চট্টগ্রাম মঙ্গলবার, ১৯ মার্চ, ২০২৪

সর্বশেষ:

গুপ্তঘাতক

১৪ এপ্রিল, ২০২২ | ১২:২৪ অপরাহ্ণ

জাহেদ মোতালেব

 

১. খোলা একটা জায়গা। সেখানে বসে রাহাকে পড়াচ্ছি। ও আমার ডান পাশে। বাঁ পাশে বসেছে ওর ছোট বোন। সামনে ছোট্ট টেবিল। টেবিলে দুজনের বই। আমি বসেছি মোড়ায়।
অদূরে একটা জনসভা হচ্ছে। সেখানে এসেছেন প্রেসিডেন্ট। ভাষণ শেষ হওয়ার আগ মুহূর্তে তিনি বেøজারের পকেট থেকে দামী বিদেশি পিস্তলটা বের করলেন। আরেক পকেট থেকে সাইলেন্সার নিয়ে পিস্তলের নলে জোড়া লাগালেন।
আমি পড়াতে পড়াতে তা দেখলাম। দেখতে দেখতেই রাহা ঢলে পড়ল টেবিলের উপর। তাকিয়ে দেখি, প্রেসিডেন্টের পিস্তল তখনো ওর দিকে তাক করা।
আমরা ফ্রিজ হয়ে বসে আছি। লোকজন ছোটাছুটি করছে। কিন্তু তেমন আওয়াজ হচ্ছে না। একটু পর উঠে দৌড় দিই। প্রেসিডেন্টের লোকজন আমাদের দিকে তেড়ে আসে। তারা কাঁদানে গ্যাসের স্প্রে ছোড়ে। আমরা পালাতে থাকি।
সৈন্যরা আসছে। আমি মহিলা ভাইস চেয়ারম্যানের গ্যারেজের টিনের উপর উঠে যাই।
কে যেন আমগাছ বেয়ে উপরের দিকে উঠছে। আর দুজন উপরের দিকে তাকিয়ে আছে।
প্যান্টের পকেটে হ্যান্ডস্যানিটাইজারের স্প্রে ছিল। দুজনের চোখে-মুখে মারি। ওরা মুখ ধরে বসে যায়।
আমি টিন ছেড়ে আরেক ঘরের ছাদে লাফ দিই। সেখান থেকে লাফিয়ে নিচে নামি। তারপর দৌড়াই।
গোলাগুলির কারণে প্রায় প্রত্যেক ঘরের দরজা বন্ধ। এক ঘরের পেছন দিকে ঢুকে আরেক ঘরের সামনে দিয়ে বেরুই।
সম্ভবত আমাকে প্রথম গুলিটা করল দাড়িওয়ালা লম্বা চুলের ঘাতক। তার পরনে চকলেট রঙের টি-শার্ট। মাথা একটু এলিয়ে দেয়ালের সাথে ঘেঁষে দাঁড়িয়েছিলাম। তাই বেঁচে গেছি। গুলিটা সিমেন্টের আস্তর ছলকে নিয়ে চলে গেল। সিমেন্টের ছিটকা আরেকটু হলে চোখে ঢুকত।
গুলির বাতাস নাকি সিমেন্টের চলকার বাতাস গালে ঝাপটা মেরেছে বুঝতে পারিনি।
আমার বুকটা কেঁপে উঠল। ঘটনার সময় তো কাছেই ছিলাম। গুলিটা রাহার পিঠ ভেদ করে ওখানেই রয়ে গেছে! পিঠে একটুখানি রক্ত আর ছোট একটা ছিদ্র দেখেছি। উপুড় হয়ে টুলে পড়ে থাকার দৃশ্য চোখের সামনে ভাসছিল আর কান্না আসছিল। দৌড়ে চলে যাওয়ার সময় দেখেছিলাম তার মুখের কোণায় এক টুকরো মুচকি হাসি। যেন সে ব্যঙ্গ করে বলছে, এসব গুলিতে কিছু হয় না। আমি আবার উঠে দাঁড়াব।
হাঁটতে হাঁটতে বাজারের কাছাকাছি পৌঁছে গেছি। বিশিষ্ট নেতা বক্তৃতা করছিলেন মানুষের কল্যাণ নিয়ে। তার মুখে ক্রুর হাসি। তার সংবর্ধনার স্টেজ ভেঙে গিয়েছিল। সেজন্যই কি রেগে আছেন? বড় লোক কখন রাগেন, কখন হাসেন বোঝা মুশকিল। আয়োজকরা বিরোধী নেতার ঘরের বড় তোষকটা নিয়ে এসে স্টেজের উপর বিছিয়ে দিয়েছিল। এর উপর দিয়েছিল বেডশিট। তারপর তারা বসে গিয়েছিল। সব আবার স্বাভাবিক।
নেতা বললেন, এটা সত্য, প্রেসিডেন্ট নির্দোষ। ওখানে কোনো কিছু হয়নি। কোনো গুলি চলেনি। আমরা যেমন ছিলাম তেমনই আছি। ঠিক আছে?
সবাই মাথা নেড়ে বলল, ঠিক আছে।
অনেকক্ষণ পর মনে পড়ল নেতা দুইটা গুলি করেছিলেন। আরেকটা গুলি আমার ছাত্রীর মায়ের কনুই ছুঁয়ে গিয়েছিল। টপটপ দুই ফোঁটা রক্ত পড়েছিল কনুই থেকে।
আমি ভাবছিলাম, এই পৃথিবী সহিংস। এখানে প্রতিদিন অজ¯্র সহিংসতা উৎপাদিত হয়; মানুষকে নাজেহাল করে, ভিতু বানায়।
পেছনে দাঁড়িয়ে বক্তৃতা শুনছিলাম। আস্তে করে সরে যাই। কেননা ঘাতক তখনো আমাকে খুঁজে চলেছে। বাজারের পাশে একটা বাড়ি। সেখানে গরুঘরের কোণায় গাইয়ের পায়ের কাছে বসি। গাইটা দাঁড়িয়ে। ওলানটা মুখের কাছে। দুধের আবছা গন্ধ পাচ্ছি। পেট মুচড়ে ওঠে। বিকেল থেকে কিছুই খাইনি। ইচ্ছে হয়, একটা বাঁট মুখে নিয়ে টান দিই। দুধ দোয়ানোর সময় বালতিতে দুধ পড়ার যে সুর তা কানে বাজছে।
মানুষ হওয়ার অনেক ঝামেলা। আচ্ছা, আমি যদি এখন বেতগুলা হয়ে যেতে পারতাম, তাহলে বেতগাছে ঝুলে থাকতাম। কেউ আমাকে দেখত না।

২. খচর মচর আওয়াজ শুনে গরুঘর থেকে বেরিয়ে যাই। কাছেই লম্বা গড়। গড় মানে জলাশয়। গড়ে নেমে পানার ফাঁকে লুকাই। এই পৌষে পানি কম। অনেকক্ষণ ধরেই লুকিয়ে আছি। তীব্র শীতে থরথর করে কাঁপছিলাম।
উপুড় হয়ে পড়ে থাকার সময় সবকিছু নিস্তব্ধ ছিল। মাথা তুলতে গিয়েই গুলিটা খাই। কাঁধে এসে লাগে। রক্তে ভেসে যাই আমি। ভেসে যায় আমার স্মৃতিগুলো। কবুতরের পালকের মতো খসে পড়ে। বাতাসে এলোমেলো ওড়ে। চোখ বন্ধ হয়ে যেতে থাকে। এই পৃথিবীর আলো-ছায়া কি আর দেখব না? একটা আফসোস ভেতর থেকে হাহাকারের মতো উঠে আসে। এই প্রথম আমার কান্না পায়। চোখের জল আর গড়ের পানি মিলেমিশে একাকার হয়।
ওদের পায়ের আওয়াজ শুনতে পাচ্ছি। কিন্তু আমার নড়ার শক্তি নেই। সারা রাতের দাপাদাপি, বুক কাঁপুনি, চোর-পুলিশের মতো লুকোচুরি, আক্রমণ, সব কোথায় যেন চলে যায়। আমি স্থির। শুধু বুকটা মৃদু ওঠানামা করছে। যন্ত্রণা নাকি অন্য কিছু বুঝতে পারি না। ভোঁতা একটু অনুভূতি। ছোটকালে ডান হাতের তর্জনির মাঝখানে কেটে যাওয়ার সময় এই অনুভূতি হয়েছিল।
আমার মনে হতে থাকে, আশেপাশে প্রেসিডেন্ট আছেন। উঁকি দিয়ে দেখতে চেষ্টা করছেন আমার রক্ত। সেই রক্ত এখন অন্ধকারের মতো কালো হয়ে গেছে। দেখতে না পারায় তাই তিনি বিরক্ত।
আরেকটা গুলির শব্দ আর আঁক করে ভোঁতা একটা আওয়াজ। ঘাতক ভুলে প্রেসিডেন্টকেও গুলি করেছে! তার রক্তই হয়ত ফিনকি দিয়ে পড়েছে আমার নাকের কাছে। তাহলে এই রক্ত আমার নয়, প্রেসিডেন্টের!

 

পূর্বকোণ/এসি

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট