চট্টগ্রাম শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

রুগ্ন থেকে দেশ সেরা

হালদাভ্যালির বাগানের চা যাচ্ছে বিশে^র বিভিন্ন দেশে

মো. নিজাম উদ্দিন লাভলু হ রামগড়

১ ডিসেম্বর, ২০১৯ | ১:৪৪ পূর্বাহ্ণ

প্রাচীন চীনে প্রথম চা গাছের পাতাকে ভেষজ ওষুধ হিসেবে ব্যবহার করা হত। চা প্রক্রিয়াজাতকরণের সবচেয়ে প্রাচীন চীনা পদ্ধতি ছিল তাজা চা পাতাকে ভাপে দেয়া এবং সংরক্ষণের জন্য শুকানো। এ পদ্ধতিতে ‘হান সা¤্রাজ্য’র শেষের দিকে চা তৈরি হত। এ পদ্ধতিতে তৈরি শুকনা চা পাতাকে আজকের দিনের ‘সবুজ চা’ বা ‘গ্রীন টি’ বলা হয়। এখন অবশ্য অত্যাধুনিক মেশিনে তৈরি করা হয় গ্রীন টি। নানা উপাদানের মধ্যে প্রচুর পরিমাণে ক্যাটেচিন, অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট ও মিনারেলস থাকায় ক্যান্সার প্রতিরোধ, ডায়াবেটিক, উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ, ক্ষতিকর কোলস্টেরল কমিয়ে হার্ট সুস্থ রাখা, মেদ ঝরিয়ে ওজন হ্রাসসহ শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধিতে গ্রীন টি ভেষজ ওষুধ হিসেবে স্বীকৃত। বাংলাদেশে গ্রীন টি তৈরির ইতিহাস খুবই অল্পদিনের। ২০১৫ সালে হালদাভ্যালি চা বাগানে শুরু হয় বিশেষ ধরনের এ চায়ের উৎপাদন। স্বল্প সময়ে শূন্য হতে দেশসেরা বাগানের স্বীকৃতি লাভ করা হালদাভ্যালির অন্যতম সাফল্য এ গ্রীন টি, হোয়াইট টি ও অর্থডক্স টি উৎপাদন। শুধু তাই নয়, দেশের সীমানা পেরিয়ে চীন, জাপান, জার্মান ও দুবাইসহ বিশ্বের বহু দেশে এখন রপ্তানি হচ্ছে এখানকার বিশেষ চা। চট্টগ্রামের ফটিকছড়ির নারায়ণহাটের প্রত্যন্ত এলাকায় বাগানটির অবস্থান। ২০০২ সালে মৃতপ্রায় এ বাগানটি ক্রয় করেন পেড্রোলো গ্রুপের কর্ণধার শিল্পপতি নাদের খান। তার অসাধারণ সৃজনশীল চিন্তা, চ্যালেঞ্জিং মনোভাব ও কঠোর পরিশ্রমে অল্পদিনের মধ্যেই সাফল্যের চূড়ায় পৌঁছে যায় এক সময়ের মৃতপ্রায় এ হালদাভ্যালি। দেশে সাধারণ চা উৎপাদনের রেকর্ড সৃষ্টি করে বাগানটি।

চা বোর্ডের পরিসংখ্যান মতে, ২০১৭ সালে বাংলাদেশে হেক্টর প্রতি চায়ের গড় উৎপাদন ছিল ১ হাজার ৪৭৭ কেজি, সেখানে হালদাভ্যালিতে ছিল এর তিন গুণ বেশি। অর্থাৎ ৩ হাজার ৭১৭ কেজি। গত বছরের পরিসংখ্যানও একই। উৎপাদনে নতুন রেকর্ড সৃষ্টি করে ২০১৭ ও ২০১৮ সালের পরপর এ দু’বছরই দেশের সেরা বাগানের স্বীকৃতি লাভ করে এটি। সাধারণ চা উৎপাদনেই কেবল সেরা নয়, গ্রীন টি, হোয়াইট টি ও অর্থডক্স টি’র মতো বিশেষ ধরনের চা তৈরি করে বাগানটির সাফল্যের সুনাম দেশের সীমানা পেরিয়ে বিদেশেও ছড়িয়েছে।

বাগানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক নাদের খান বলেন, ‘রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী বিদেশ সফরে গেলে উপহারসামগ্রী হিসেবে হালদাভ্যালির উৎপাদিত বিভিন্ন ধরনের চা নিয়ে যান। এটা আমাদের জন্য অনেক গর্বের ব্যাপার। তিনি বলেন, হালদাভ্যালির গ্রীন টি, হোয়াইট টি ও অর্থডক্স টি দেশে-বিদেশে অভাবনীয় সাড়া জাগিয়েছে। এতে আমরা আরও বেশি উৎসাহিত হয়েছি। ভবিষ্যতে বিশ্বের কমপক্ষে ৫০টি দেশে বিশেষ ধরনের এ চা রপ্তানির পরিকল্পনা রয়েছে আমাদের।’ তিনি আরও জানান, বাংলাদেশে নিযুক্ত ছয়টি আরব রাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত গত ২০ নভেম্বর ঢাকাস্থ গুলশানে অবস্থিত হালদাভ্যালি টি লাউন্স পরিদর্শন করেছেন। তারা হালদাভ্যালির তিনটি বিশেষ চায়ের গুণগতমান দেখে খুবই সন্তোষ প্রকাশ করেছেন।

যার হাতের জাদুকরী ছোঁয়ায় ২০০২ সালের মৃত বাগানটি আজ বিশ্বখ্যাত, সফল এ সিনিয়র ব্যবস্থাপক মো. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ২০১৪ সালে গ্রীন টি উৎপাদনের উদ্যোগ নেয়া হয়। এ চা তৈরির হাতেকলমে জ্ঞান অর্জনের জন্য সুদূর চীনে ১৫ দিনের প্রশিক্ষণের যান তিনি। পরবর্তীতে সে দেশ থেকে তিনজন টি মাস্টারকে দু’দফায় এনে বাগানের ফ্যাক্টরি অপারেটর ও ফিল্ড ওয়ার্কারদের বিশেষভাবে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। চীন থেকে আমদানি করা হয় প্রক্রিয়াজাতকরণের প্রয়োজনীয় সব মূল্যবান প্রসেসিং মেশিন। ২০১৫ সাল থেকে পুরোদমে শুরু করা হয় গ্রীন টি, হোয়াইট টি ও অর্থডক্স টি’র উৎপাদন। তিনি জানান, সাধারণ চা তৈরিতে গাছ থেকে ২টি কুঁড়ি একটি পাতা সংগ্রহ বা চয়ন করা হয়। কিন্তু গ্রীন টি’র জন্য গাছের সরু শাখা থেকে চয়ন করতে হয় একটি কুঁড়ি একটি পাতা আর হোয়াইট টি’র জন্য শুধু একটি কুঁড়ি। ৩-৪ দিনের এ কুঁড়ির তখন আকার হয় মাত্র ৩ সে.মি.। চয়নের পূর্বে চা গাছে পানি স্প্রে করে কুঁড়িগুলো পরিষ্কার করা হয়। বাগান থেকে সংগৃহীত কুঁড়ি কারখানার বিশেষ কক্ষে সংরক্ষণ করা হয় আদ্রতা কমানোর জন্য। ডি হিউমিডিটি ফায়ার মেশিনের মাধ্যমে ১২ ঘন্টায় আদ্রতা কমিয়ে উপযুক্ত করা হয় পরবর্তী দাপের প্রসেসিংয়ের জন্য। কম্পিউটারাইজ মেশিনে নির্দিষ্ট তাপমাত্রা ও প্রেষণের মাধ্যমে আদ্রতা হ্রাস করা কুঁড়িগুলো রূপান্তর করা হয় শুকনো গ্রীন টি’তে। হাতের স্পর্শ বা কেমিকেল প্রয়োগ ছাড়াই তৈরি হয় বিশেষ এ চা। ৫২ থেকে ৬০ পিস কুঁড়িতে তৈরি হয় ১ কেজি গ্রীন টি। প্রশিক্ষিত এক ওর্য়াকার দৈনিক গড়ে ১ কেজি কাঁচা কুঁড়ি সংগ্রহ করেন। গ্রীন টি ও হোয়াইট টি তৈরির কুঁড়ি চয়নের জন্য বাগানের বিশেষ সেকশন রয়েছে, যেখানে কোন প্রকার কীটনাশক ওষুধ বা রাসায়নিক সার ব্যবহার হয় না। তিনি আরও জানান, চীনের উন্নত জাতের ড্রাগনঅয়েল গ্রীন টি-ই হালদাভ্যালিতে উৎপাদন করা হচ্ছে। উৎপাদিত বিশেষ ধরনের এ চা গুণগত মান পরীক্ষা নিরীক্ষায় নিশ্চিত হওয়ার পরই এখানে কম্পিউটারাইজভাবে প্যাকেজিং করা হয় বাজারজাতকরণের জন্য। প্রথম উৎপাদিত গ্রীন টি চীনে পরীক্ষা নিরীক্ষায় গুণগত মানের স্বীকৃতি লাভের পর ২০১৭ সালে সেদেশে রপ্তানি করা হয় ৩ হাজার কেজি।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট