আমেরিকা বাংলাদেশি পণ্যের উপর ৩৭% শুল্ক আরোপ করেছে। শুধু বাংলাদেশ নয়, বলতে গেলে কমবেশি পৃথিবীর সব দেশের উপরই শুল্ক আরোপ করেছে আমেরিকা। কিন্তু কেন? তারা বলছে তাদের অনেক বাণিজ্য ঘাটতি আছে, শুল্ক বসিয়ে তারা এই ঘাটতি শূণ্যের কোঠায় নিয়ে আসবে।
শুল্ক আরোপ করে ঘাটতি পূরণ করা যায় কিনা সেই তর্কে না গিয়ে একটা প্রশ্ন করা যায়; আমেরিকার এত বাণিজ্য-ঘাটতি কেন? এর মূল কারণ হচ্ছে আমেরিকা তাদের ডলারকে সারা দুনিয়ার রিজার্ভ কারেন্সি করেছে। মানে সবাই বাণিজ্যিক লেনদেনে আমেরিকার ডলার ব্যবহার করবে। এতে সমস্যাটা কোথায়?
সমস্যাটা বুঝতে হলে আমাদের বুঝতে হবে আমরা টাকা বলতে যা বুঝি তার মূল্য কিভাবে নির্ধারিত হয়। ধরা যাক ৫০০০ টাকার একটা নোট। এই নোট বানাতে হয়তো ২ টাকা খরচ হয়েছে। এটার মূল্য ৫০০০ হয় কিভাবে? কয়েকটা কারণ আছে।
– একটা বিশেষ অথরিটি (সরকার, বাংলাদেশ ব্যাংক) বলছে এটার মূল্য ৫০০০ টাকা।
– আমরা সবাই তা বিশ্বাস করেছি।
– এ কারণে এই কাগজের টুকরোটার চাহিদা আছে, মানে ওটাকে আমরা চাই।
– বাজারে যে পরিমান চাহিদা আছে সেই পরিমাণ নোট থাকতে হবে। বেশি নোট থাকলে মুদ্রাস্ফীতি হবে, মানে সেই টাকার নোটের মূল্য ৫০০০ এর চেয়ে কম হবে; কম থাকলে মানুষ অসুবিধায় পড়বে।
সবসময় কিন্তু কাগজের টাকা ছিল না, সোনা, রুপা ইত্যাদির মুদ্রা ছিল। সেই সময় ৫০০০ টাকার একটা মুদ্রায় ৫০০০ টাকা মূল্যের সোনা বা রুপা থাকতো। একসময় মানুষ ভাবলো- সোনা-রুপার বদলে কাগজের টাকা ছাপানো অনেক সহজ। কিন্তু মানুষকে বিশ্বাস করাতে হবে যে ৫০০০ টাকার নোট দিয়ে সে সমপরিমাণ সোনা, রুপা, ধান, তেল বা গরু পাবে। এভাবে চালু হলো আধুনিক টাকা।
১৯৪৫ সাল। মিত্রশক্তি যুদ্ধে জিতেছে। তারা (আমেরিকা, ফ্রান্স, ইউকে, সোভিয়েত ইউনিয়ন) ভাবলো আন্তর্জাতিক বাণিজ্যিক লেনদেনের জন্য একটা টাকা বা রিজার্ভ কারেন্সি বানাতে হবে, যার নাম হবে BANCOR। আমেরিকা বললো, ‘নতুন কিছু করার কী দরকার, আমাদের ডলার হবে রিজার্ভ কারেন্সি।’ সবাই বললো, ‘ওমা এটা কেমন কথা, তোমরা তো সব সুবিধা পেয়ে যাবে।’ আমেরিকা বললো, ‘আমরা নিজেদের খুশিমতো ডলার ছাপাবো না, আমাদের কাছে যে পরিমাণ সোনা আছে সেই পরিমাণ ডলার প্রিন্ট করবো। তোমরা যদি আমার কাছে ১০ ডলার এনে বলো, আমাকে ১০ ডলার পরিমাণের সোনা দাও, আমরা দিয়ে দেবো।’ এটাকে বলে Dollar Backed By Gold। সবাই রাজি হলো।
আমেরিকা তো ভদ্র দেশ। তাদের ভিয়েতনাম বা কোরিয়ায় গিয়ে যুদ্ধ করে মানুষ মারতে হয়, ৮০টার মতো দেশে সামরিক ঘাঁটি রাখতে হয়, ইসরায়েলের মতো দেশকে পুষতে হয়, নিজেদের দেশে মেডিকেড, মেডিকেয়ার এবং অন্যান্য খরচ করতে হয়। এসব খরচের জন্য যে পরিমাণ ডলার দরকার সেই পরিমাণ সোনা তো তাদের কাছে নেই। তাহলে কী করা যায়? ১৯৭০ সালে আমেরিকা অনেক ভেবেচিন্তে বললো, ‘আমাদের ডলারের সাথে আমাদের কী পরিমাণ সোনা আছে তার কোন সম্পর্ক থাকবে না।’ তাহলে ডলারের সত্যিকারের মূল্য মানুষ কীভাবে বুঝবে? মানুষ ডলার রিজার্ভ কারেন্সি হিসেবে ব্যবহার করবে কেন? ওটার ডিমান্ড কীভাবে থাকবে?
আমেরিকা একটা বুদ্ধি করলো। তারা ভাবলো দুনিয়ার মানুষ কী চায়। তেল চায়, তেল ছাড়া দুনিয়া অচল। তেল যদি ডলারে কেনাবেচা হয় তবে ডলারের ডিমান্ড থাকবে আমরা উপরে দেখেছি ডিমান্ড থাকাটা আবশ্যিক শর্ত)। তেল কাদের আছে? সৌদি আরব আর তার কিছু প্রতিবেশীর। আমেরিকা সৌদি আরবকে বললো, ‘তোমরা ডলার ছাড়া তেল বিক্রি করবে না, বিনিময়ে আমরা তোমার সিংহাসন রক্ষা করবো।’ সৌদি আরবের রাজবংশ তো বেশ ধর্মপরায়ণ, তারা মুসলমানদের এবং পৃথিবীর মানুষের ভালো চায়, তারা ফিলিস্তিনি মানুষের মুক্তি চায়; অতএব তারা ঠিক করলো নিজেদের স্বার্থ বিসর্জন দিয়ে তারা সা¤্ররাজ্যবাদী আমেরিকার স্বার্থ দেখবে। তারা আমেরিকার প্রস্তাবে সম্মত হলো। শুরু হলো পেট্রোডলারের যুগ। আমেরিকার ডলারের ডিমান্ড বজায় থাকলো।
টিকে গেলো আমেরিকার ডলার। বিনিময়ে সৌদি রাজবংশ ক্ষমতা আর অশ্লীল বিলাসিতা টিকিয়ে রাখলো। কিন্তু শুধু পেট্রোডলার দিয়ে কি আমেরিকার ডলার রিজার্ভ কারেন্সি হিসেবে টিকিয়ে রাখা সম্ভব? ডিমান্ড বজায় রাখা সম্ভব? পেট্রোডলার কীভাবে ডলারের গ্লোবাল রিজার্ভ কারেন্সি স্ট্যাটাস বজায় রাখতে সাহায্য করে সেটা মোটামুটি পরিষ্কার। কিন্তু এটা দিয়ে আমেরিকার বাণিজ্য ঘাটতির ব্যাপারটা পরিষ্কার হয় না এবং ডলারের স্ট্যাটাস বজায় রাখতে বাণিজ্য-ঘাটতির প্রয়োজনীয়তা বোঝা যায় না। ব্যাপারটা বুঝতে আমরা বাংলাদেশ দিয়ে শুরু করতে পারি।
সরকার বলছে, আমাদের রিজার্ভ আছে ২৫ বিলিয়ন ডলার। এই ডলার বাংলাদেশ কোথা থেকে পেয়েছে? বোঝার সুবিধার জন্য ধরে নিলাম, নেপালের সাথে বাণিজ্য করে পেয়েছে। নেপাল কীভাবে পেয়েছে? ধরে নিলাম, ভারতের সাথে বাণিজ্য করে পেয়েছে। ভারত কোথা থেকে পেয়েছে? আমরা যদি এভাবে এগোতে (বা পেছাতে) থাকি তবে দেখতে পাবো এই ডলারের আল্টিমেট সোর্স হচ্ছে আমেরিকা; কারণ আমেরিকান ডলার শুধু আমেরিকায় উৎপত্তি হতে পারে। এভাবে বিশ্ব-অর্থনীতিতে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার ছড়িয়ে আছে, যার আল্টিমেট সোর্স হচ্ছে আমেরিকা।
এই ডলার কি আমেরিকা সবাইকে ধার হিসেবে দিয়েছে? না। বিশ্ব-বাজারে ডলার ছড়িয়ে দেয়ার একমাত্র উপায় হচ্ছে বাণিজ্য। আমেরিকার বাণিজ্য বাকি দুনিয়ার সাথে। ধরা যাক, আমেরিকা বাংলাদেশকে ১০০ ডলারের জিনিস বিক্রি করে। বাংলাদেশ যদি আমেরিকাকে ১০০ ডলারের জিনিস বিক্রি করে তবে কারও বাণিজ্য-ঘাটতি হয় না। কিন্তু এই অবস্থায় বাংলাদেশের হাতে কোন ডলার থাকে না। বাংলাদেশের হাতে ডলার আসার একমাত্র উপায় হচ্ছে, আমেরিকা বাংলাদেশের কাছ থেকে ১০০ ডলারের বেশি পরিমাণ জিনিস কিনবে। মানে বাংলাদেশের সাথে আমেরিকার বাণিজ্য-ঘাটতি থাকবে। এভাবে সারা দুনিয়ায় ডলার ছড়িয়ে দেয়ার একমাত্র উপায় হচ্ছে সারা দুনিয়ার সাথে আমেরিকার বাণিজ্য-ঘাটতি থাকবে। আমেরিকা কিনবে বেশি, বিক্রি করবে কম। আর সারা দুনিয়ায় ডলার ছড়িয়ে না দিলে ডলারের গ্লোবাল রিজার্ভ কারেন্সি স্ট্যাটাস থাকে না।
সময়ের সাথে বাকি দুনিয়া ধনী হচ্ছে, তাদের হাতে আরও বেশি ডলার জমছে এবং তার ফলে আমেরিকার বাণিজ্য-ঘাটতি বাড়ছে। এটাকে বলে Current Account Deficit। এর ফলে আমেরিকার অর্থনীতিতে চাপ সৃষ্টি হচ্ছে। ১৯৬০’র দশকে অর্থনীতিবিদ Robert Triffin এই মাইনকার প্যাঁচটা ধরিয়ে দেন, তাই এই প্যাঁচকে বলা হয় Triffin dilemma।
এই প্যাঁচ থেকে আমেরিকা বের হচ্ছে না কেন? কারণ ডলারের রিজার্ভ কারেন্সি স্ট্যাটাস বজায় রেখে বের হবার কোন পথ নেই। ডলারের রিজার্ভ কারেন্সি স্ট্যাটাস কি রাখতেই হবে? না রাখলে আমেরিকা তার সাম্রাজ্য বজায় রাখার বড় দুটো হাতিয়ারের একটা হারাবে (আরেকটা হচ্ছে সামরিক শক্তি)।
আরও পড়ুন: ট্রাম্পের জন্মসূত্রে নাগরিকত্ব বাতিলের আদেশ চ্যালেঞ্জ: ২২ অঙ্গরাজ্য ও ২ শহরের মামলা
আপাতত ট্রাম্প শক্তি প্রয়োগের ভয় দেখিয়ে অন্যদের কাছ থেকে জোর করে টাকা আদায় করে ক্ষয়রোধ করার চেষ্টা করছেন। ট্রাম্পের প্ল্যান এই রকম।
– সবাইকে আমেরিকার জিনিস বেশি করে কিনতে হবে। বাংলাদেশের দুটোর বেশি প্লেন না লাগলেও পাঁচটা কিনতে হবে। তুলা কিনতে হবে, বেশি দাম দিয়ে হলেও গ্যাস কিনতে হবে।
– প্রত্যেকটা দেশের সামরিক ব্যয় বাড়াতে হবে এবং সামরিক সরঞ্জাম আমেরিকার কাছ থেকে কিনতে হবে।
– আমেরিকায় গিয়ে নিজের খরচে কারখানা স্থাপন করতে হবে।
– আমেরিকার দাবি, আমেরিকা বিশ্বে শান্তি ও নিরাপত্তা রক্ষা করে। তাই প্রতিবছর আমেরিকার কোষাগারে নির্দিষ্ট হারে অর্থ প্রদান করতে হবে।
ট্রাম্প বুঝতে পারছেন না বা বুঝেও বুঝতে চাইছেন না যে পৃথিবী অনেক বদলে গেছে, বাংলাদেশের মতো ছোট কিছু দেশকে জোর করা সম্ভব কিন্তু সবাইকে সম্ভব না। শুধু ডলার যে আমেরিকান অর্থনীতি ভেতর থেকে ফাঁপা করছে তা নয় আরও ব্যাপার আছে। সেই আলোচনা অনেক বড় হয়ে যাবে।
লেখক: নিউজিল্যান্ড প্রবাসী চিকিৎসক
পূর্বকোণ/ইবনুর