দ্বিতীয় পর্ব। ভূমিকম্প মূলত পৃথিবীর টেকটনিক প্লেটের নড়াচড়ার কারণে ঘটে থাকে। পৃথিবীর অভ্যন্তরীণ ভূত্বক কয়েকটি ছোট এবং বড় স্তর বা আবরণের মাধ্যমে গঠিত হয়েছে। পৃথিবীর ভূত্বকের এই স্তরগুলোর অস্বাভাবিক নড়াচড়ার কারণে ভূত্বকের উপরিভাগে একধরনের কম্পন সৃষ্টি হয়, যাকে আমরা ভূমিকম্প বলে অভিহিত করে থাকি।
বিজ্ঞানীরা বলছেন, সারা পৃথিবীতে বছরে গড়ে ছয় হাজার ভূমিকম্প হয়। এগুলোর বেশিরভাগই মৃদু, যেগুলো আমরা টের পাই না। সাধারণত তিন ধরনের ভূমিকম্প হয়ে থাকে, প্রচণ্ড, মাঝারি ও মৃদু। আবার উৎসের গভীরতা অনুসারে ভূমিকম্পকে তিন ভাগে ভাগ করা যায়, অগভীর, মধ্যবর্তী ও গভীর ভূমিকম্প। ভূমিকম্পের কেন্দ্রস্থল ভূ-পৃষ্ঠের ৭০ কিলোমিটারের মধ্যে হলে অগভীর, ৭০ থেকে ৩০০ কিলোমিটারের মধ্যে হলে মধ্যবর্তী এবং ৩০০ কিলোমিটারের নিচে হলে তাকে গভীর ভূমিকম্প হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। সাধারণত তিনটি প্রধান কারণে ভূমিকম্পের উৎপত্তি হয়ে থাকে- ভূ-পৃষ্ঠের হঠাৎ পরিবর্তনজনিত কারণে, আগ্নেয়গিরি সংঘটিত হওয়ার কারণে ও শিলাচ্যুতিজনিত কারণে।
বাংলাদেশে ইতোমধ্যে মৃদু ও মাঝারি মাত্রার বেশ কয়েকটি ভূমিকম্প অনুভূত হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা এ ধরনের ভূমিকম্পকে বাংলাদেশের জন্য ‘রেড সিগন্যাল’ হিসেবে বিবেচনা করছেন। তাদের মতে, এসব ভূমিকম্প সতর্কবার্তা। এ ধরনের মাঝারি ভূমিকম্পে বড়ধরনের বিপদ হতে পারে, এবং বড়ধরনের ভূমিকম্পের পরিণতি এতটা ভয়াবহ হতে পারে, যা আমাদের কল্পনাতীত। সাধারণত ৭ মাত্রার ভূমিকম্পকে বড়ধরনের ভূকম্পন হিসেবে ধরা হয়। আর ৮ মাত্রার বেশি ভূমিকম্পকে বিবেচনা করা হয় বড় দুর্বিপাক হিসেবে, যার ফল হবে মারাত্মক। আবার ভূকম্পনের স্থায়িত্বের ওপরও নির্ভর করে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ। ভূমিকম্প যত বেশি সময় স্থায়ী হবে ধ্বংসযজ্ঞের পরিমাণও তত বৃদ্ধি পাবে।
তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কম্পনের মাত্রা এবং স্থায়ীত্বের পাশাপাশি মাটির নিচে কোথায় কম্পন হয় সেই স্থানটির অবস্থানও ধ্বংসের পরিমাণ নির্ধারণের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। ভূকম্পনের স্থানটির গভীরতা কম হলে ভূমিকম্পের শক্তি ও কাঁপন প্রশমিত করার মতো মাটি ওপরে কম থাকার কারণে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণও অধিক হবে। প্যাসিফিক নর্থওয়েস্ট সিসমিক নেটওয়ার্কের মতে, ভূমিকম্প মাত্র কয়েক সেকেন্ড স্থায়ী হয়ে থাকে। তবে মাঝারি ও উচ্চমাত্রার ভূমিকম্প কয়েক মিনিট ধরে চলতে পারে। ২০০৪ খ্রিস্টাব্দে সুমাত্রা ও আন্দামানের কাছে ভারত মহাসাগরে ৯ দশমিক ১ মাত্রার ভূমিকম্পের ফলে সৃষ্ট প্রবল জলোচ্ছ্বাসে ১৪টি দেশে প্রায় ২ লাখ ৩০ হাজার মানুষ মারা যায়। তবে ভূমিকম্পে জানমালের ক্ষয়ক্ষতি কম-বেশি নির্ভর করে ভবনের স্থায়িত্বের শক্তির ওপরও। কেননা ভবন ধসেই জানমালের ক্ষয়ক্ষতি বেশি হয়। ভূমিকম্প সহনশীল ভবন বা অবকাঠামো সহজে ধ্বসে পড়ে না। এ ধরনের অবকাঠামো ভূমিকম্পের কারণে সৃষ্ট শক্তি পুরোটাই শোষণ করে নিতে পারে। এসব বিষয় আমাদের অনেকেরই জানা। কিন্তু দুঃখজনকভাবে আমাদের অবকাঠামোগুলোকে ভূমিকম্প সহনীয় করে গড়ে তোলার ক্ষেত্রে আমরা এখনো দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিতে পারছি না।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে ভূমিকম্পের মতো দুর্যোগে বিশ্বের অন্যতম ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চলের কাতারে রয়েছে বাংলাদেশ; বিশেষ করে রাজধানী শহর ঢাকা ও জাতীয় অর্থনীতির প্রাণকেন্দ্র চট্টগ্রাম। গবেষকের মতে, ভূতাত্ত্বিক ও টেকনোটিক কাঠামো অনুযায়ী বাংলাদেশ তিনটি গতিশীল প্লেটের সংযোগস্থলে অবস্থিত। একটা ইন্ডিয়া প্লেট এবং এর পূর্বে বার্মা প্লেট ও উত্তরে ইউরেশিয়ান প্লেট। ইন্ডিয়া ও বার্মা প্লেটের সংযোগস্থল বাংলাদেশের সুনামগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ হাওর হয়ে মেঘনা দিয়ে বঙ্গোপসাগর হয়ে সুমাত্রা পর্যন্ত চলে গেছে। ভূমিকম্প কখনো যদি বাংলাদেশমুখী প্লেটে ঘটে তাহলে এক অকল্পনীয় পরিস্থিতির উদ্ভব হতে পারে। আবার বাংলাদেশসহ ভারত ও মিয়ানমারের কিছু অংশজুড়ে সুবিশাল চ্যুতি থাকায় একটি দেশে ভূমিকম্প হলে তার পাশের দেশে যে কোনো মুহূর্তে উচ্চমাত্রার ভূমিকম্প হতে পারে বলেও আশঙ্কা করছেন ভূ-বিজ্ঞানীরা।
গত ২৮ মার্চ ২০২৫, অভিন্ন সময়ে মিয়ানমারের সঙ্গে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ছয়টি দেশে হওয়া ভূমিকম্প প্রমাণ করে বাংলাদেশ উচ্চমাত্রার ভূমিকম্প ঝুঁকিতে রয়েছে। তবে এ ধরনের ভূমিকম্পের প্রধান ধ্বংসক্ষেত্র হওত পারে সিলেট, চট্টগ্রাম ও ঢাকা মহানগরী। এরপর মাঝারি ঝুঁকিতে রাজশাহী ও ঢাকা বিভাগ এবং কম ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় খুলনা ও বরিশাল বিভাগ। বলা হয়, প্লেটের সংযোগস্থলে ৮০০ থেকে ১০০০ বছর আগে ভূমিকম্প হওয়ার ফলে এ অংশে যে শক্তি জমা রয়েছে, সেটা একসঙ্গে বের হলে ৮ দশমিক ২ স্কেলের ভূমিকম্প হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। তবে শক্তি একবারে বের না হয়ে আংশিক বের হলে ভূমিকম্পের মাত্রা হবে কম।
প্রসঙ্গত, সিলেট থেকে চট্টগ্রাম বা কক্সবাজার পর্যন্ত জোনকে বলা হয় সাবডাকশন জোন। সাবডাকশন বলতে একটা প্লেটের নিচে আরেকটা প্লেট তলিয়ে যাওয়া বোঝায়। ভূ-তত্ত্ববিদদের মতে, আমাদের এখানে সাবডাকশন জোনে ইন্ডিয়ান প্লেট বার্মার প্লেটের নিচে তলিয়ে যাচ্ছে। তাদের মতে, পৃথিবীব্যাপীই ভূমিকম্পের জন্য কুখ্যাত সাবডাকশন জোন। ২০১৬ খ্রিস্টাব্দে নেচার জিও সায়েন্সে প্রকাশিত এক গবেষণায় ১২ বছরের উপাত্ত বিশ্লেষণ করে বলা হয়েছে, যে পরিমাণ শক্তি সাবডাকশন জোনে জমা হয়ে আছে তা থেকে ৮.২ থেকে ৯ মাত্রার ভূমিকম্প হতে পারে যেকোনো সময়। এই সঞ্চিত বিপুল শক্তি একবারেও বের হতে পারে, আবার আংশিকভাবে বারবারও হতে পারে। তবে পৃথিবীর সাবডাকশন জোনে যেসব ভূমিকম্প হয়ে থাকে সেগুলো সাধারণত ৬৫ থেকে ৮০ শতাংশ শক্তি একবারে বের হয়ে যায়। সাবডাকশন জোনের ভূমিকম্পগুলো খুব ধংসাত্মক হয়ে থাকে। আমাদের সাবডাকশন জোন সক্রিয় এবং এখানে প্রচুর পরিমাণ শক্তি জমা হয়ে আছে। এই সঞ্চিত শক্তি কোনো না কোনো সময় বের হতেই হবে। এর কোনো বিকল্প নেই।
উল্লেখ্য, গোটা পৃথিবীর ভূত্বক কয়েকটি ছোট-বড় প্লেটে বিভক্ত। এর মধ্যে রয়েছে সাতটা মহাদেশীয় প্লেট এবং বেশ কয়েকটি তুলনামূলক ছোট প্লেট। ভারতীয় উপমহাদেশীয় প্লেট এদের মধ্যে অন্যতম। এসব প্লেট কিন্তু একেবারে স্থির নয়। খুব ধীরে হলেও এগুলো চলতে থাকে। চলতে চলতে কখনো একে অন্যের সঙ্গে ধাক্কাও লাগে। যেমন ভারতীয় উপমহাদেশীয় প্লেট একসময় আফ্রিকার কাছাকাছি ছিল। ধীরে ধীরে এটা এশিয়ার দিকে সরে আসে, একসময় এশীয় প্লেটের সঙ্গে ধাক্কা লেগে এর সঙ্গে যুক্ত হয়। প্লেটগুলো কাছাকাছি এসে একে-অন্যের কিছুটা ওপরেও চলে আসতে পারে। তাই বলে সারাজীবন একটা প্লেট আরেকটা প্লেটের ওপরে চড়ে বসে থাকবে তা তো হবে না। প্রাকৃতিক কারণেই তাকে সরে আসতে হবে। আর এই সরে আসার চেষ্টা যখন চলে, তখনই ভূমিকম্প হয়।
আমাদের দেশে যেসব ভূমিকম্প হচ্ছে এর কারণ টেকটনিক প্লেট। উপমহাদেশীয় প্লেটের সঙ্গে এশীয় প্লেটের সংস্পর্শ আর সরে যাওয়ার প্রক্রিয়া চলছে বলেই এত ভূমিকম্প এখন দেখা যাচ্ছে এ অঞ্চলে। কিন্তু দুঃখজনকভাবে ভূমিকম্প মোকাবিলায় আমাদের প্রস্তুতি নেই বললেই চলে। বিভিন্ন গবেষণারিপোর্ট বলছে, দেশের সীমান্তের পার্শ্ববর্তী কিছু অঞ্চল ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল হওয়ার দরুন আমাদের বিপদের মাত্রা সব সময়ই বহুগুণ বাড়তি। এর সঙ্গে রয়েছে ব্যাপক হারে অনিয়ন্ত্রিত এবং অপরিকল্পিতভাবে অবকাঠামো নির্মাণ, অপরিকল্পিত নগরায়ণ, বিল্ডিংকোড না মানা। অন্যান্য দুর্যোগ অপেক্ষা অনেকটাই ভিন্নতর ভূমিকম্প মোকাবেলায় আমাদের দেশের সক্ষমতা এখনো বলার মতো পর্যায়ে নেই। আধুনিক প্রযুক্তির পাশাপাশি রয়েছে পর্যাপ্ত ও দক্ষ জনবলের ঘাটতি। ভূমিকম্পপরবর্তী পরিস্থিতি কিংবা এ ধরনের দুর্যোগের ক্ষয়ক্ষতি মোকাবেলায় ১৩টি সংস্থা বিদ্যমান থাকলেও এখন পর্যন্ত তাদের মধ্যে কারিগরি সক্ষমতার ঘাটতির পাশাপাশি পারস্পরিক সমন্বয়েরও অভাব রয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভৌগোলিক অবস্থানগত দিক থেকে ভূমিকম্পের উচ্চঝুঁকিতে রয়েছে জাতীয় অর্থনীতির মূল নিয়ন্ত্রক বন্দরনগরী চট্টগ্রাম। কারণ মিয়ানমার-বাংলাদেশ সীমান্তে ভূগর্ভস্থ যে তিনটি ফল্ট লাইন আছে সেখান থেকে চট্টগ্রামের দূরত্ব খুবই কম। আবার চারটি বিপজ্জনক ফাটল লাইন রয়েছে চট্টগ্রামের ভূস্তরে। চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (চুয়েট) ভূমিকম্প গবেষণা কেন্দ্রের উদ্যোগে বিভিন্ন সময়ে পরিচালিত জরিপের তথ্য অনুযায়ী, ভূ-স্তরের পাটাতনে ফাটলের ইউরোশিয়ান ও ইন্দো-অস্ট্রেলিয়ান প্লেটের ভূ-অবস্থানগত ভূমিকম্পের জোনের মধ্যেই রয়েছে চট্টগ্রাম। এ প্লেট দুইটি অতিমাত্রায় সক্রিয় হয়ে উঠেছে। এ কারণে ঘন ঘন হালকা থেকে মাঝারি মাত্রায় ভূমিকম্প হচ্ছে চট্টগ্রামে। যে কোনো সময় প্রবল ভূমিকম্প হলে বহু গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা ধসে পড়বে।
চুয়েটের গবেষণাতথ্য মতে, চট্টগ্রাম অঞ্চলে সীতাকুণ্ড থেকে টেকনাফ ফল্ট (ভূ-ফাটল) লাইন, চট্টগ্রাম ফল্ট লাইন এবং রাঙ্গামাটির বরকলের ফল্ট লাইন রয়েছে। চট্টগ্রামের মীরসরাই থেকে টেকনাফ পর্যন্ত দীর্ঘ ভূ-ফাটল লাইন থেকে যে কোনো সময় ৬, ৭, ৮ বা ৯ এর বেশি মাত্রায় ভূমিকম্প হতে পারে। অপরিকল্পিত নগরায়ন এবং বিল্ডিং কোড না মানাসহ নানাকারণে এ ধরনের ভূমিকম্পে গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা ধ্বংসসহ লাখো মানুষের প্রাণহানিরও আশঙ্কা আছে। প্রসঙ্গত, সমন্বিত দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কর্মসূচির (সিডিএমপি) আওতায় পরিচালিত ডিজিটাল জরিপের প্রতিবেদনে চট্টগ্রাম শহরের এক লাখ ৮০ হাজার ভবনের মধ্যে এক লাখ ৪২ হাজার আবাসিক-ব্যবসা-বাণিজ্যিক ভবনকে উচ্চমাত্রার ভূমিকম্পে ঝুঁকিপূর্ণ উল্লেখ করে বলা হয়েছে, রিখটার স্কেলে সাত থেকে আট মাত্রার মধ্যে ভূমিকম্প সংঘটিত হলে সেসব ভবন কম-বেশি ধ্বংসস্তূপে পরিণত হতে পারে।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, নগরীতে শতকরা ৭৮ ভাগ ভবন ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড এবং সিডিএ’র অনুমোদিত নক্শা লঙ্ঘন করে অপরিকল্পিত ও ত্রুটিপূর্ণভাবে নির্মাণ করা হয়েছে। বিদ্যুৎকেন্দ্রসহ অন্যান্য স্থাপনায়ও কোনও ভূমিকম্প প্রতিরোধক ব্যবস্থা নেই। দীর্ঘদিন ধরে ভূমিকম্প সহনশীল ভবন নির্মাণ নিয়ে দেশে অনেক কথাই হয়েছে, সরকারের কাছে সুপারিশ জমা পড়েছে, কিছু ক্ষেত্রে সিদ্ধান্তও হয়েছে; তারপর ফের শুরু হয় দিবানিদ্রাকাল। ইমারত নির্মাণ বিধিমালা ১৯৯৬, বাংলাদেশ ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড (বিএনবিসি) ২০০৬, মহানগর ইমারত (নির্মাণ, উন্নয়ন, সংরক্ষণ ও অপসারণ) বিধিমালা ২০০৮ এককথায় ‘কেতাবি’ নথির কমতি নেই। কিন্তু সবই যেন কথামালা! এখনো বিধিমালা ভেঙে ভবন গড়া হচ্ছে প্রতিদিন। কিন্তু সে ব্যাপারে চউক’র তৎপরতা নেই। বিশ্বের ভূমিকম্পপ্রবণ দেশগুলো যখন এ বিষয়ে সদাসতর্ক এবং স্থাপনা নির্মাণে কম্পন সহনশীলতার আধুনিক প্রযুক্তি মেনে চলছে, আমরা তখন ভেসে চলেছি গড্ডলিকাপ্রবাহে। যখন দুর্যোগ নেমে আসে তখন শুরু হয় দৌড়ঝাঁপ। তারপর কুম্ভকর্ণের ঘুম। স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার অভাব, আলস্য আর দুর্নীতির সংস্কৃতিই এ জন্যে দায়ী। এ প্রবণতা বড়ই ভয়ংকর।
উল্লেখ্য, জাপান, চিলিসহ বিভিন্ন ভূমিকম্পপ্রবণ দেশে বছরে বহুবার ভূমিকম্পের ঘটনা ঘটে। কিন্তু সেসব দেশে বিপুল ক্ষয়ক্ষতি এড়ানো সম্ভব হয় বিল্ডিং কোড মেনে স্থাপনা তৈরির কারণে। আবার অনেক দেশে সামান্য মাত্রার ভূমিকম্পেও বিপুল ক্ষয়ক্ষতি হয় বিল্ডিং কোড মেনে স্থাপনা তৈরি না করার কারণে। আর বাংলাদেশের অবস্থান যেহেতু ভূমিকম্পপ্রবণ এলাকায়, সেহেতু বড় ও মাঝারি ধরনের ভূমিকম্প মোকাবিলার প্রস্তুতি না থাকলে তুরস্ক, নেপাল বা মিয়ানমারের মতো বিপর্যয় বাংলাদেশের জন্যও অনিবার্য হয়ে উঠতে পারে। মনে রাখা দরকার, দেশের উত্তরে দুইটি ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল রয়েছে, যা খুবই বিপজ্জনক এবং পূর্বের পাহাড়ি অঞ্চল মণিপুর, মিজোরাম, মিয়ানমার এখানেও ভূমিকম্পের উৎসস্থল রয়েছে। উত্তর থেকেও যেমন ঝুঁকি রয়েছে, পূর্বদিক থেকেও একইধরনের ঝুঁকি রয়েছে আমাদের জন্য।
এ অবস্থায় ভূমিকম্প মোকাবিলায় ব্যাপক পূর্বপ্রস্থতি জরুরি। ভূমিকম্প বিষয়ক সচেতনতা এবং ভূমিকম্প সহনশীল অবকাঠামো তৈরি, পরিকল্পিত নগরায়ন, কোড মেনে স্থাপনা নির্মাণ, জলাশয় ভরাট ও পাহাড়কাটা বন্ধ করাসহ সবকিছুই করতে হবে। আয়ত্তে আনতে হবে উদ্ধার কাজের জন্য প্রয়োজনীয় প্রযুক্তিও। দরকার ব্যাপকসংখ্যক স্বেচ্ছাসেবীর প্রশিক্ষণও। দুর্যোগকালে করণীয় সম্পর্কে সাধারণ মানুষকে সচেতন করার কর্মসূচিও থাকতে হবে। আর যেহেতু বাংলাদেশের শহর ও অবকাঠামোগুলোকে রাতারাতি পরিবর্তন করা সম্ভন নয়। তাই এই মুহূর্ত থেকেই মানুষকে ভূমিকম্পের সময় করণীয় সম্পর্কে সচেতন করতে হবে এবং নিয়মিত মহড়ার আয়োজন করতে হবে। (সমাপ্ত)
পূর্বকোণ/ইব