চট্টগ্রাম মঙ্গলবার, ১৩ মে, ২০২৫

সর্বশেষ:

যেকারণে ভূমিধস বিজয়ে প্রধানমন্ত্রীর চেয়ারে আবারও আলবানিজ
ফাইল ছবি

যেকারণে ভূমিধস বিজয়ে প্রধানমন্ত্রীর চেয়ারে আবারও আলবানিজ

অনলাইন ডেস্ক

৫ মে, ২০২৫ | ১:৩২ অপরাহ্ণ

ক্ষমতাসীন লেবার পার্টির নেতা প্রধানমন্ত্রী অ্যান্থনি আলবানিজের ওপর পুনরায় আস্থা রাখলেন অস্ট্রেলিয়ার ভোটাররা। ২০২৫ সালের জাতীয় নির্বাচনে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে টানা দ্বিতীয় মেয়াদে জয়লাভ করেছে তার দল। নির্বাচন কমিশনের সর্বশেষপ্রাপ্ত খবরে জানা গেছে, ১৫০টি প্রতিনিধি পরিষদের আসনের মধ্যে আলবানিজের দল এখনও পর্যন্ত ৮৫টি আসনে জয় পেয়েছে। সেখানে পিটার ডাটনের নেতৃত্বাধীন রক্ষণশীল ন্যাশনাল কোয়ালিশন জিতেছে মাত্র ৪৪ আসন। ফলে ভূমিধস বিজয়ের মধ্যে আবারও প্রধানমন্ত্রীর চেয়ারে বসতে চলেছেন তিনি। এত বিপুল ব্যবধানে বিরোধী দলকে পরাজিত করার নজির অস্ট্রেলিয়ার ইতিহাসে নেই। এই ফলাফল প্রাথমিক জরিপগুলোকে ভুল প্রমাণ করেছে এবং বিরোধী জোটকে তীব্রভাবে প্রত্যাখ্যান করেছে। বিশ্লেষকদের মতে, এটি লেবার সরকারের নীতির প্রতি জনসমর্থনের স্পষ্ট ইঙ্গিত, যেখানে অর্থনীতি, জলবায়ু নীতি ও স্বাস্থ্যসেবা ইস্যুতে জনগণ তাদের অবস্থান স্পষ্ট করেছে।

 

নির্বাচন প্রক্রিয়ার শুরুতেই জল্পনা-কল্পনা চলছিল কে হচ্ছেন অস্ট্রেলিয়ার পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী-নতুন নাকি পুরনোতেই আস্থা? ফেব্রুয়ারিতে জনমত জরিপে লেবার পার্টির চেয়ে লিবারেলদের অবস্থান বেশি শক্তিশালী দেখা গিয়েছিল। কিন্তু মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প অস্ট্রেলীয় পণ্যে ১০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করার পর ট্রাম্পবিরোধী লেবারদের জনপ্রিয়তার পুনরুত্থান শুরু হয়। প্রাথমিকভাবে মনে হচ্ছিলো ডাটন প্রধানমন্ত্রী আলিবানিজের চেয়েও ভালো অবস্থায় রয়েছেন। কারণ প্রধানমন্ত্রী জনগণের জীবনযাত্রার ব্যয় নিয়ে হিমশিম খাচ্ছিলেন। কিন্তু নির্বাচনে প্রচারণা জোরদার হওয়ার পর এ সুবিধাজনক অবস্থান হারিয়ে যেতে থাকে, যার চূড়ান্ত পরিণতি হলো নির্বাচনে লজ্জাজনক পরাজয়। বিশ্লেষকরা এর কারণ হিসেবে ‘ট্রাম্প ইফেক্টে’র কথা বলেছেন। কারণ দেশটিতে ডাটনকে অনেকেই মনে করেন ‘অস্ট্রেলিয়ার ট্রাম্প’ হিসেবে। নিজ দলের সমর্থকদের উদ্দেশ্যে বিজয়ী ভাষণে আলবেনিজ বলেছেন, আজ অস্ট্রেলিয়ার মানুষ অস্ট্রেলিয়ান মূল্যবোধের পক্ষে ভোট দিয়েছে। সবার জন্য ন্যায্যতা, প্রত্যাশা ও সুযোগ; বৈচিত্রতা ও মানবিকতার জন্য সাহস দেখানোর শক্তি।

 

তিনি বলেন, এই বিজয় কেবল আমাদের দলের নয়, এটি অস্ট্রেলিয়ার জনগণের বিশ্বাস ও প্রত্যাশার প্রতিফলন। পরাজয় স্বীকার করে আলবানিজকে অভিনন্দন জানিয়েছেন ডাটন। তাঁর কথায়, ‘ভোটে আমরা ভাল ফল করতে পারিনি। এই হারের দায় আমি নিজের কাঁধে নিচ্ছি।’ নির্বাচনের সবচেয়ে হতাশাব্যঞ্জক ঘটনা ছিল বিরোধীদলীয় নেতা প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী পিটার ডাটনের নিজ আসন পশ্চিম ডিকসন থেকে পরাজয়। ব্রিসবেনের এই আসনে লেবার প্রার্থী আলী ফ্রান্স জিতেছেন। তিনিই অস্ট্রেলিয়ার প্রথম নারী, যিনি একটি নির্বাচনে বিরোধী দলীয় নেতাকে হারিয়েছেন। আলি ফ্রান্স একজন আইনজীবী, সাংবাদিক ও বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন প্যারা-অ্যাথলেট। ওই আসনটি গত ২২ বছর ধরে লিবারেল দলের হাতে ছিল। ২০০৪ সাল থেকে বিরোধী দলের নেতা ডাটন আসনটি ধরে রেখেছিলেন।

 

এবারের নির্বাচনে বড় ইস্যু অস্ট্রেলিয়ার ক্রমবর্ধমান জীবনযাত্রার ব্যয়। পাশাপাশি স্বাস্থ্যসেবা ও আবাসন সংকট নিয়েও ভোটাররা উদ্বিগ্ন ছিল। প্রচারের সময় দু দলই জোর দিয়েছিল সে দেশের জীবনযাপনের ব্যয় বৃদ্ধির ওপর। তবে বিরোধীরা সরকারের একাধিক নীতি নিয়ে সরব হয়েছে। অস্ট্রেলিয়ার ক্রমবর্ধমান মুদ্রাস্ফীতির জন্য আলবানিসের সরকারকেই কাঠগড়ায় তুলেছিলেন ডাটনেরা। তাঁদের দাবি, মুদ্রাস্ফীতি রুখতে ব্যর্থ আলবানিস এবং তাঁর সরকার। পাল্টা আক্রমণে ডাটনের পারমাণবিক প্রস্তাবকে নিশানা করেছিল লেবার পার্টি। অভিযোগ, ডাটনের দল ‘বিভাজনমূলক রাজনীতি’র পালে হাওয়া দিচ্ছে। অস্ট্রেলিয়ার সাধারণ নির্বাচন এ বার বিশ্ববাসীর কাছে আকর্ষণের অন্যতম বিষয় ছিল। তার মূলে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, ট্রাম্পের শুল্কনীতির কারণে সৃষ্ট অর্থনৈতিক ঘাটতি ভোটে প্রভাব ফেলেছে। সেই আবহে আলবানিসের সরকার চিনের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের দিকে জোর দিয়েছিল। আমেরিকা-চিন শুল্কযুদ্ধে অস্ট্রেলিয়া প্রশাসন কোনও পক্ষ না নিলেও আলবানিসের সরকারের অবস্থান স্পষ্ট ছিল। অনেকের মতে, ট্রাম্পের বিরুদ্ধে বাণিজ্যযুদ্ধে লেবার পার্টির সরকারের নীতির দিকেই ঝুঁকল অস্ট্রেলিয়া। ভোটাররা বলছেন, আলবানিজের এ জয়ে, জীবনযাত্রার হ্রাস, স্বাস্থ্যসেবা ও আবাসন সংকট সমাধান, অভিবাসননীতি সহজীকরণ এবং বহুসংস্কৃতিবাদকে আরও শক্তিশালী করবে।

 

গেল ২২ এপ্রিল ভোটগ্রহণ শুরু হয় এবং ১ কোটি ৮১ লাখ নিবন্ধিত ভোটারের মধ্যে ওইদিন আগাম ভোট দিয়েছেন ৮৫ লাখেরও বেশি ভোটার। অবশিষ্ট ভোটাররা ৩ এপ্রিল ভোট দিয়েছেন। ৮৩টি দেশে অস্ট্রেলিয়ার কয়েক হাজার নাগরিক ভোট দিয়েছেন। অস্ট্রেলিয়ার পররাষ্ট্র দফতর জানিয়েছে, বার্লিন, হংকং, লন্ডন ও নিউইয়র্কসহ ৮৩টি দেশে ১১১টি কেন্দ্রের ব্যবস্থা করা হয়েছে। ৪৮তম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে হাউস অব রিপ্রেজেন্টেটিভের ১৫০টি আসন এবং সিনেটের ৭৬ আসনের মধ্যে ৪০টি আসনে ভোটগ্রহণ হয়েছে। দেশটির ভোটারদের জন্য ভোট দেওয়ার কিছু বাধ্যবাধকতা রয়েছে। ১৮ বছর বয়সী সবার জন্য ভোট দেওয়া বাধ্যতামূলক। প্রথমবার কেউ ভোট না দিলে তাকে ২০ অস্ট্রেলীয় ডলার (প্রায় ১৩ মার্কিন ডলার) জরিমানা গুনতে হবে। এরপর থেকে ৫০ ডলার করে দিতে হয়। ভোট না দিয়ে ঘরে বসে থাকলে শুধু সামাজিক নয়, আইনি ফলও ভোগ করতে হয়। এ কারণে অস্ট্রেলিয়ায় ভোটার উপস্থিতির হার ৯০ শতাংশ ছাড়িয়ে যায়। কেউ চাইলে ডাকযোগেও ভোট দিতে পারেন, তবে ভোটের দিনে ভোটার তালিকায় উপস্থিতি নিশ্চিত করতেই হবে।

 

আলোচনায় অভিবাসন:

অস্ট্রেলিয়ার জনগোষ্ঠীর তৃতীয় বৃহত্তম অংশেরই জন্ম দেশটির বাইরে। দীর্ঘদিন ধরেই দেশটির পরিচিত ‘মাইগ্রেশন ন্যাশন’ হিসেবে, যেখানে অভিবাসীরা নতুন করে জীবন শুরু করতে পারেন। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে অভিবাসীদের মধ্যে হতাশা বাড়ছে। এর মূল কারণ- বাসস্থান খরচ বাড়ছে। পিটার ডাটন বলেছেন, অভিবাসীরা যেন সহজেই ভোট দিতে পারেন সেজন্য ফাস্ট ট্রাক সিটিজেনশিপ চালু করবেন তিনি। এছাড়া গত বছর প্রধানমন্ত্রী আলবানিজের সরকার আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থী সীমিত করার উদ্যোগ নিলেও শেষ পর্যন্ত প্রস্তাবটি পাশ হয়নি।

 

স্বাস্থ্যসেবা ইস্যু:

বিবিসির টিফানি টার্নবুল দক্ষিণ অস্ট্রেলিয়া থেকে লিখেছেন, অস্ট্রেলিয়ায় আধুনিক স্বাস্থ্যসেবা পদ্ধতির সূচনা হয়েছে প্রায় চার দশক আগে। সেখানে মেডিকেয়ার নামে একটি জনবীমা প্রকল্প চালু আছে। এর আওতায় উন্নত মানের স্বাস্থ্যসেবা নাগরিকদের জন্য মৌলিক অধিকার হিসেবে বিবেচিত। কিন্তু বিষয়টি প্রায়ই জাতীয় ইস্যুতে পরিণত হয়। কারণ, প্রয়োজনের সময় অনেককেই এই সেবা পেতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। বলতে গেলে সর্বজনীন এই স্বাস্থ্যসেবা পদ্ধতি অনেকটাই খুঁড়িয়ে হাঁটছে। সরকার যে অর্থ বরাদ্দ দিচ্ছে তা যথেষ্ট হচ্ছে না। জেনারেল প্রাকটিশনারসহ স্বাস্থ্যকর্মীর সংকট দেখা যাচ্ছে। সেবাপ্রার্থীদের জন্য অপেক্ষার সময় ক্রমশ দীর্ঘতর হচ্ছে। রোগীদের খরচও দিন দিন বেড়ে যাচ্ছে। দেশটিতে অনেকেই বলেছেন, সার্বজনীন স্বাস্থ্যসেবার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া জরুরি হয়ে পড়েছে।

 

নির্বাচন সম্পর্কে কিছু তথ্য:

অস্ট্রেলিয়ার প্রতিনিধি পরিষদের ১৫০টি আসনের সবকটিতেই এবং সিনেটের ৭৬টির মধ্যে ৪০টি আসনে আজ নির্বাচন হচ্ছে। দেশটিতে প্রধান রাজনৈতিক দল দুটি – অস্ট্রেলিয়ান লেবার পার্টি এবং রক্ষণশীল লিবারেল-ন্যাশনাল কোয়ালিশন। কোনো দলের সরকার গঠনের জন্য প্রতিনিধি পরিষদের অন্তত ৭৬টি আসন পেতে হবে। সেটি সম্ভব না হলে দলগুলো বিজয়ী স্বতন্ত্র প্রার্থী বা ছোট দলগুলোর সমর্থন পাওয়ার চেষ্টা করতে পারে। দেশটিতে কয়েক দশক ধরেই রাজ্য ও ফেডারেল সরকার নির্বাচনে ছোট দলগুলো ও স্বতন্ত্র প্রার্থীদের ভোট ক্রমাগত বাড়ছে। ২০২২ সালের নির্বাচনে প্রতি তিনজন ভোটারের একজন দুই প্রধান রাজনৈতিক দলের বাইরে অন্যদের ভোট দিয়েছিলেন। লেবার, দ্য লিবারেল, দ্য ন্যাশনালস এবং দ্য গ্রিন মোটামুটি আলোচনায় থাকে। যদিও ১২টি দল সিনেটে আর আটটি দল প্রতিনিধি পরিষদে প্রতিনিধিত্ব করে থাকে।

তথ্যসূত্র : নিউইয়র্ক টাইমস, বিবিসি

 

লেখক : মুহাম্মদ মোরশেদ আলম, যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী সাংবাদিক

 

 

পূর্বকোণ/ইবনুর

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট