটে বিপদে রয়েছেন এখানকার শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোর মালিকরা। কিছু কিছু প্রতিষ্ঠান বিভিন্নভাবে পানি সংরক্ষণ করে ব্যবস্থা করছে। তবে অনেকে ভূ-গর্ভস্থ থেকে অনিয়ন্ত্রিত পানি উত্তোলণের কারণে স্তর নেমে গেছে অনেক নিচে। যার কারণে আড়াই হাজার ফুট গভীরে গিয়েও পানি না পাওয়ার কথা জানিয়েছেন অনেকেই।

 

সম্প্রতি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সয়েল সায়েন্স ডিপার্টমেন্টের করা এক গবেষণায় সীতাকুণ্ডের মাটিতে বিষাক্ত রাসায়নিকের উপস্থিতি প্রমাণ করে কীভাবে জাহাজ ভাঙার দূষণ ছড়িয়ে পড়েছে এই জনপদে। যার কারণে কৃষির উৎপাদনও ব্যাহত হচ্ছে। আর এসব ঘটছে মূলত বিশ্বব্যাপী পরিচিতি পাওয়া পৃথিবীর সবচেয়ে বিপদজনক জাহাজভাঙা শিল্পের কারণে। জাহাজভাঙা থেকে নির্গত হওয়া প্রায় এক ডজনের বেশি বিষাক্ত পদার্থের কারণে পরিবেশ ও প্রতিবেশগত হুমকির মুখে পড়ছে।

 

স্থানীয়রা বলছেন, বিগত দুই দশক ধরে সীতাকুণ্ডে পানির স্তর ক্রমশ নেমে যাচ্ছে। যার নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে ফসলি জমি থেকে বসতবাড়ি পর্যন্ত সর্বত্রই। যার কারণে বহু টিউবওয়েল ও কুয়ো অকেজো হয়ে গেছে। এমনকি অনেকস্থানে গভীর নলকূপেও পানি উঠছে না। যা ভাবিয়ে তুলেছে সাধারণ মানুষকে। এমনকি লাখ টাকা খরচ করে গভীর নলকূপ স্থাপন করেও পানি না পাওয়ার কথা জানিয়েছেন বাসিন্দারা।

 

কুমিরা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মোর্শেদুল আলম চৌধুরী বলেন, ‘বড় বড় শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলো শক্তিশালী যন্ত্র বসিয়ে দুই হাজার ফুট গভীরে গিয়ে পানি তুলছে। যার প্রভাব পড়েছে এলাকাজুড়ে। সাধারণ মানুষ পানি পাচ্ছে না। ব্যবহারে যেমন সমস্যায় পড়ছেন, তেমনি পানির কারণে কৃষকরাও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। এ অবস্থায় ওয়াসার পানি সরবরাহ করাটা এখন সময়ের দাবি হয়ে দাঁড়িয়েছে।’

 

উপজেলা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশলী মো. রাশেদুজ্জামান বলেন, ‘সীতাকুণ্ডে পানির স্তর অনেক নিচে। যেভাবে পানির স্তর নামছে, কয়েকবছর পর পরিস্থিতি আরও খারাপ হবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। তাতে সাধারণ মানুষ পানি সংকটে ভুগবে। প্রাকৃতিক বিপর্যয়ও ঘটবে।’

 

তিন সমস্যায় ভুগছে কৃষি খাত: সবজিভণ্ডারখ্যাত সীতাকুণ্ডের কৃষি খাত এখন অনেকেটাই পথ হারাতে বসেছে। একসময়ে অঞ্চলটিতে বিপুল পরিমাণের সবজি আবাদ করা হলেও বর্তমানে তিন কারণে সম্ভাবনার মৃত্যু ঘটতে যাচ্ছে। তীব্র পানি সংকট, উপকূলীয় এলাকায় লবণ পানি ও হিমাগারের অভাবের কারণে চাষাবাদে প্রতিবন্ধকতায় পড়েছেন কৃষকরা।

 

উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মোহাম্মদ হাবীবুল্লাহ বলেন, ‘সীতাকুণ্ডে মাটি খুবই উর্বর। এখানে প্রচুর সবজি উৎপাদনের সুযোগ রয়েছে। বিদেশেও রপ্তানি করে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের সুযোগ থাকলেও পানি সংকটসহ কয়েকটি কারণে তা হাতছাড়া হচ্ছে।’

 

কৃষি সংশ্লিষ্টরা জানান, সীতাকুণ্ডে প্রায় ১০ হাজার হেক্টর আবাদী জমি আছে। এসব জমিতে মৌসুম ভেদে সারাবছরই নানারকম সবজি উৎপাদন হয়ে থাকে। যাতে প্রায় ৩৭ হাজার কৃষক চাষাবাদ করছেন। কিন্তু নানা প্রতিবন্ধকতায় দিনদিন কৃষি জমি কমতে শুরু করেছে। আবার এসবের কারণে চাষাবাদও বন্ধ হচ্ছে দিনদিন। অথচ উল্লেখিত সমস্যা সমাধান করা গেলে কৃষিতে যেমন বিপ্লব ঘটবে তেমনি রাজস্ব আয়েরও সুযোগ থাকবে।

 

উন্নয়নের অভাব পর্যটনে: সীতাকুণ্ডকে বলা হয় প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যরে লীলাভূমি। ৩৭ কিলোমিটার আয়তনের এ উপজেলার পূর্ব দিকে পুরোটাজুড়েই আছে সুউচ্চ পর্বতমালা। পাহাড়কে ঘিরে গড়ে উঠেছে ছোটদারোগারহাট সহস্রধারা ঝর্ণা, চন্দ্রনাথ ধাম মহাতীর্থ, ইকোপার্ক, ভাটিয়ারী প্রাকৃতিক লেক, মাটিটা, ক্যাফে টুয়েন্টিফোর নামক পর্যটন স্পট। এসব স্পটের পাহাড়ে আছে অসংখ্য রকম জীবজন্তু, আছে বেশ কয়েকটি নয়নাভিরাম ঝর্ণা, প্রাকৃতিক লেক, বিভিন্ন প্রজাতির গাছের বাগান প্রভৃতি। সবুজ বৃক্ষরাজির মধ্যদিয়ে বয়ে যাওয়া আঁকাবাঁকা পথে এসব অপরূপ সৌন্দর্য্য দেখতে দেখতে মুগ্ধ হন প্রকৃতিপ্রেমী মানুষ। পর্যটন ঘিরে সম্ভাবনা থাকলেও বিগত বছরগুলোতে উন্নয়নের ছোঁয়া লাগেনি বললেই চলে। অবকাঠামো, যোগাযোগ ব্যবস্থা, পর্যটকদের পর্যাপ্ত সুযোগ সুবিধা না থাকা এবং নিরাপত্তা ব্যবস্থাসহ নানান কারণেই সম্ভাবনার এ পর্যটন খাত দিনদিন পিছিয়ে পড়ছে। সরকারের পক্ষ থেকে উদ্যোগ গ্রহণ করলে পর্যটন খাত থেকেও কোটি কোটি টাকার রাজস্ব আয় সম্ভব।

 

সীতাকুণ্ড উপজেলা নির্বাহী অফিসার মো. শাহাদাত হোসেন বলেন, সীতাকুণ্ডে পর্যটনকে ঘিরে অনেক সম্ভাবনা আছে। তবে কিছু পরিকল্পিত উন্নয়নের প্রয়োজন। তাহলে পর্যটন শিল্পেও অবদান রাখবে এ সীতাকুণ্ড। পর্যটন শিল্পকে ঘিরে কী করা যায়, তা নিয়ে সংশ্লিষ্ট মহলে আলোচনা করা হবে।’

 

 

পূর্বকোণ/জেইউ

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট