চট্টগ্রাম বুধবার, ২১ মে, ২০২৫

সর্বশেষ:

আধুনিক যুগোপযোগী নতুন বন্দর গড়ার সময় এখনই
ফাইল ছবি

১৩৮তম চট্টগ্রাম বন্দর দিবস

আধুনিক যুগোপযোগী নতুন বন্দর গড়ার সময় এখনই

খায়রুল আলম সুজন

২৫ এপ্রিল, ২০২৫ | ১১:৩৩ পূর্বাহ্ণ

চট্টগ্রাম বন্দর বাংলাদেশের অর্থনীতির চালিকাশক্তি। দেশের মোট আমদানি-রপ্তানির প্রায় ৯০ শতাংশ পরিচালিত হয় এই বন্দরের মাধ্যমে। ১৩৮তম বন্দর দিবসে আমরা কেবল অতীতের অর্জনকে স্মরণ করছি না, বরং সামনে তাকিয়ে ভবিষ্যতের জন্য প্রস্তুতি নেওয়ার কথাও ভাবছি। সময় এসেছে আগামী ৫০ বছরের সম্ভাবনা ও চাহিদা বিবেচনায় নিয়ে একটি আধুনিক, যুগোপযোগী ও টেকসই বন্দর গড়ার পরিকল্পনা বাস্তবায়নের। এই প্রেক্ষাপটে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ ‘বে-টার্মিনাল’ নির্মাণে যে দৃশ্যমান অগ্রগতি ও কার্যকর পদক্ষেপ নিয়েছে, তা নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়। আমরা এই প্রয়াসকে আন্তরিকভাবে সাধুবাদ জানাই। তবে এ উদ্যোগ কেবল একটি বাড়তি টার্মিনাল নির্মাণের মধ্যে সীমাবদ্ধ না থেকে একটি পূর্ণাঙ্গ, আধুনিক, বহুমুখী বন্দর গড়ার রূপরেখা হিসেবেই পরিগণিত হওয়া উচিত, যেটি বিশ্বমানের বন্দরের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে সক্ষম।

 

নতুন বন্দর নির্মাণের সময় কিছু গুরুত্বপূর্ণ দিককে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে। প্রথমত, হেভি লিফট মালামাল হ্যান্ডলিং ও সংরক্ষণের জন্য পর্যাপ্ত অবকাঠামো গড়ে তোলা জরুরি। বর্তমান বন্দরে বড় শিল্প প্রকল্পের যন্ত্রপাতি, যেমন পাওয়ার প্ল্যান্টের টারবাইন বা কনটেইনারাইজড মেশিনারি, খালাসের জন্য উপযুক্ত ব্যবস্থা না থাকায় ব্যয়বহুল ও সময়সাপেক্ষ বিকল্প ব্যবস্থার ওপর নির্ভর করতে হয়। এতে করে ব্যবসা-বাণিজ্যে অসুবিধা যেমন বাড়ছে, তেমনি আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়ার ঝুঁকিও তৈরি হচ্ছে। দ্বিতীয়ত, আলাদা কেমিক্যাল টার্মিনাল এবং আধুনিক সংরক্ষণাগার গড়ে তোলা একান্ত প্রয়োজন। বর্তমানে কেমিক্যাল হ্যান্ডলিং এখনও ঝুঁকিপূর্ণভাবে পরিচালিত হচ্ছে, যা একটি বড় দুর্ঘটনার সম্ভাবনা সৃষ্টি করে। আন্তর্জাতিক মানের পৃথক পাইপলাইন, স্টোরেজ ট্যাঙ্ক ও নিরাপত্তা ব্যবস্থাপনা ছাড়া কেমিক্যাল জাহাজ খালাস করা উচিত নয়।

 

বিশ্বব্যাপী বড় আকারের জাহাজ ব্যবহারের প্রবণতা বাড়ছে। সে অনুযায়ী বন্দরের গঠনেও পরিবর্তন আনতে হবে। নতুন বন্দরে এমন ড্রাফট এবং জেটি থাকতে হবে, যেখানে ২০০ মিটার বা তার চেয়েও বড় জাহাজ নিরাপদে ভিড়তে পারে। এ লক্ষ্যে প্রয়োজন গভীর নাব্যতা, শক্তিশালী অবকাঠামো এবং আধুনিক ক্রেন ও হ্যান্ডলিং সরঞ্জাম। ডেন্জারাস গুডস বা বিপজ্জনক পণ্যের জন্য আন্তর্জাতিক মান অনুসারে আলাদা হ্যান্ডলিং জোন, নিরাপদ সংরক্ষণাগার, উন্নত স্ক্যানিং ব্যবস্থা ও ফায়ার প্রোটেকশন টেকনোলজি নিশ্চিত করতে হবে। সেইসঙ্গে থাকতে হবে প্রশিক্ষিত জনবল এবং জরুরি পরিস্থিতি মোকাবিলায় প্রস্তুত প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা। নতুন বন্দরের নকশায় আধুনিক প্রযুক্তি ও অটোমেশন অত্যন্ত জরুরি। কনটেইনার ট্র্যাকিং, অটোমেটেড গেট অপারেশন, ডিজিটাল কাস্টমস ক্লিয়ারেন্স, স্মার্ট লজিস্টিকস সিস্টেম, এসবের মাধ্যমে বন্দরের অপারেশন হবে আরও দ্রুত, স্বচ্ছ ও দক্ষ। একটি সম্পূর্ণ পেপারলেস, স্মার্ট ও প্রযুক্তিনির্ভর বন্দরই আগামী দিনের চাহিদা পূরণ করতে সক্ষম হবে।

 

এই বন্দর শুধু পণ্য খালাস কেন্দ্র হিসেবে নয়, বরং একটি পূর্ণাঙ্গ লজিস্টিক হাব হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। এখানে থাকবে এক্সপোর্ট প্রসেসিং জোন, আধুনিক গুদামঘর, মাল্টিমোডাল ট্রান্সপোর্ট সংযোগ, কাস্টমস, ব্যাংক, ইনস্যুরেন্স ও শিল্পসহায়ক সেবাসমূহ। এতে বিনিয়োগ বাড়বে, কর্মসংস্থান তৈরি হবে এবং দেশের ব্যবসাবান্ধব পরিবেশ আরও দৃঢ় হবে।

 

পরিবেশগত ভারসাম্য রক্ষা করেও উন্নয়ন সম্ভব। নতুন বন্দর নির্মাণে গ্রিন পোর্ট কনসেপ্ট বাস্তবায়ন করতে হবে। সৌরবিদ্যুৎ, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, পানিশোধন, এবং সামুদ্রিক জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের জন্য আলাদা পরিকল্পনা থাকতে হবে। পরিবেশসম্মত ও টেকসই উন্নয়ন ছাড়া কোনো বড় প্রকল্প দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে না। এই প্রকল্প বাস্তবায়নে প্রয়োজন সরকারের বিভিন্ন সংস্থা, বন্দর কর্তৃপক্ষ, বেসরকারি খাত ও সাধারণ জনগণের মধ্যে কার্যকর সমন্বয়। স্বচ্ছতা, জবাবদিহি এবং সময়মতো সিদ্ধান্ত গ্রহণ নিশ্চিত করতে পারলে এই বন্দর হতে পারে দক্ষিণ এশিয়ার নতুন বাণিজ্য কেন্দ্র।

 

১৩৮তম চট্টগ্রাম বন্দর দিবসে তাই আমাদের প্রত্যাশা- বে-টার্মিনাল প্রকল্প হবে কেবল একটি নির্মাণ কাজ নয়, বরং একটি দৃষ্টান্ত, যা আগামী প্রজন্মের জন্য গর্বের, দেশের অর্থনীতির জন্য চালিকাশক্তি এবং আধুনিক বাংলাদেশের প্রতিচ্ছবি হয়ে উঠবে।

 

লেখক: সহ-সভাপতি, বাংলাদেশ ফ্রেইট ফরোয়ার্ডার্স অ্যাসেসিয়েশন (বাফা); পরিচালক, বাংলাদেশ শিপিং এজেন্টস অ্যাসেসিয়েশন এবং সদস্য, জাপান বাংলাদেশ চেম্বার অফ কমার্স এন্ড ইন্ডাস্ট্রি।

 

পূর্বকোণ/ইব

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট