হিমোফিলিয়া মূলত পুরুষদের রোগ হলেও মহিলা ও মেয়েদের মধ্যে হিমোফিলিয়া ছাড়াও ‘ভন উইলিব্র্যান্ড’ ডিজিজ নামক হিমোফিলিয়া সদৃশ এই রোগে অস্বাভাবিক রক্তক্ষরণ হতে পারে। এটি উইমেন উইথ হিমোফিলিয়া বা অন্যান্য বিরল রক্তক্ষরণজনিত রোগের অন্তর্ভুক্ত। শ্রেণিভেদে এই রোগে রক্তের ফ্যাক্টর-৮ এর মাত্রা মেয়েদের হিমোফিলিক স্তরে থাকে বিধায় অনেকে এটিকে উইমেন উইথ হিমোফিলিয়া হিসেবে ভুল করে। তাই এই সব বিরল টাইপ-২এম, টাইপ-২এন, ও টাইপ-৩ ভিডব্লিওডিকে Pseudo Hemophilia বলা যেতে পারে। ভুল ডায়াগনসিস্, পরীক্ষার অপ্রতুলতা, অত্যাধিক ব্যয়, সমাজে অনগ্রসর শ্রেণি হিসেবে মহিলা ও মেয়েরা এর ভুক্তভোগী। তাই তাদের রক্তক্ষরণজনিত এই রোগের চিকিৎসাসচেতনতার জন্য এবারের বিশ্ব হিমোফিলিয়া দিবসের প্রতিপাদ্য হিসেবে স্থান পেয়েছে ‘মহিলা এবং মেয়েদেরও অতিরিক্ত রক্তক্ষরণজনিত রোগ হতে পারে’।
রক্তের হিমোফিলিয়া রোগে আক্রান্ত জনগোষ্ঠী মূলত পুরুষরা হলেও মেয়েরা এর বাহক বলে ধারণা করা হয়। কিন্তু বাহকশ্রেণির মধ্যে রক্তের ফ্যাক্টর-৮ এর ঘাটতি মাত্রা হিমোফিলিয়া স্তরে (<৪০%) পৌঁছালে হিমোফিলিয়ার বাহক মহিলারাও পুরুষের মত আক্রান্ত হতে পারে। তাছাড়া ‘ভন উইলিব্র্যান্ড’ নামক রক্তক্ষরণজনিত রক্তরোগটি ও মূলত উত্তরাধিকার সূত্রে পুরুষ মহিলা নির্বিশেষে আক্রান্ত হতে দেখা যায়। এই সব রক্তক্ষরণজনিত রোগ সঠিকভাবে নির্ণয়ের জটিলতার কারণে নারীরা এগুলো সাধারণ স্ত্রীরোগ হিসেবে প্রতিনিয়ত ভুল চিকিৎসার শিকার হন এবং বেশিরভাগ সময় অস্বাভাবিক জরায়ূ রক্তপাত হিসেবে অপ্রয়োজনীয় শল্যচিকিৎসারও মুখোমুখি হন। এই বিষয়ে ‘উইম্যান ইউথ হিমোফিলিয়া এন্ড ভন উইলিব্যান্ড ডিজিজ’ সম্পর্কে চিকিৎসাকর্মী যথা ডাক্তার, রোগী ও সহায়ক সংশ্লিষ্ট সকলকে সচেতন হওয়া প্রয়োাজন।
হিমোফিলিয়া সেক্স ক্রোমোজম সংশ্লিষ্ট হলেও ‘ভন উইলিব্র্যান্ড ডিজিজ’ হল অটোজোম সংশ্লিষ্ট উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত রক্তক্ষরণজনিত রক্তের আর একটি রোগ। যা সাধারণ জনসংখ্যায় আনুমানিক প্রাদুর্ভাব ০.১ শতাংশ। সহজে এই রোগটি শনাক্ত করা কঠিন। শিশু, নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সকলেই এ রোগে আক্রান্ত হয়। তবে এ রোগের ডায়াগনসিসে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে হয়। দীর্ঘসূত্রতার কারণে এর ডায়াগনসিস বিলম্বিত হয়। ক্ষেত্রবিশেষে রোগীদের জটিলতায়ও পড়তে হয়। শিশুদের সাধারণত নাকে বা অস্বাভাবিক স্থানে রক্তক্ষরণ ও বেশিরভাগ ক্ষেত্রে মহিলাদের অস্বাভাবিক ঋতু¯্রাব ও প্রসবপরবর্তী অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ ‘ভন উইলিব্র্যান্ড’ রোগ নির্ণয়ের সহায়ক উপসর্গ হলেও পুরুষদের শল্যচিকিৎসাপরবর্তী সাধারণত হালকা থেকে মাঝারি ধরনের ও প্রলম্বিত রক্তক্ষরণের মাধ্যমে এর ডায়াগনসিস্ হয়।
আবার কিছু ব্যক্তিদের মধ্যে ‘ভন উইলিব্র্যান্ড’ ফ্যাক্টরের (ভিডব্লিউএফ) উৎপাদন মাত্রা সাময়িক হ্রাস বা ধ্বংসের ফলে স্বল্পতার সৃষ্টি হতে পারে। ফলে এটি সুপ্তাবস্থায় থাকতে পারে। আবার কিছু রক্তরোগ রক্তের মায়েলোপ্রোলিফারেটিভ ডিসর্ডার, ভাল্বজনিত হৃদরোগ, হাইপোথাইরয়েডিজম বা অন্যান্য রোগে ও ভন উইলিব্র্যান্ড ফ্যাক্টর মাত্রা কমে যেতে পারে। সেক্ষেত্রে ‘ভন উইলিব্র্যান্ড’ রোগ হিসেবে ভুল ডায়াগনসিস হতে পারে। ‘ভন উইলিব্র্যান্ড’ রোগের উপসর্গ বেশিরভাগ সময় হিমোফিলিয়া সদৃশ না হলেও কিছু বিরল মারাত্মক শ্রেণি হিমোফিলিয়া হিসেবে ভুল হতে পারে। সেক্ষেত্রে লিঙ্গ রোগ নির্ণয়ের সহায়ক ভূমিকা পালন করে। শরীরের উপরিভাগের অস্বাভাবিক স্থানে শিশুদের যেমন নাকে, কান, দাঁতের মাড়ি নরম কোষ কলায় মেয়েদের ঋতুস্রাবের শুরুতে মহিলাদের প্রসবপরবর্তী এবং পুরুষদের শল্যচিকিৎসাকালীন অস্বাভাবিক রক্তক্ষরণ ‘ভন উইলিব্র্যান্ড’ রোগের প্রধানতম উপসর্গ।
রোগ নির্ণয় ব্যবস্থা : সাধারণ রক্তপরীক্ষা CBC ছাড়াও 1. Bleeding time, 2. Coagulation Profile (APTT/PT) Coagulation Factor assays, 3. VWF Antigen(Cut up 30%)assays, 4. VWFAg Functional assays with Platelets (GpIb/GPIbR/GPIbM), 5. Ristocetin induced Platelet Aggregation assays, 6. Multimar analysis assays এর মত অত্যাধুনিক পরীক্ষার মাধ্যমে এর ডায়াগনসিস করতে হয়। Von Willebrand Disease (ভন উইলিব্র্যান্ড ডিজিজ) : প্রধানত ৩ শ্রেণির। | 1. Type 1 VWD: Quantitative Deficiency (75%) 2.Type 2 VWD : Qualitative Deficiency (15-20%) Sub-Type : (Type2A/Type2B/Type2M/Type2N) 3.Type 3 VWD:VWF এর অনুপস্থিতি বা কিঞ্চিত উপস্থিতি। Type 1 VWD : VWF এর পরিমাণ এখানে স্বাভাবিক মাত্রার তুলনায় কম থাকে। এটি অটোসোমাল ডমিনেন্ট প্রক্রিয়ায় উত্তরাধিকার সূত্রে সঞ্চালিত হয়। রক্তক্ষরণের মাত্রা মৃদু থেকে মারাত্মক হতে পারে। VWD এর শতকরা ৭৫ ভাগই এই টাইপে আক্রান্ত।
চিকিৎসা: DDAVP প্রধানতম চিকিৎসা। Type 2 VWD : (৪টি অধি শ্রেণিতে বিভক্ত) Type 2 VWD: নির্দিষ্ট মাল্টিমারগুলির অভাবে যা প্লেটলেট GPIb রিসেপ্টর সাথে সংযুক্তি কম। ১০-২০ ভাগ এই শ্রেণিভুক্ত। মাঝারি থেকে মারাত্মক রক্তক্ষরণের লক্ষণ। প্রধানত এটি অটোসোমাল রিসিভ। এতে VWFAg এর পরিমাণ থেকে কার্যকর VWF ও উচ্চ মলিকিউল সম্পন্ন মাল্টি মারের পরিমাণ কম থাকে।
চিকিৎসা : 1. DDAVP 2. VWF Concentrate (মাঝারি এবং গুরুতর রোগীদের জন্য) Type 2 B VWD: উচ্চ মলিকুলার VWF মাল্টিমারগুলির প্লেটলেট GPIb রিসেপ্টর সাথে বাড়তি বন্ধনের ফলে রক্তে কার্যকর উচ্চ মাল্টিমারের পরিমাণ হ্রাস পায়। শতকরা ৫ ভাগ এ শ্রেণিতে আক্রান্ত হয়। এটি অটোসোমাল ডমিনেন্ট টাইপ। প্লাটেলেটর পরিমাণ কমে যাবার ফলে আক্রান্তরা মাঝারি থেকে গুরুতর রক্তক্ষরণে আক্রান্ত হয়। VWF এর কার্যকর মাত্রার পরিমাণ বা উপস্থিতির তুলনায় কম। মাল্টিমার ইলেকট্রোফোরেসিস: সাধারণত উচ্চ মলিকুলার মাল্টিমারগুলি কম থাকে।
চিকিৎসা: DDAVPযেটি সতর্কতার সাথে ব্যবহার করা উচিত। এটি সামান্য রক্তপাতের চিকিৎসার ব্যবহার করা যেতে পারে। তবে অনেক বিশেষজ্ঞ সাময়িক প্লেটলেট সংখ্যা হ্রাসের জন্য ডিডিএভিপি এড়িয়ে চলেন। মাঝারি এবং গুরুতর রোগীদের জন্য VWF কনসেন্ট্রেট ব্যবহার করা হয়। Type 2 M VWD: VWF প্লেটলেট GPIb রিসেপ্টরের সাথে সংযুক্তি কম। অস্বাভাবিক রক্তক্ষরণ মাঝারি থেকে মারাত্মক মাত্রার হয়। উত্তরাধিকার সূত্রে এটি অটোসোমাল ডমিনেন্ট বা রিসিসিভ উভয়ই হতে পারে। কার্যকর VWF দৃশ্যমান উপস্থিতির তুলনায় কম। ফ্যাক্টর VIII কার্যকারিতা স্বাভাবিক বা কম। সব ধরনের মাল্টিমারের উপস্থিতি এখানে সমহারে কম থাকে।
চিকিৎসা: ডিডিএভিপি (DDAVP) মাঝারি এবং গুরুতর রোগীদের জন্য :WWF কনসেন্ট্রেট। Type 2N VWD: ফ্যাক্টর VIII এর সাথে VWF এর সংযুক্তি অস্বাভাবিক হ্রাস পায়। ফলে ফ্যাক্টর VIII অস্বাভাবিক পরিমাণ কম (৫ থেকে ১৫%)। লক্ষণ সমূহ হিমোফিলিয়া সদৃশ। রক্তক্ষরণের লক্ষণ গভীর নরম কোষগুলো ও মিউকাস মেমব্রেন তথা মূত্রথলি বা অন্ত্রের মধ্যে হতে পারে। এটি অটোসোমাল রিসিসিভ প্রক্রিয়ায় সঞ্চালিত হয়। কার্যকর VWF এবং পরিমাণ স্বাভাবিক নয়।
চিকিৎসা: DDAVP I VWF কনসেন্ট্রেট Type 3 VWD : এটি সচরাচর দেখা যায় না। এখানে VWF এর উপস্থিতি থাকে না বা মারাত্মক মাত্রায় কম থাকে। হিমোফিলিয়া ‘এ’ এর অনুরূপ এটি হিমোফিলিয়া হিসেবে ভুল ডায়াগনসিস হতে পারে। গভীর মাংস পেশীসহ মিউকোকিউটেনিয়াস রক্তক্ষরণ উভয়ই হতে পারে। অটোসোমাল রিসিসিভ উত্তরাধিকার সূত্রে এটি সঞ্চালিত হয়। VWF কার্যকারিতা এবং পরিমাণ উভয়ই এখানে অনুপস্থিত বা মারাত্মকভাবে কম। ফ্যাক্টর VIII স্তরের মাত্রা ও কম (১ থেকে ১০%)। VEF মাল্টিমার দৃশ্যত অনুপস্থিত।
চিকিৎসা: VWF কনসেন্ট্রেট ফ্যাক্টর VIII Concentratre প্রতিস্থাপন। DDAVP এখানে কার্যকর নয়। Von Willebrand disease সহ অন্যান্য রক্ত রোগের এইসব উন্নত পরীক্ষা সমূহের জন্য প্রয়োজন দক্ষ জনবল এবং মানসম্পন্ন যন্ত্রপাতি। যেটি আমাদের দেশে এখনোও গড়ে ওঠেনি। অধিকন্তু রক্ষনশীল সমাজে আক্রান্ত নারীদের এতদূর পর্যন্ত আসা সুদূরপরা হত। যার ফলে রোগ নির্ণয়ের ভুল অপরিপূর্ণ তার স্বীকার নারীদের স্বাস্থ্য সুরক্ষার জন্য এইসব সচেতনতা সময়ের দাবি রাখে। হিমোফিলিয়া, ভন উইলিব্র্যান্ড রোগ ছাড়াও উত্তরাধিকার জনিত প্লাটেলেটের অস্বাভাবিকতা (IPFD)সম্পন্ন রক্তের রক্তক্ষরণ জনিত ডায়াগনসিসের অন্তরালে থাকা এইসব রোগসমূহ মৃদু থেকে মারাত্মক পরিস্থিতির নিয়ন্ত্রন ও কার্যকর চিকিৎসা এখন কম সুবিধা ভোগী নারী শ্রেণির সময়ের দাবি। VWD: Von Willebrand Disease (ভন উইলিব্র্যান্ড ডিজিজ) RIPA: Ristocetein Induced Platelet Aggregation. DDAVP:1 De amino 8 de argino vasopressin .
লেখক: প্রাক্তন অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, হেমাটোলজি (রক্ত ও রক্তরোগ বিভাগ) চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল।
পূর্বকোণ/ইব