চট্টগ্রাম রবিবার, ২৮ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

পাঁচ প্রকার লোকের সাথে ঘনিষ্ঠতা অর্জনের আগে সতর্ক হোন

২ সেপ্টেম্বর, ২০২২ | ১১:১৫ পূর্বাহ্ণ

সৎ জীবন যাপন মানুষের একটি কাক্সিক্ষত বিষয়। সৎ জীবন যাপনের মাধ্যমে দিনে দিনে বড় লোক হওয়া যায় না ঠিকই, তবে এতে যে আনন্দ পাওয়া যায়, তা স্বর্গীয় ও অপরিমেয়। যারা দুনিয়া ও আখিরাতে বিশ্বাস করে, আল্লাহতায়ালার বিচারে ভয় পায় এবং তার পুরস্কারের আশাবাদী তাদের পক্ষে শত বাঁধা বিপত্তির মধ্যেও সৎ জীবন যাপন সম্ভব।

এ বিষয়ে আমরা মহান নবী রাসুল (আ.) ও পরবর্তি আউলিয়ায়ে কেরাম (রহ.)-এর জীবনসমূহ উদাহরণ হিসেবে দেখতে পারি। আল্লাহতায়ালা পবিত্র কোরআন মাজীদে এবং হযরত মুহাম্মদ (স.) হাদীস শরীফে সৎ জীবন যাপনের জন্য জোর তাগিদ দিয়েছেন। বাস্তবক্ষেত্রে সৎ জীবন যাপনে গড়ে উঠার জন্য এবং সৎ পথে দৃঢ় থাকার জন্য কিছু সতর্কতা অবলম্বন করা দরকার। আপনি যেহেতু সমাজের একজন। সেহেতু একটি সমাজে চতুর্দিকে অসততার বিষবাষ্পের মধ্যে আপনাকে সৎ হিসেবে নিজেকে উপস্থাপন করতে হলে পরিবেশ প্রতিবেশের আনুকূল্য অত্যাবশ্যক। একইসাথে চাই সৎ সঙ্গ, সৎ সংশ্রব। অনেক সময় নিজে নির্দোষ, সৎ ও আদর্শবান হওয়া সত্ত্বেও পরিবেশের কারণে অসৎ বন্ধু-বান্ধবদের দরুন অন্যায়কারী ও ঘৃণিতদের মধ্যে পরিগণিত হতে হয়। ইসলাম এ জন্য উপযুক্ত বন্ধু নির্বাচনের উপর গুরুত্বারোপ করেছে। আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালা পবিত্র কোরআনের সূরা তাওবায় ইরশাদ করেছেন- হে মু’মিনগণ আল্লাহকে ভয় কর এবং সাদিক বা সৎ লোকের সঙ্গী হও।’
আয়াতে বিশেষভাবে সাদিকদের ঘনিষ্ঠ থাকার তাগিদ দেয়া হয়েছে। বস্তুত: ‘সাদিক’ বা সত্যবাদীগণ সর্বদা ন্যায়ের পথে অবিচল থাকে। তারা দুনিয়ার হীনস্বার্থকে তুচ্ছ জ্ঞান করে। পরকালীন পুরস্কারের মানসে গোটা জীবন উৎসর্গ করতে প্রস্তুত হয়। অপর অর্থে যারা সাদিক তারা ‘সালিহ’ ও অর্থাৎ তারা পরম সত্যব্রতী। তারা সৎ ভেতরে ও বাইরে, নিয়ত ও ইচ্ছায় এবং কথা ও কর্মে। এমন মানুষের সান্নিধ্য বরাবরই অন্যকে উন্নত জীবনের দিকে ধাবিত করে, উৎসাহিত ও অনুপ্রেরণা যোগায়।

এটা নিশ্চিত যে, সৎ লোকের সাথে চললে সৎ হওয়া যায়। আর অসৎ লোকের সাথে চললে অসৎ হওয়ার সম্ভাবনাই বেশী। কথায় বলে ‘সৎ সঙ্গ স্বর্গবাস অসৎ সঙ্গ সর্বনাশ।’ মহানবী হযরত মুহাম্মদ (স.) বলেছেন:‘অসৎ সঙ্গীর চেয়ে একাকীত্ব ভাল আর একাকীত্বের চেয়ে সৎ সঙ্গী ভাল।’ বিশুদ্ধ হাদীস সংকলন তিরমিযী শরিফে বর্ণিত আছে, মহানবী হুজুরে পুর নূর (স.) বলেছেন: মানুষ তার বন্ধুর ধর্ম (স্বভাব চরিত্র) দ্বারা প্রভাবিত, সুতারাং কার সাথে তুমি বন্ধুত্ব করছ তা যাচাই করে নেবে। অর্থাৎ এক বন্ধুর প্রভাব অন্য বন্ধুর উপর পড়ে। সুতারাং স্বভাব চরিত্র দেখে বন্ধুত্ব করতে হবে।

অনুকূল পারিপার্শ্বিকতা ও সৎ বন্ধুর সাহচর্যে মানুষ মর্র্যদার উচ্চাসন অর্জন করে। পক্ষান্তরে প্রতিকূল পারিপার্শ্বিকতা ও অসৎ বন্ধুর সংস্পর্শে সে মহাধ্বংসের অতল গহবরে তলিয়ে যেতে পারে।

তাই বন্ধু নির্বাচনে সতর্ক করে হযরত জাফর সাদিক (রহ.) বলেছেন, পাঁচ ব্যক্তির সাথে কখনো বন্ধুত্ব করবেনা। ১) মিথ্যাবাদী- কারণ তার কাছে প্রবঞ্চনা আর প্রতারণাই পাওয়া যাবে।

২) নির্বোধ- তার থেকে কোন উপকার আশা করা যায় না, বরং অপকারই পাবে।

৩) ভীরু- সে তোমাকে বিপদের সময় শত্রুর হাতে সমর্পণ করবে।

৪) পাপাচারী- সে তোমাকে এক লোকমা বা তার কমের বিনিময়ে বিক্রি করে ফেলবে।

৫) কৃপণ- সে একান্ত প্রয়োজনের সময় তোমাকে ত্যাগ করবে।

অটোম্যান সুলতান সুলেমান তার বড় ছেলে মুস্তফাকে দেশজয়ের অভিযানে প্রেরণের সময় যে মনোমুগ্ধকর উপদেশ দিয়েছিলেন তাও বেশ স্মরণযোগ্য। সুলতান সুলেমান বললেন, ‘বাহাদুর ছেলে আমার শোন, ঐশ্বর্যের চেয়ে দামি সম্পদ বুদ্ধিমত্তা আর সবচেয়ে বড় দারিদ্র হচ্ছে মূর্খতা। নিরর্থক ভয় পাওয়া হচ্ছে সবচেয়ে বড় দুর্বলতা আর সবচেয়ে মূল্যবান বিষয় হৃদয়বান হওয়া। শোন, বোকার সাথে বন্ধুত্ব করতে যাবেনা। সে তোমার উপকারের চাইতে ক্ষতি করবে বেশি। কৃপণের সাথেও কখনো বন্ধুত্ব করবেনা। কারণ, সে বিপদের দিনে তোমার পাশে না থেকে নিজেকে গুটিয়ে নেবে। সাবধান, কোন পরনিন্দাকারীকেও তোমার বন্ধু বানিও না। কারণ, সে নিজের প্রয়োজনে তোমাকে ব্যবহার করবে। আর সেই সাথে মিথ্যাবাদীর সাথেও কখনো বন্ধুত্ব করবেনা। কারণ সে মরীচিকার মত দূরের স্বপ্নে বিভোর করে কাছের জিনিসগুলোকে দূরে সরিয়ে দেবে।’

সৎ সঙ্গের মাধ্যমে একটি ব্যাপক ধরনের পার্থিব উপকারিতা যে নিহিত- তা এতক্ষণের আলোচনায় নিশ্চয় প্রতিভাত হয়েছে। পরকালীন জীবনের জন্যও সৎ সংশ্রব অবলম্বনের কোন বিকল্প নেই। অসৎ বন্ধুত্ব ও অসৎ সংশ্রব মানুষকে ক্রমেই দুনিয়ার লোভ-লালসার প্রতি আকণ্ঠ নিমজ্জিত করে দেয়। ফলে তার আখিরাতেও ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। হাদীসের বর্ণনায় দেখা যায়, দুনিয়াতে যারা সৎভাবে জীবন-যাপন করেছে এবং সৎ মানুষের সাথে উঠা বসা করেছে তারা পরকালে একইসাথে থাকার সুযোগ পাবে।

পক্ষান্তরে অসৎ সঙ্গীগণ তাদের কর্মফলের ভিত্তিতে একই সাথে উঠবে এবং সকলে একে অপরের দোষে সম্পৃক্ত ও দোষী সাব্যস্ত হয়ে পড়বে। এজন্য আল্লাহর রাসুলের (স.) মহান সাহাবাগণ (রাদি.) সর্বদা সৎ লোকদের সাথে উঠা-বসার সুযোগ খুঁজতেন এবং অসৎ সঙ্গী মুনাফিক, কপটভন্ডদের ব্যাপারে সতর্ক থাকতেন।

পরবর্তীতে মহান আউলিয়ায়ে কেরামদের (রহ.) জীবনেও আমরা অনুরূপ আচরণ ও সদস্বভাব লক্ষ্য করি। তিরমিযী শরীফে হযরত আনাস ইবনে মালিক (রাদি.) থেকে বর্ণিত আছে। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (স.) বলেছেন: যে ব্যক্তি যাকে ভালবাসে, (কিয়ামতের দিন) সে তার সাথেই থাকবে এবং সে যা অর্জন করেছে তাই পাবে।’

তিনি আরো বলেন, একব্যক্তি রাসূলুল্লাহ (স.) এর কাছে এসে জিজ্ঞেস করল, ইয়া রাসুলাল্লাহ! কিয়ামত কখন সংঘটিত হবে? নবী (স.) নামাযে দাঁড়িয়ে গেলেন। নামাজ শেষে তিনি জিজ্ঞেস করেন কিয়ামত সংঘটিত হওয়ার ব্যাপারে প্রশ্নকারী লোকটি কোথায়? সে বলল, ইয়া রাসূলাল্লাহ! এই যে আমি, তিনি জিজ্ঞেস করলেনঃ তুমি কিয়ামতের জন্য কি প্রস্তুতি নিয়েছে? সে বললঃ হে আল্লাহর মহান রাসুল (স.)! আমি অবশ্য তেমন লম্বা (নফল) নামাযও পড়িনি, রোযাও (নফল) রাখিনি, তবে আমি নিশ্চয় আল্লাহ ও তার প্রিয় রাসূলকে ভালবাসি। রাসূল (স.) বললেন: আলমারউ মা মান আহাব্বা ইলাইহি- যে যাকে ভালবাসে, সে কিয়ামতের দিন তার সাথেই থাকবে।’ আর তুমিও যাকে ভালবাস তাঁর সাথেই থাকবে। অর্থাৎ আমার প্রতি ভালবাসার কারণে তুমি আমার সাথেই থাকবে ইনশাআল্লাহ। রাবী বলেন, এ কথায়,সাহাবিরা এতই খুশি হলেন যে, ইসলাম গ্রহণের পর মুসলমানদের আর কোন ব্যাপারে এত খুশি হতে দেখিনি।’(৪/২২৭)।

কুরআনুল কারীমেও বলা হয়েছে যে, পরকালে অপরাধীরা একে অপরের উপর দোষ চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা চালাবে এবং নিজেরা যাদের কারণে যাদের মাধ্যমে বিভ্রান্ত হয়েছে তাদের প্রতি প্রচণ্ড ঘৃণা ও ক্ষোভে ফেটে পড়বে। সূরা হা-মিম সিজদার ২৯নং আয়াতে বলা হয়েছেঃ কাফেরেরা বলবে, হে আমাদের পালনকর্তা! যে সব জ্বিন ও মানুষ আমাদের পথভ্রষ্ট করেছিল, তাদেরকে দেখিয়ে দাও, আমরা তাদেরকে পদদলিত করব, যাতে তারা যথেষ্ট অপমানিত হয়।’

পক্ষান্তরে সৎকর্মশীল সৎ সংশ্রবকারীদের ব্যাপারে বলা হয়েছে: যারা ঈমানদার এবং তাদের সন্তানেরা ঈমানে তাদের অনুগামী, আমি তাদেরকে তাদের পিতৃপুরুষদের সাথে মিলিত করে দেব এবং তাদের আমল বিন্দুমাত্রও হ্রাস করব না। প্রত্যেক ব্যক্তি নিজ কৃতকর্মের জন্য দায়ী। (সূরা ত্বোর-আয়াত ২১)। এজন্য মহাত্মা ইমাম গাজ্জালী (রহ.) বলেছেনঃ যার সাথে বন্ধুত্ব করবে তার মধ্যে অন্তত পাঁচটি গুণ থাকা চাই। বুদ্ধিমত্তা, সৎ স্বভাব, পাপাচারী না হওয়া, বিদআতী না হওয়া, দুনিয়াসক্ত না হওয়া।

অতএব, আমরা যেন সৎ জীবন-যাপনের স্বার্থে নিজেরা সৎ সঙ্গ, সুন্দর পরিবেশ বিনির্মাণের চেষ্টা করি এবং একই সাথে আমার-আপনার সন্তানদের সৎ বন্ধুবৎসলভাবে বেড়ে উঠার দিকে সজাগ দৃষ্টি রাখি। আল্লাহ আমাদের সহায় হোন।

গত মার্চ ২০১৪ এর একটি আলোচিত ঘটনা। আগ্রাবাদ সিডিএতে কন্যার বন্ধুর হাতে নিহত হন মা মেয়ে দুইজন। অনুসন্ধানে প্রকাশ পেয়েছে মোবাইলের মাধ্যমে ছেলে ও মেয়ের মধ্যে প্রথমে গভীর সম্পর্ক গড়ে উঠা এবং এক পর্যায়ে বিভিন্ন রেস্ট হাউজে ডুবে ডুবে জল খাওয়া আর পরবর্তিতে দুইজনের মধ্যে সম্পর্ক ছিন্ন হওয়ার পরিণতিতে এ নৃশংস হত্যাকান্ড।

১৮ বছরের নিচে যেখানে ধর্মীয় ও দেশীয় আইনে বিয়ে শাদী নিষিদ্ধ এসব কিশোর-কিশোরীদের যথাযথ পরিপক্ষতা আসেনি বলে, যে বয়সে পিতা-মাতাকে সন্তানদের আলাদা বিছানায় রাখতে বলা হয়েছে সে বয়সে পিতা-মাতারা কোন আকলে সন্তানদের পর যুবকদের সংশ্রবে নিরবতা অবলম্বন করে মোবাইল হাতে দিয়ে তা ভাবতে অবাক লাগে। একই হাদীসে তিনি আরও সত্য কথাটি বলেছেন উপযুক্ত সন্তানদের বিলম্বিত বিয়ে শাদির কারণে তারা যদি বিপদগামী হয় এর পাপ ও দায়ভার পিতা-মাতাকে নিতে হবে।’ আজকের অবক্ষয় থেকে বাঁচার জন্য ইসলামের মহান নবীর আদর্শই একমাত্র পথ।

মনিরুল ইসলাম রফিক অধ্যাপক, টিভি উপস্থাপক ও জাতীয় পুরষ্কারপ্রাপ্ত খতীব।

 

পূর্বকোণ/আর

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট