চট্টগ্রাম শনিবার, ২৭ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

ছবি-শরীফ চৌধুরী

পহেলা বৈশাখ : বিশ্ববাঙালির বৃহত্তর সাংস্কৃতিক উৎসব

১৪ এপ্রিল, ২০২৩ | ১২:৪৮ অপরাহ্ণ

বছর ঘুরে আবার এলো বাঙালির প্রাণের উৎসব পহেলা বৈশাখ। আমাদের নববর্ষ। বৈশাখ মানেই বাঙালির অনুরাগ-রাঙা একটি দিন। কালের আর্বতনে ঘুরে এলো আরেকটি বছর। বাঙালিরা প্রচণ্ড আবেগ নিয়ে বসে থাকে এ দিনটির জন্য। প্রাণের স্ফূর্তি নিয়ে আহ্বান করে- ‘এসো, এসো, এসো হে বৈশাখ।’ এ এক অন্য রকম অনুভূতি, অস্থিমূলের আলাদা টান। বাঙালির সহজাত উপলদ্ধির নান্দনিক-সহযোগ। নববর্ষের আগমন তাই আমাদের জীবনে সংযোজন করে দেয় এক নতুন অধ্যায়- আমাদের সামনে খুলে দেয় এক নতুন পাতা।

অতীত পুরাতন পেছনে ফেলে জীর্ণস্তুপ নিশ্চিহ্ন করে নববর্ষ আসে সুন্দর, কল্যাণ ও মঙ্গলময়তার নবজাগরিত আশার অভিপ্রায় নিয়ে। জাতীয় জীবনে বৈশাখ বারো মাসে একবারই আসে বলে তাকে বরণের প্রবল আগ্রহ থাকে। বাংলা নববর্ষ বৈশাখের প্রথমদিনে অনাগত জীবনের শুভকামনায় যে বার্তা নিয়ে আসে মানুষ তার পরিপূর্ণতার জন্য বৈশাখকে পালন করে নানান রঙে নানান ঢঙে। ধারণ করে উৎসব আনন্দে তথা মেলা ও চিরায়ত সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য মানস চেতনায়। নববর্ষ তাই আজ অতৃপ্তির বন্ধন থেকে মুক্ত করার উজ্জ্বল প্রতীকী চেতনায় ভাস্বর। কালের অনন্ত প্রবাহে ফিরে আসা এই নতুন দিনটিকে নিয়ে বাঙালির আয়োজন, উৎসাহ ও প্রাণচাঞ্চল্যের শেষ নেই।

ইতিহাসের পেছনে তাকালে দেখি নববর্ষ হিসেবে পহেলা বৈশাখের প্রচলন আর উদ্ধসঢ়;যাপন প্রতিষ্ঠার ইতিহাস খুব বেশি প্রাচীন নয়। এর সূচনা আজ থেকে প্রায় পাঁচশ বছর আগে সম্রাট আকবরের শাসনামলে। তাঁর প্রবর্তিত বাংলা নববর্ষ একদিকে যেমন বাঙালির উৎসবের উৎস ছিল; তেমনই এর উদ্ভবের সঙ্গে রয়েছে খাজনা আদায় ও ঋণ পরিশোধের বিষয়টি। কৃষিনির্ভর সমাজে সেকালে বাংলা সনের শুরু-সমাপ্তির সাথে জড়িত ছিল নানা রীতি ও আচার অনুষ্ঠান। বিশেষ করে বণিক শ্রেণির মধ্যে ছিল ‘হালখাতা’র প্রচলন। আর অন্যদিকে জমিদার ভূস্বামীর মধ্যে ছিল ‘পুণ্যাহ’ উৎসব। আরও থাকতো পূজাপার্বণ, চৈত্রসংক্রান্তিসহ নানা অনুষ্ঠানাদি। তবে নববর্ষের সবচেয়ে মূল আকর্ষণ হিসেবে বাঙলির প্রাণে প্রবল আগ্রহ ভরে জমে উঠত বৈশাখি মেলা। সারা বৈশাখ মাস জুড়ে বিভিন্ন অঞ্চলে গ্রামে গ্রামে চলত এ মেলার অয়োজন। এই মেলাকে কেন্দ্র করে বারোয়ারি জিনিস বিক্রি হতো। সাথে থাকতো যাত্রা, পুতুল নাচ, সার্কাস, বলি খেলাসহ বিভিন্ন ধরনের লোকজ অনুষ্ঠান। যা গ্রামীণ জীবনে দেখা দিত ব্যাপক উৎসাহ-উদ্দীপনা।

কালের পরিক্রমায় পহেলা বৈশাখ আজ সার্বজনীন বাঙালি উৎসবে পরিণত হয়েছে। পৃথিবীর ইতিহাসে এমন প্রাণবন্ত উৎসব খুব বেশি দেখা যায় না। সকল বিভেদ ভুলে মানবমৈত্রীর গভীরতর দ্যোতনায় নববর্ষের এ অনুষ্ঠান হয়ে ওঠে সর্বসম্প্রদায়ের এক সার্বজনীন সম্প্রীতি ও ঐক্যচেতনার প্রতীকে। ধর্ম-বর্ণ-গোত্র, সম্প্রদায় তথা বিশ্ববাঙালির বৃহত্তর সাংস্কৃতিক উৎসব। ভিন্ন তাৎপর্য ও নতুন আঙ্গিকে উপস্থাপনের মধ্য দিয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরই বাঙলা নববর্ষের উৎসবকে সবচেয়ে বেশি পরিচিত করে তোলেন। ফলে ক্রমে বাংলা নববর্ষ হয়ে ওঠে স্বতঃস্ফূর্ত ও সহজাত মিলনমেলা।

যদিও বাঙালির এ স্বতঃস্ফূর্ত চেতনার উপর বিভিন্ন সময় ধর্ম ও রাষ্ট্রের খড়্ধসঢ়;গ হস্ত পড়েছে। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে এই অপপ্রচার চালাতে সচেষ্ট হয়েছিল যে, নববর্ষ হিন্দু সম্প্রদায়ের ধর্মীয় উৎসব। মূলত এ ধারণা সম্পূর্ণই ভুল। সে অপপ্রচার এখনও চলছে। এইতো গত কয়েকদিন আগেও মঙ্গল শোভাযাত্রা বন্ধে সরকারকে আইনী নোটিশ প্রদান করেছে এক ব্যাক্তি। তাদের দৃষ্টিতে এটি হিন্দুয়ানী সংস্কৃতিÑ মূলত এ ধারণা সম্পূর্ণই ভুল। নববর্ষের উৎসব প্রাচীন জনমানসের লোকাচারের অঙ্গ ছিল। এ প্রেক্ষিতে এর চরিত্র ছিল মূলত লোক উৎসবের। এ চরিত্র সার্বজনীন। বরং বলা যায়, এদেশে থার্টি ফাস্ট নাইট, হেপি নিউ ইয়ার, হিজরী নববর্ষ পালনই বিজাতীয় সংস্কৃতির চর্চা করা। বাংলা নববর্ষই একমাত্র উৎসব যা এই বাংলার মাটিলগ্ন সংস্কৃতিরই একান্ত উৎসার। এ কারণেই বাঙালির সাংস্কৃতিক ইতিহাস-ঐতিহ্যের বিরুদ্ধে তৎকালীন শাসকগোষ্ঠীর ন্যাক্কারজনক ষড়যন্ত্র এবং ভাষা ও সংস্কৃতির উপর আক্রমণের বিরুদ্ধে লড়াই করে আমাদের সাংস্কৃতিক বিকাশের ধারা অব্যাহত রাখার প্রেরণা হিসেবে কাজ করেছে বাংলা নববর্ষের উৎসব। তাই কালে কালে নববর্ষের এ অনুষ্ঠান অনেক সময় হয়ে উঠেছিল প্রতিবাদের ভাষা হিসেবে। স্বাধীনতাউত্তর বাংলাদেশে পহেলা বৈশাখ আনুষ্ঠানিকভাবে জাতীয় উৎসবের দিন হিসেবে স্বীকৃতি পায়। এ দিনে সরকারি ছুটি ঘোষণা করা হয়। তারই ধারাবাহিকতায় এখনও বাংলা বর্ষবরণ ও বিদায়ের অনুষ্ঠান জাগ্রত আছে রমনার বটমুলে, ছায়ানটে, ডিসি হিলসহ দেশের প্রতিটি জেলায় থানায় তথা আমাদের শহর ও গ্রামীণ জনপদে। সরকার এখন বৈশাখী ভাতাও দিচ্ছে প্রজাতন্ত্রের কর্মচারিদের। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আনুষ্ঠানিকভাবে পালন করার নির্দেশনাও দিয়েছে সরকার।

বাঙালি সংস্কৃতির মূলধারা অন্বেষণে- বাঙালি জাতিসত্তার স্বরূপ উদ্ঘাটনে নববর্ষকে ঘিরে বৈশাখি মেলা আজ আমাদের জাতীয় জীবনে গভীর প্রেরণা ও পাথেয় হিসেবে বিবেচিত। পহেলা বৈশাখের মধ্য দিয়ে এ দেশের নরনারী এই ঐতিহ্যকে বাঁচিয়ে রেখেছে। সংগীত, নৃত্য, আমোদ-প্রমোদ, পানাহার প্রভৃতি পৃথিবীর যেকোনো প্রাচীন ও নবীন উৎসবের সাধারণ অঙ্গ। তাই বাঙালির সর্বস্তরের, বয়সের মানুষ মেতে ওঠে এই উৎসবের আনন্দযজ্ঞে। বাংলা নববর্ষ পালনের মধ্যে এসেছে বৈভব আর পরিবর্তন। বৈশাখি মেলা আজ বাংলা নববর্ষের স্বতঃস্ফূর্ত স্মারক। এ মেলার লৌকিক ধারা শহরে এসে মিশেছে নৈয়ায়িক আবহে। ‘আমানি’ ও ‘পুণ্যাহ’ উৎসব বাঙালির মধ্যে বিলুপ্ত হলেও ‘হালখাতা’ এখনো আছে। আছে নববর্ষকে ঘিরে লোকজ মেলা প্রদর্শনী ও নানা অনুষ্ঠান। বাংলা নববর্ষ তাই বাঙালিয়ানার ঐতিহ্যধারায় আমাদের সাংস্কৃতিক আবেগের অন্তর্ভূক্ত। শহুরে জীবনের নববর্ষে এখন ভিন্ন মাত্রা সংযোজিত হয়েছে বর্ণিল পোশাক ও ফ্যাশন সচেতন সাজসজ্জা। পান্তা উৎসব, হরেক পিঠা উৎসব, বাঁশ-বেত-কাঠ ও মৃৎ শিল্পের নানা পসরা, বিকিকিনি ও প্রদর্শনী। আর নাগরদোলার আকর্ষণ তো রয়েছেই।

নববর্ষ ও উৎসব পালনের রূপান্তর ঘটলেও এর মূল চেতনা ও প্রেরণা কিন্তু এক ও অভিন্নভাবে অটুট আছে এখনও। যে প্রেরণা আমাদেরকে শেকড়ের পথে নিয়ে যায়। আবহমান দেশকে উপলদ্ধি করাই আমাদের নববর্ষ উৎসবের কেন্দ্রীয় বিষয়। বাঙালি জাতীয়তাবাদের সার্বজনীন চর্চাই মূখ্যত নববর্ষের মূল উদ্দীপক শক্তি। চারুকলার মঙ্গল শোভাযাত্রা আর ডিসি হিল ও সিআরবি’র বাঁধভাঙা উৎসবের মধ্যদিয়েই বুঝা যায় বাঙালির অনুভবগভীর বিশুদ্ধ ও মানবিক চেতনার সার্বজনীন আকাক্সক্ষার প্রতিফলন। সাম্প্রদায়িকতার অবসান ঘটিয়ে মঙ্গল ও কল্যাণের একাগ্র বাসনা নিয়ে এদিনে আমাদের একটাই পরিচয় হয়ে ওঠে আমরা বাঙালি। দেশপ্রেমই এ উৎসবের গভীর প্রেরণা। এ উৎসব বাঙালি জীবনের জাতিগত সংহতি ও মেলবন্ধন রচনার এক গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠান। ক্ষুদ্র গণ্ডি ছাড়িয়ে বৃহত্তর প্রীতি, সৌহার্দ্য, শুভকামনা ও মাঙ্গলিক চেতনার লক্ষ্যাভিসারী। এজন্য নববর্ষের রাঙা প্রভাতকে বিশিষ্ট গবেষক ড. আহমদ শরীফ কবি নজরুলের উদ্ধৃতিসহ যথার্থই বলেছেন- ‘মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহিয়ান’- মানবতাবাদীর এই মন্ত্রে দীক্ষা নেবার লগ্ন হচ্ছে নববর্ষের প্রথম প্রভাত। প্রতিটি নববর্ষই মুক্তির প্রতীক। অজ্ঞতা, অন্ধতা, অবিদ্যা আর অন্যায়, পীড়ন শোষণ দারিদ্র থেকে কাম্য-মুক্তির প্রতিভূ প্রতিটি নতুন বছর। প্রতিটি নববর্ষ হচ্ছে মুক্তির প্রমূর্ত সংকল্প, শপথ ও সংগ্রাম।’

কাজেই ১৪৩০ বঙ্গাব্দ শুভ নববর্ষ বয়ে আনুক ধর্মবিভেদবিনাশী চেতনায় উজ্জীবিত হয়ে সার্বজনীন মানুষের কল্যাণকর শুভবার্তা। এই জাতীয় উৎসব হোক সকল প্রকার ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ প্রেরণা। সর্ব প্রকার অন্যায় অনাচার গ্লাণি ও অশুভ শক্তি দূর হয়ে নববর্ষ হোক সকলের জন্য নব আনন্দে জীবন জাগরিত, সুন্দর সুস্মিত ও মঙ্গল সম্ভাবিত।

লেখক : কবি ও প্রাবন্ধিক

 

 

পূর্বকোণ/এসি

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট