চট্টগ্রাম মঙ্গলবার, ১১ ফেব্রুয়ারী, ২০২৫

বিশ্ব ক্যান্সার দিবস ও বাংলাদেশ

ডা. মোহাম্মদ মহিউদ্দিন

৪ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫ | ১১:৩৩ পূর্বাহ্ণ

বিশ্বে ক্যান্সারে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা দিনে দিনে বাড়ছে। বাংলাদেশে মোট ক্যান্সার রোগী এক লাখ ৫০ হাজার অথবা তারও বেশি এবং প্রতিবছর প্রায় এক লাখ লোক ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে থাকে বলে ধারণা করা হয়। এই সংখ্যা আরও বেশি হতে পারে। আমাদের যেহেতু ক্যান্সার রেজিস্ট্রি নেই, তাই সঠিক সংখ্যা জানা নেই। গ্লোবাল ক্যান্সার অবজারভেটরি ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, মেঘালয়, ত্রিপুরা, আসামসহ কয়েকটি রাজ্যের ক্যান্সার রেজিস্ট্রির তথ্যের ভিত্তিতে বাংলাদেশের ক্যান্সারের আনুমানিক তথ্য প্রকাশ করে থাকে।

 

সম্প্রতি ঢাকায় অবস্থিত বিএসএমএমইউ’র গবেষক পাবলিক হেলথ এন্ড ইনফরমেটিকস বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. মো. খালেকুজ্জামানের তত্ত্বাবধানে একটি গবেষণা পরিচালনা করা হয় কিশোরগঞ্জের হোসেনপুর উপজেলায়। ২০২৩ সালের জুলাই মাস থেকে গবেষণাটি পরিচালিত হয়ে আসছে। এ গবেষণায় প্রতিটি বাড়িতে বিশেষভাবে তৈরি করা ইন্টারনেটভিত্তিক ক্যান্সার নিবন্ধন সফটওয়্যার করে সাক্ষাৎকার গ্রহণের মাধ্যমে তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে। এক বছর পূর্তিতে একই পরিবারের ফলোআপ পরিদর্শন ২০২৪ সালের জুলাই মাসে শুরু হয়েছে।

 

এই গবেষণার প্রাথমিক ফলাফলে বাংলাদেশে ৩৮ ধরনের ক্যান্সারের রোগী পাওয়া গেছে। প্রতি লাখে ১০৬ জন ক্যান্সারে আক্রান্ত রোগী পাওয়া গেছে। ৯৩ শতাংশ রোগীর বয়স ১৮ থেকে ৭৫ বছর। ক্যান্সার রোগীদের মধ্যে ২.৪ শতাংশ শিশু রয়েছে। ৫.১ শতাংশ রোগীর বয়স ৭৫ বছরের বেশি। ৫টি প্রধান ক্যান্সার হলো- স্তন, মুখ, পাকস্থলী, শ্বাসনালী এবং জরায়ুমুখের ক্যান্সার। পুরুষদের ৫টি প্রধান ক্যান্সার হলো- শ্বাসনালী, পাকস্থলী, ফুসফুস, মুখ ও খাদ্যনালীর ক্যান্সার। নারীদের ৫টি প্রধান ক্যান্সার হলো- স্তন, জরায়ুমুখ, মুখ, থাইরয়েড এবং ওভারি। পুরুষ ক্যান্সার রোগীদের ৭৫.৮ শতাংশ ধূমপায়ী এবং ধোঁয়াহীন পান, জর্দা, তামাক সেবনকারী ৪০.৫ শতাংশ।

 

ক্যান্সার রোগীদের মধ্যে ৬০.৬ শতাংশ নারী ধোঁয়াহীন পান, জর্দা, তামাক সেবনকারী। ৪৬ শতাংশ রোগীর ক্যান্সারের সাথে ই-তামাক সেবনের সম্পর্ক রয়েছে। ক্যান্সার আক্রান্ত রোগীদের মধ্যে ৬০ শতাংশ কমবাইন্ড চিকিৎসা নিয়েছে এবং ৭.৪ শতাংশ রোগী কোন চিকিৎসাই নেয়নি। দেশে মোট মৃত্যুর ১২ শতাংশ ক্যান্সারে আক্রান্ত রোগী। মৃত রোগীদের মধ্যে শীর্ষে রয়েছে ফুসফুস, শ্বাসনালী ও পাকস্থলীর ক্যান্সার। প্রতিবছর নতুন করে প্রতি লাখে ৫৩ জন রোগী ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়। আক্রান্ত রোগীদের মধ্যে ফুসফুস, লিভার ও শ্বাসনালীর ক্যান্সারের রোগী বেশি।

 

ক্যান্সারের চিকিৎসা অত্যন্ত ব্যয়বহুল, সময়সাপেক্ষ এবং একের অধিক বিশেষজ্ঞ ডাক্তার ও এলায়েড হেলথ ওয়ার্কারের সাহায্যে সম্পূর্ণ চিকিৎসা সম্পন্ন করতে হয়। সে কারণে ক্যান্সার প্রতিরোধে জোর দিতে পারলে রোগের বার্ডেন অনেক কমে আসবে বলে ধারণা করা যায়।ফুসফুস, মুখ ও শ্বাসনালীর ক্যান্সারের হার কমাতে হলে তামাক ও জর্দার ব্যবহার কমানো জরুরি। সিগারেট, জর্দা ও বিড়ির উপর ধীরে ধীরে উচ্চ করারোপ করা, সকল হাসপাতাল, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, যানবাহন, সরকারি অফিস-আদালতে ধূমপান নিষিদ্ধ করা খুবই জরুরি। জনসচেতনতা বাড়াতে হলে উপরোক্ত ক্যান্সারের কারণসমূহ জনগণকে জানানো দরকার। বিশেষ করে স্কুলের শিক্ষা কারিকুলামে ক্যান্সারের কারণ এবং প্রতিরোধ সম্পর্কে চ্যাপ্টার বাধ্যতামূলক করা দরকার।

 

আগেই উল্লেখ করেছি মহিলাদের স্তন ক্যান্সারের প্রকোপ আমাদের দেশে অনেক বেশি। তবে স্তন ক্যান্সার প্রাথমিক অবস্থায় ডায়াগনোসিস করা গেলে এবং সঠিক চিকিৎসা পেলে নিরাময়ের হার শতভাগের কাছাকাছি। প্রাথমিকভাবে স্তন ক্যান্সার শনাক্তকরণের জন্য ম্যামোগ্রাম করাটা খুবই দরকার। ম্যামোগ্রাম হলো এক ধরনের এক্স-রে, যার মাধ্যমে স্তনের ছবি নেওয়া হয় এবং রেডিওলজিস্ট এই ছবি দেখে স্তনে টিউমারের সামান্যতম লক্ষণ থাকলেও বলে দিতে পারেন। কারও পরিবারে যদি স্তন ক্যান্সার থাকে তাহলে সেই পরিবারের মেয়েদের ৩৫ বছর বয়স থেকে প্রতি দুই বছর পর পর ম্যামোগ্রাম করতে হবে।

 

অন্যদের ম্যামোগ্রাম ৪০ বছর বয়সে শুরু করতে হবে। অনেকের ধারণা ম্যামোগ্রাম করলে শরীরে অনেক রেডিয়েশন ঢুকে যায়। এই ধারণা ভুল; কারণ ম্যামোগ্রামে খুবই সামান্য রেডিয়েশন আমাদের শরীরে ঢুকে। ম্যামোগ্রাম সরকারি হাসপাতালে করালে খরচ পড়বে ৮০০-১০০০ টাকা। সুতরাং আপনাদের যাদের বয়স ৪০ তারা ম্যামোগ্রাম করাবেন। জরায়ুমুখের ক্যান্সার প্রতিরোধে সরকার এইচপিভি টিকা দেওয়ার প্রোগ্রাম স্কুলে শুরু করেছে কিশোরীদের জন্য। আপনার মেয়েকে টিকা দিতে ভুলবেন না। মহিলাদের পেপ টেস্ট করলে জরায়ুমুখের ক্যান্সার আগেভাগে নির্ণয় করা যায়। আপনার ডাক্তারের সাথে কথা বলে পেপ টেস্ট করা জরুরি।

 

ক্যান্সারের চিকিৎসায় ভিন্ন ভিন্ন বিশেষজ্ঞ এলোপ্যাথিক চিকৎসক জড়িত। প্রথমতো, হোমিওপ্যাথিতে ক্যান্সার ভালো হওয়ার সম্ভাবনাই নেই। তাই ভুলেও হোমিওপ্যাথির সাহায্যে ক্যান্সারের চিকিৎসা নেবেন না। এটি একটি প্রতারণা মাত্র। শিশুদের ক্যান্সারের চিকিৎসা করেন শিশু-ক্যান্সার বিশেষজ্ঞরা। সারাদেশে শিশু-ক্যান্সার রোগ বিশেষজ্ঞ আছেন ৭০-৮০ জন। বড়দের ক্যান্সার রোগ বিশেষজ্ঞ হলেন- রেডিয়েশন অনকোলজিস্ট, মেডিকেল অনকোলজিস্ট, হেমাটো অনকোলজিস্ট, সার্জিক্যাল অনকোলজিস্ট, গাইনি অনকোলজিস্ট। রেডিয়েশন অনকোলজিস্ট রেডিয়েশনের সাহায্যে ক্যান্সারের চিকিৎসা দিয়ে থাকেন।

 

মেডিকেল অনকোলজিস্ট কেমোথেরাপি, ইমিউনোথেরাপি ও টার্গেটেড থেরাপি দিয়ে চিকিৎসা করে থাকেন। হেমাটো অনকোলজিস্টরা সাধারণত বড়দের রক্তের ক্যান্সারের চিকিৎসা করেন। সার্জিক্যাল অনকোলজিস্ট হলেন বিশেষভাবে প্রশিক্ষিত সার্জন, যারা অপারেশনের মাধ্যমে টিউমার কেটে ফেলেন। গাইনি অনকোলজিস্টগণও বিশেষভাবে প্রশিক্ষিত। তারা জরায়ু, ওভারি, জরায়ুমুখ ও অন্যান্য নারী প্রজননতন্ত্রের ক্যান্সারের চিকিৎসা সার্জারির মাধ্যমে করে থাকেন। এছাড়াও প্যাথলজিস্ট, রেডিওলজিস্ট, মেডিকেল ফিজিসিস্ট, রেডিওথেরাপি টেকনোলজিস্ট, অনকোলজি নার্স ও অন্যান্য এলায়েড হেলথ ওয়ার্কাররা সরাসরি ক্যান্সার রোগীর সেবায় বিশেষ ভ‚মিকা পালন করেন।

 

আমি আগেই বলেছি ক্যান্সারের চিকিৎসা অনেক ব্যয়বহুল ও সময়সাপেক্ষ। বাংলাদেশের বেশিরভাগ জনগণের পক্ষে এর ব্যয়ভার বহন করা কঠিন। আমাদের একটি জাতীয় ক্যান্সার কেয়ার প্রোগ্রাম থাকা খুবই দরকার, যার মাধ্যমে একটি জাতীয় ক্যান্সার কেয়ার ফান্ড গঠন করা যেতে পারে এবং জনগণ একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ (মাসে ৩০ টাকা) প্রিমিয়াম সেই ফান্ডে জমা দেবেন। যখন কেউ ক্যান্সারে আক্রান্ত হবে তখন সেই ফান্ডের টাকা দিয়ে তার চিকিৎসা করা হবে। আমি, আপনি- আমরা সবাই সেই দিনের অপেক্ষায় রইলাম।

 

লেখক: রেডিয়েশন অনকোলজিস্ট, সেন্ট জন রিজিওনাল হসপিটাল, নিউ ব্রান্সউইক। এসিস্টেন্ট প্রফেসর, ডালহাউসি ইউনিভার্সিটি, কানাডা।

 

পূর্বকোণ/ইব

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট