চট্টগ্রাম মঙ্গলবার, ২৫ মার্চ, ২০২৫

শিশুধর্ষণ : এমন চরম ঘৃণ্য বর্বতার শেষ কোথায়?

আবসার মাহফুজ

১১ মার্চ, ২০২৫ | ৩:০৮ অপরাহ্ণ

সাম্প্রতিক সময়ে নারী ও কন্যাশিশু ধর্ষণ, হত্যা এবং নানামাত্রিক নির্যাতন-নিপীড়ন যেন অপ্রতিরোধ্য অপরাধ হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে সমাজে। বলিষ্ঠ সামাজিক উদ্যোগ ও প্রশাসনিক পদক্ষেপের অভাবে এসব অসভ্যঘটনা প্রতিনিয়তই ঘটছে। গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবরে দেখা যাচ্ছে, গত কয়েক সপ্তাহ ধরে দেশের আনাচে-কানাচে প্রতিনিয়ত পাশবিক কায়দায় একের পর এক নানাবয়সি নারীরা ধর্ষণের শিকার হচ্ছেন। আবার ভিকটিমদের বেশিরভাগই কোমলমতি শিশু। একেকটি ঘটনা এতটাই ভয়ানক যে, আদিম বর্বরতাকেও যেন হার মানায়।

 

ধর্ষকের ঘৃণ্য লোলুপ দৃষ্টি থেকে রেহাই পাচ্ছে না আপন কোমলমতি কন্যাশিশুও। চট্টগ্রাম নগরীর কোতোয়ালীতে ১০ বছরের শিশুকে ধর্ষণের অভিযোগে বাবাকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। গত রবিবার (৯ মার্চ) মধ্যরাতে কোতোয়ালি থানাধীন বলুয়ার দিঘীর পাড় এলাকা থেকে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯-এ ফোন পেয়ে শিশুটিকে উদ্ধার করা হয়। পরে শিশুটির মুখে ঘটনার বর্ণনা শুনে পাষণ্ড বাবাকে আটক করা হয়। ভিকটিম শিশুটি পুলিশকে জানিয়েছে, এর আগেও আসামি তার সঙ্গে একই আচরণ করেছেন। এর কয়েকদিন আগে মাগুরায় বোনের শ্বশুর কর্তৃক ধর্ষণের শিকার হয়ে আট বছর বয়সী আরেক শিশু হাসপাতালে মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ছে এখনো। সে এখন জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে।

 

এদিকে হবিগঞ্জের বানিয়াচংয়ে ৬ বছরের শিশুকে ‘সংঘবদ্ধ ধর্ষণের’ খবর শুনে বাবার মৃত্যু ঘটেছে। এভাবে প্রতিদিনই দেশের নানাপ্রান্তে নারী ও শিশুধর্ষণ এবং হত্যার ঘটনা বাধাহীনভাবে ঘটে চলেছে। বিদ্যমান কঠোর আইন, নারী অধিকার সংগঠন, মানবাধিকার সংগঠন ও নাগরিক সমাজের প্রতিবাদ, গণমাধ্যমের সংবাদ প্রচার এবং লেখালেখি- কোনো কিছুতেই ধর্ষণকারীদের দৌরাত্ম্য কমছে না। এসব ঘটনায় দেশবাসী স্তম্ভিত, বাকরুদ্ধ ও শঙ্কিত। এসব ঘটনা সমাজের মূল্যবোধের চরম ক্ষয় এবং সমাজে পাষণ্ডদের দোদণ্ড প্রতাপশালী হয়ে উঠারই ইঙ্গিত দিচ্ছে। এসব ঘটনা স্পষ্ট করে দিচ্ছে ঘরে-বাইরে কোথাও কন্যাশিশু ও নারীরা নিরাপদ নয়। এটি অ্যালার্মিং। এ অবস্থায় সার্বিক পরিস্থিতি কতটা ভয়ংকর হয়ে উঠছে তা যেমন অনুধাবন করা জরুরি, তেমনি এর পরিপ্রেক্ষিতে কঠোর পদক্ষেপ নিশ্চিত করারও বিকল্প নেই।

 

উল্লেখ্য, ধর্ষণসহ নারী ও শিশুনিগ্রহ প্রতিরোধে সমাজ ও রাষ্ট্র যেরকম ভ‚মিকা রাখার কথা সেরকম ভ‚মিকা দৃশ্যমান হচ্ছে না। ফলে সমাজের অশুরিক শক্তিগুলো দিন দিন বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। সাম্প্রতিক কালে এমন কিছু ঘটনা ঘটেছে, যা পুরো সমাজ ও রাষ্ট্রকে ভীষণ ধাক্কা দিয়েছে। সমাজ-অপরাধবিজ্ঞানীরা বলছেন, সিগারেট খাওয়াকে কেন্দ্র করে দুই তরুণীকে পিটিয়ে আহত করা, পোশাক নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এক ছাত্রীর হেনস্তা হওয়া, অশালীন আচরণের প্রতিবাদ করায় বাকেরগঞ্জে এক নারীকে প্রকাশ্যে মারধর করার ঘটনাগুলো খুবই উদ্বেগজনক। এসব ঘটনা রাষ্ট্র ও সরকারের প্রতি চ্যালেঞ্জমূলক, সন্দেহ নেই। কিন্তু দুঃখজনকভাবে এসব ঘটনায় রাষ্ট্র ও সরকারের দিক থেকে যে রকম কঠোর পদক্ষেপ নেওয়ার কথা ছিল, সেটা দৃশ্যমান হয়নি, এবং হচ্ছে না। পরিণামে অপরাধীরা আরো বেপরোয়ো হয়ে উঠার দুঃসাহস দেখাচ্ছে।

 

গত সপ্তাহে মাগুরায় বোনের বাড়িতে বেড়াতে এসে আট বছরের শিশুটি যেভাবে বোনেরই শ্বশুর নামের এক পাষণ্ড কর্তৃক ধর্ষণের শিকার হলো, চট্টগ্রামে নিজের বাবা কর্তৃক দশ বছরের শিশুটি যেভাবে পাশবিক কায়দায় ধর্ষণের শিকার হলো, কিংবা হবিগঞ্জের বানিয়াচংয়ে ছয়বছরের মাসুম শিশুটিকে জঙ্গলে নিয়ে পাষণ্ডরা যেভাবে ধর্ষণ করলো, তা সমাজের মুখে চুনকালি মেখে দিয়েছে বললেও কম বলা হবে। কিন্তু দুঃখজনকভাবে এমনধরনের অপরাধ নির্মূল ও অপরাধীদের পাকড়াও করে বিচারের কাঠগড়ায় সোপর্দ করতে যেরকম তৎপরতা দরকার, তা দেখা যাচ্ছে না। যদিও দেশের শিক্ষার্থীসমাজ ও সাধারণ মানুষ এ ব্যাপারে বিক্ষোভে ফেটে পড়ার পর আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর কিছুটা তৎপর হয়ে উঠেছে, তবে তা পর্যাপ্ত নয়। এতে অপরাধীরা সাহস পাচ্ছে।

 

অথচ প্রশাসন কঠোর হলে এবং আইনশৃঙ্খলাবাহিনী সাঁড়াশি অভিযান পরিচালনা করলে ও অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করা গেলে কেউ ধর্ষণের মতো চরম ঘৃণ্য কাজ করার দুঃসাহস দেখাতো না। আমাদের দেশে সালিশের নামেও নারীদের অপমান-নির্যাতন ও অপরাধীদের দায়মুক্তি দেওয়া হচ্ছে নানা স্থানে। লক্ষ্মীপুরের রামগতি উপজেলায় সালিসে ডেকে ধর্ষণের শিকার এক কিশোরীকে উল্টো অপবাদ দেওয়ার পর ক্ষোভে আত্মহত্যা করার খবর এসেছে গণমাধ্যমে। প্রকাশিত খবরে দেখা যাচ্ছে, ১ মার্চ নিজের ঘরে ঢুকে রাকিব নামের এক বখাটে ওই কিশোরীকে ধর্ষণ করে। পরদিন ঘটনাটি জানাজানি হলে এলাকায় সালিস বৈঠকের আয়োজন করা হয়। কিন্তু সেখানে কোনো বিচার পায়নি ওই কিশোরী। উল্টো তাকে অপবাদ দেওয়া হয়।

 

৬ মার্চ বৃহস্পতিবার সকালে কিশোরীকে বাড়িতে রেখে তার মা বাড়ির পাশের জমিতে ফসল দেখতে যান। এসে দেখেন, মেয়ে আত্মহত্যা করেছে। পরে পুলিশ ঘটনাস্থল থেকে মরদেহ উদ্ধার করে। ধর্ষণ ও আত্মহত্যার প্ররোচনায় ৭ মার্চ ১২ জনের বিরুদ্ধে ওই কিশোরীর মা বাদী হয়ে মামলা করেন। সারাদেশেই এমন ঘটনা অহরহ ঘটছে। সালিশের নামে অপরাধীদের দায়মুক্তি ঘটছে। আর ধর্ষণের শিকার হওয়া নিরীহ নারী ও শিশুরা ন্যায়বিচার না পেয়ে আত্মহননের পথ বেছে নিচ্ছে। এমনটি কোনো মতেই কাম্য নয়।

 

সমাজ-অপরাধবিজ্ঞানীরা বলছেন, অপরাধীদের যথোপযুক্ত শাস্তি না হওয়ার দৃষ্টান্তের কারণেই মূলত দেশে ধর্ষণ-হত্যাসহ নারী ও শিশুনির্যাতনের মাত্রা বেড়ে চলেছে।

 

মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটির (এইচআরএসএস) এক প্রতিবেদন বলছে, ২০২০ থেকে ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত গত পাঁচ বছরে দেশে অন্তত ছয় হাজার ৩০৫ জন নারী-শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে। এর মধ্যে তিন হাজার ৪৭১ জন ১৮ বছরের কমবয়সী শিশু রয়েছে। চলতি বছরের গত দুই মাসে দেশে ধর্ষণের শিকার হয়েছে কমপক্ষে ১০৭ জন। যাদের মধ্যে ৬৬ জন ১৮ বছরের কমবয়সী শিশু রয়েছে। এ সময় ২২৪ জন নারী ও কন্যাশিশু নির্যাতনের শিকার হয়েছে।

 

এইচআরএসএসের তথ্য অনুযায়ী, গত পাঁচ বছরে এক হাজার ৮৯ জন নারী ও শিশু গণধর্ষণের শিকার হয়েছে। ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ২০৭ জনকে। এর মধ্যে শিশু ১১৮ জন। ৫০ জন ধর্ষণের শিকার নারী ও শিশু আত্মহত্যা করেছে। দুই হাজার ৬২৪ জন নারী ও শিশু যৌন নিপীড়নের শিকার হয়েছে। যৌতুকের জন্য নির্যাতনের ঘটনায় নিহত হয়েছেন ২৯০ জন, শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন ৩৫৫ জন এবং আত্মহত্যা করেছেন ২৬ জন নারী। পারিবারিক সহিংসতার শিকার হয়ে নিহত হয়েছেন এক হাজার ২৬২ জন, আহত হয়েছেন ৩৮৬ জন এবং আত্মহত্যা করেছেন ৪১৬ জন নারী। এসিড সহিংসতার শিকার হয়েছে ৯৪ জন নারী ও কন্যাশিশু, যার মধ্যে মারা গেছে ৯ জন।

 

আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দে দেশে ৪০১ জন নারী ধর্ষণ ও দলবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয়েছেন।

 

পুলিশ সদরদপ্তরের ২০২৪ খ্রিস্টাব্দের বার্ষিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দে দেশে নারী ও শিশুনির্যাতনের ঘটনায় ১৭ হাজার ৫৭১টি মামলা হয়েছে। এর মধ্যে গত জানুয়ারি মাসে মামলা হয়েছে ২৪১টি।

 

বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের কেন্দ্রীয় লিগ্যালএইড উপপরিষদের দেওয়া তথ্য মতে, গত ফেব্রুয়ারি মাসে ৭২ জন কন্যাশিশু ও ১১৭ জন নারীসহ ১৮৯ জন নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। এর মধ্যে ধর্ষণের শিকার হয়েছে ৩০ জন কন্যাশিশুসহ ৪৮ জন। আর তিনজন কন্যাসহ ১১ জন দলবদ্ধ ধর্ষণের শিকার এবং একজন কন্যাশিশুকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে।

 

আমরা মনে করি, নারী ও শিশুধর্ষণসহ সবধরনের নিগ্রহের বিরুদ্ধে ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি গ্রহণ করে সমাজ ও দেশকে সবার জন্য নিরাপদ করার দায়িত্ব সরকারের, রাষ্ট্রের। এ বিষয়ে কোনোধরনের খামখেয়ালি, নির্লিপ্ততা, ‘ধীরেচলো নীতি’ সম্পূর্ণ অগ্রহণযোগ্য; মহান মুক্তিযুদ্ধ ও ‘৩৬ জুলাই’ বিপ্লবের চেতনাবিরোধী। আমরা এ বিষয়ে সরকারের শক্ত পদক্ষেপ দেখতে চাই। অপরাধী যতোবড়ই হোক, যে ধর্মের, যে বর্ণের, যে লিঙ্গের, যে জাতেরই হোন না কেন, তাকে এবং তাদের ধরে বিচারের কাঠগড়ায় সোপর্দ এবং দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করা হোক, যাতে নারী ও শিশুসহ সমাজে বসবাসকারী কারো শান্তি ও নিরাপত্তা বিঘ্নকারী, নৈরাজ্য সৃষ্টিকারী অপশক্তির উত্থান না হয়। একইসঙ্গে এ বিষয়ে একটি সামাজিক ও ধর্মীয় আন্দোলন সৃষ্টিও জরুরি।

 

রাষ্ট্রের পাশাপাশি সামাজিক ও ধর্মীয় প্রতিরোধ গড়ে উঠলে, বিচারহীনতার সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসতে পারলে, নারীর প্রতি সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির ইতিবাচক পরিবর্তন হলে, সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও কর্মক্ষেত্রে ‘নারী ও শিশু নিপীড়নবিরোধী সেল’ গঠন এবং সেলের কার্যকারিতা নিশ্চিত করতে পারলে, ধর্ষণ, যৌননিপীড়ন ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সাইবার বুলিং সংক্রান্ত আইনের সংশোধন করে অপরাধের স্পষ্ট ও যথাযথ সংজ্ঞায়ন করলে এবং সঠিক ধর্মচর্চার মাধ্যমে মানবিক মূল্যবোধ শক্তিশালী করা গেলে ধর্ষণ-নৈরাজ্য সহজেই বন্ধ হয়ে যাবে।

 

পূর্বকোণ/ইব

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট