নানা জল্পনা-কল্পনার পর শেষ পর্যন্ত ১৯ জানুয়ারি ২০২৫-এ গাজায় যুদ্ধবিরতি ও বন্দী বিনিময় চুক্তি কার্যকর হলেও বিভিন্ন অজুহাতে ইসরায়েল ফিলিস্তিনিদের ওপর বোমা বর্ষণ ও হত্যাযজ্ঞ অব্যাহত রাখায় এবং একইসঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক জায়নবাদী দেশটিতে ২ হাজার পাউন্ড ওজনের ভয়ংকর বোমাসহ বিভিন্ন মারণাস্ত্রের একটি বড় চালান পাঠানোর খবর ও যুক্তরাষ্ট্রের ৪৭তম প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ফিলিস্তিনিদের অন্য দেশে সরিয়ে নিয়ে গাজা উপত্যকা খালি করতে আগ্রহ প্রকাশের পর চুক্তির টেকসই বাস্তবায়ন ও মধ্যপ্রাচ্যে শান্তির ভবিষ্যৎ নিয়ে সন্দেহ দেখা দিয়েছে। ইসরায়েল ২০২৩ খ্রিস্টাব্দের ৭ অক্টোবর গাজায় বোমা হামলা শুরু করে। এর আগে হামাস সীমান্ত পেরিয়ে প্রায় ১ হাজার ২০০ মানুষ হত্যা এবং ২৫১ জনকে জিম্মি করে গাজায় নিয়ে যায়।
এক সপ্তাহ পর স্থল অভিযান শুরু হলেও এটি দ্রুত শেষ হবে বলে ধারণা ছিল। তবে ১৫ মাস ধরে চলা এই সংঘর্ষ হামাসের সঙ্গে একটি চুক্তির পর শেষ হওয়ার কথা ছিল। যুদ্ধবিরতি ও বন্দী বিনিময় শুরুও হয়েছে; কিন্তু ইসরায়েল কিছু মিথ্যা অজুহাত দাঁড় করিয়ে যুদ্ধবিরতি চুক্তি লঙ্ঘন করেই চলেছে। আর এতে সায় দিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। ইসরায়েলের অন্ধ সমর্থক ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রের ৪৭তম প্রেসিডেন্ট হিসেবে আনুষ্ঠানিক ক্ষমতা নেওয়ার পর গাজা খালি করে সেখানকার ফিলিস্তিনিদের মিসর ও জর্ডানে চলে যাওয়ার অভিপ্রায় ব্যক্ত করার পর ইসরায়েল আরো বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। এ অবস্থায় যুদ্ধবিরতি চুক্তির সুচারু বাস্তবায়ন কঠিন হতে পারে। একইসঙ্গে বর্বর ইসরায়েলের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষপাতিত্ব অব্যাহত থাকলে ফিলিস্তিনিদের দুর্দশার অবসান তো হবেই না, এমনকি মধ্যপ্রাচ্যে শান্তির পথও আরো কণ্টকাকীর্ণ হবে, সন্দেহ নেই।
উল্লেখ্য, ২০২৩ খ্রিস্টাব্দের নভেম্বরের স্বল্পকালীন যুদ্ধবিরতি এবং জিম্মিমুক্তি চুক্তির পর ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু হামাসের বিরুদ্ধে ‘সম্পূর্ণ বিজয়ের’ অঙ্গীকার ঘোষণা করেন। গাজার সাধারণ মানুষের ওপর এই অভিযানের প্রভাবে মানবাধিকার সংস্থাসহ বিভিন্ন মহল থেকে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে গণহত্যার অভিযোগ ওঠে। দক্ষিণ আফ্রিকা আন্তর্জাতিক বিচারিক আদালতে একটি মামলা দায়ের করে। ইতিহাসবিদ ওমার বার্টোভ উল্লেখ করেছেন, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দের মে মাসে ইসরায়েলের কর্মকাণ্ডকে ‘যুদ্ধাপরাধ এবং মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ’ হিসেবে চিহ্নিত করা সম্ভব। গাজার স্বাস্থ্য কর্মকর্তাদের মতে, ইসরায়েলি হামলায় এ পর্যন্ত (২৭ জানুয়ারি ২০২৫), ৫৫ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। এর মধ্যে ১৩ হাজার ৩১৯ শিশু রয়েছে। আহত হয়েছেন আরও ১ লাখ ৪০ হাজার জন। তবে ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়ে থাকা আনুমানিক ১০ হাজার জনের মরদেহ উদ্ধার সম্ভব হয়নি।
গবেষণা অনুযায়ী, প্রকৃত মৃতের সংখ্যা ৭০ হাজার ছাড়িয়ে যেতে পারে। গাজায় ৯০ শতাংশ ঘরবাড়ি ধ্বংস বা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ১৯ লাখ মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছেন, যা গাজার মোট জনসংখ্যার ৯০ শতাংশ। আশ্রয় শিবিরগুলোতে তীব্র দুর্দশার মধ্যে দিন কাটাচ্ছে লাখো মানুষ। গাজার ৬৫৪টি স্বাস্থ্যকেন্দ্রে হামলা চালানো হয়। ১ হাজার ৬০ জন স্বাস্থ্যকর্মী নিহত হয়েছেন। ৬ লাখ ৬০ হাজার শিক্ষার্থী এক বছরেরও বেশি সময় ধরে শিক্ষাবঞ্চিত। ৫৩৪টি স্কুল পুরোপুরি ধ্বংস হয়েছে। ইসরায়েলের অবরোধের ফলে গাজার খাদ্যসংকট তীব্র হয়। ২০২৪ খ্রিস্টাব্দের নভেম্বরের হিসাবে ৯৬ শতাংশ শিশু এবং নারী পুষ্টিহীনতায় ভুগছেন। যুদ্ধের প্রভাবে গাজার পরিবেশও বিপর্যস্ত। চাষাবাদের ৪০ শতাংশ জমি ধ্বংস এবং বিষাক্ত বর্জ্য মাটিতে মিশে গেছে।
যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত নেতানিয়াহু ও সাবেক প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইয়োভ গ্যালান্টের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছে। এ অবস্থায় গাজায় হামাস ও ইসরাইলের মধ্যে যুদ্ধবিরতি চুক্তি কার্যকর হয়। তবে যুদ্ধবিরতি চুক্তি কার্যকর হওয়ার পরও গাজায় হামলা চালিয়ে যাচ্ছে ইসরায়েলি বাহিনী। ফিলিস্তিনের পশ্চিম তীরেও বড় ধরনের অভিযান শুরু করেছে ইসরায়েল। এ অভিযানে কয়েকশ’ ফিলিস্তিনী নিহত হয়েছেন। এছাড়া আটক করা হয়েছে কয়েকশ’। আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত খবরে দেখা যাচ্ছে, পশ্চিম তীরের জেনিন শরণার্থী শিবিরে ‘আয়রন ওয়াল’ নামের অভিযানে বিমান হামলার পাশাপাশি অংশ নিচ্ছে ইসরায়েলি বাহিনীর হেলিকপ্টার, ড্রোন, সাঁজোয়া যান ও বুলডোজার। অভিযান শুরুর আগে পশ্চিম তীরের বিভিন্ন শহরের প্রবেশপথ বন্ধ করে দেয় ইসরায়েলি বাহিনী, যা যুদ্ধবিরতি চুক্তির মারাত্মক লঙ্ঘন।
ইসরায়েলের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইসরায়েল কাৎজ বলেছেন, জেনিন শরণার্থী শিবিরে ‘আয়রন ওয়াল’ অভিযানের মধ্যদিয়ে পশ্চিম তীরে দেশটির সামরিক বাহিনীর নিরাপত্তা ব্যবস্থায় পরিবর্তন আসবে। সন্ত্রাসবাদ যাতে ফিরতে না পারে, সেজন্য পশ্চিম তীরের অভিযানে ইসরায়েলি বাহিনী গাজা যুদ্ধের শিক্ষা কাজে লাগাচ্ছে বলেও তিনি জানান।
এ অবস্থায় আন্তর্জাতিক রাজনীতি ও সমর বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ইসরায়েল যুদ্ধবিরতির কথা বললেও কার্যত তার সত্যতা মিলছে না। সত্যিকার অর্থে যুদ্ধ থেকে ইসরাইল নিবৃত্ত হয়নি। তাদের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা আরও ভয়ংকর।
আল-জাজিরার বিভিন্ন অনুসন্ধানী রিপোর্টও বলছে, ইসরায়েল ফিলিস্তিনে যুদ্ধ বন্ধ করেনি। তারা আসলে যুদ্ধের ক্ষেত্র পরিবর্তন করেছে। আসলে যুক্তরাষ্ট্র ও তার ইউরোপীয় মিত্রদের প্রশ্রয়েই ইসরায়েল বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। বর্তমান সভ্যতার লজ্জা হলো, যুক্তরাষ্ট্রের মত বৃহৎ শক্তির দেশ যুদ্ধাপরাধী ইসরায়েলকে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে এবং জাতিসংঘসহ অন্যান্য দেশ শুধু চেয়ে চেয়ে দেখার দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছে। গণতন্ত্রহীনতা, অনৈক্য ও যোগ্য নেতৃত্বের অভাবে মুসলিম বিশ্ব তো এখন মেরুদণ্ডহীন, বহুধাবিভক্ত এবং সাম্রাজ্যবাদীদের দাসানুদাসে পরিণত হয়েছে। একসময়ে ‘মুসলিম জাতিসংঘ’ হিসেবে পরিচিতি পাওয়া ‘ওআইসি’ এখন একটি অথর্ব সংস্থায় পরিণত হয়েছে। ‘আরব লীগ’ এখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থের পাহারাদারে পরিণত হয়েছে। ওআইসি এবং আরব লীগ এখন মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের এজেন্ডা বাস্তবায়নে সহায়তা করছে। মুসলিম বিশ্বের অন্যতম প্রভাবশালী দেশ সৌদি আরব দীর্ঘদিন ধরেই যুক্তরাষ্ট্রের আজ্ঞাবহ।
দেশটিতে বেশ কয়েকটি মার্কিন সামরিক ঘাঁটি আছে। ফিলিস্তিনে গণহত্যা এবং ‘বৃহত্তর ইসরায়েল’ প্রতিষ্ঠায় দেশটি বিনাপ্রশ্নে জায়নবাদী ইসরায়েলকে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সমর্থন এবং সহযোগিতা দিয়ে যাচ্ছে বহুবছর ধরেই। গত ২০ জানুয়ারি যুক্তরাষ্ট্রের ৪৭তম প্রেসিডেন্ট হিসেবে ‘ক্ষ্যাপা’ ট্রাম্প ক্ষমতাসীন হওয়ার পর মার্কিন মুল্লুকে একসাথে ৬০০ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের ঘোষণা দিয়েছেন সৌদি যুবরাজ। ট্রাম্পকে সন্তুষ্ট রাখতেই এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তিনি। অথচ মুসলিম দেশগুলোতে এমন বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত নিলে মুসলমানদের বেকারত্ব ও দারিদ্র্য বিমোচনে এর দারুণ ইতিবাচক প্রভাব পড়তো। শক্তি-সামর্থ্য এবং নেতৃত্বে ইরান যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলকে কিছুটা হলেও কাউন্টার দেওয়ার মতো ছিল। কিন্তু মুসলিম বিশ্বের অনৈক্য ও দুর্বলচিত্ত দেশটির বিরুদ্ধে ব্যবহৃত হচ্ছে ইসরায়েল-যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক।
আর্থ-সামরিক দিক দিয়ে তুরস্কের অবস্থান সমীহ করার মতো হলেও অভ্যন্তরীণ অনৈক্য ও কুর্দিসমস্যা দেশটিকে দুর্বল করে দিচ্ছে। সেজন্যে প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান মাঝে-মধ্যে ফিলিস্তিনে গণহত্যা বন্ধে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে হুংকার দিলেও বাস্তবে কোনো উদ্যোগ দৃশ্যমান হয় না। অন্য দেশগুলোও নানা সমস্যায় জর্জরিত। অথচ বিশ্বের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ সম্পদের মালিক মুসলিমবিশ্ব। তারা সেসব সম্পদের বিজ্ঞানভিত্তিক ব্যবহার এবং সবদেশের মধ্যে ঐক্য ও সুসম্পর্ক বজায় রেখে একটি শক্তিশালী গণতান্ত্রিক মুসলিমবিশ্ব গড়ায় মনোযোগী হলে আজ পুরোবিশ্বই মুসলিম-উম্মাহ্র কাছে মাথা নত করতে বাধ্য হতো। এখন বিপরীত দৃশ্যই দৃষ্টিগোচর হচ্ছে। আর মুসলিমবিশ্বের এমন নতজানু পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে মধ্যপ্রাচ্যের বিষফোঁড়াখ্যাত অবৈধ জায়নবাদী রাষ্ট্র ইসরায়েল ফিলিস্তিন ও লেবাননে নির্বিঘ্নে গণহত্যা চালিয়ে যাচ্ছে।
আন্তর্জাতিক সব আইন-কানুন লঙ্ঘন করে বৃহত্তর ইসরায়েল প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে অপতৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে তারা। এক্ষেত্রে ইসরায়েলকে সাহায্য করছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্র মুসলিম-অমুসলিম দেশগুলো। এটি মানবজাতি ও মানবসভ্যতার জন্য চরম লজ্জার।
বিশ্বখ্যাত সংবাদমাধ্যম আল জাজিরার গত ২৬ জানুয়ারি ২০২৫-এর খবরে দেখা যাচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প গাজার ফিলিস্তিনিদের অন্যদেশে সরিয়ে নিয়ে গাজা উপত্যকা খালি করতে চান। এজন্য গাজার বাসিন্দাদের আশ্রয় দিতে মিসর ও জর্ডানের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন তিনি। ২৫ জানুয়ারি ২০২৫, সাংবাদিকদের কাছে তাঁর এমন দৃষ্টিভঙ্গির কথাই তুলে ধরেছেন এক সপ্তাহ আগে দ্বিতীয় মেয়াদে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নেওয়া ট্রাম্প। তার এমন বক্তব্যে গাজায় আরেকটি জাতিগত নিধনের আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।
প্রকাশিত সংবাদ অনুযায়ী, ট্রাম্প চান গাজার আরও ফিলিস্তিনিদের মিসর ও জর্ডান আশ্রয় দেবে। বিষয়টি নিয়ে তিনি জর্ডানের বাদশাহ দ্বিতীয় আবদুল্লাহর সঙ্গে কথা বলেছেন। মিসরের প্রেসিডেন্ট আবদেল ফাত্তাহ আল-সিসির সঙ্গেও এ নিয়ে কথা বলবেন তিনি। ট্রাম্প বলেন, আমি চাই মিসর (গাজা থেকে) আরও মানুষ (ফিলিস্তিনি) নিয়ে যাক। আপনারা সম্ভবত ১৫ লাখ মানুষের কথা বলছেন। তাদের অন্যত্র সরিয়ে নিয়ে গাজা খালি করতে হবে আমাদের।
জর্ডানের বাদশাহর সঙ্গে কথা হয়েছে জানিয়ে ট্রাম্প বলেন, বাদশাহ দ্বিতীয় আবদুল্লাহকে তিনি বলেছেন, আমি খুশি হব, যদি আপনি আরও বেশি করে (ফিলিস্তিনিদের) আপনাদের দেশে আশ্রয় দেন। কারণ, গাজা উপত্যকা এখন সত্যিকার অর্থেই একটি ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে।
ট্রাম্প বলেন, গাজার এসব বাসিন্দাকে সাময়িক সময়ের জন্য অথবা স্থায়ীভাবে এসব দেশে সরিয়ে নেওয়া যেতে পারে। তবে ট্রাম্পের এমন মন্তব্যের তীব্র সমালোচনা করেছে গাজার সশস্ত্র প্রতিরোধ সংগঠন প্যালেস্টাইনিয়ান ইসলামিক জিহাদ (পিআইজে)। গাজার শাসকগোষ্ঠী হামাসের সঙ্গে মিলে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে প্রতিরোধযুদ্ধ করে আসা এই সংগঠনটি বলেছে, ফিলিস্তিনিদের তাদের নিজ ভূখণ্ড ছেড়ে যেতে বাধ্য করতে ট্রাম্পের এমন মন্তব্য যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধ উসকে দেওয়ার শামিল। ইসলামিক জিহাদ বলেছে, ইহুদিবাদী ইসরায়েল যে ফিলিস্তিনি ভূখণ্ড থেকে ফিলিস্তিনিদের সরিয়ে দিতে চায়, তার সঙ্গে ট্রাম্পের এমন মন্তব্যের মিল রয়েছে। এটা ফিলিস্তিনের মানুষের অধিকারের চরম লঙ্ঘন। ট্রাম্পের এমন অবান্তর প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করতে মিসর ও জর্ডানের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে সংগঠনটি।
উল্লেখ্য, গাজার বাসিন্দা প্রায় ২৩ লাখ। ট্রাম্পের এ মন্তব্যকে গুরুত্বের সঙ্গে নেওয়া উচিত বলে মনে করেন কাতারে অবস্থিত জর্জটাউন বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক আল-আরিয়ান। তিনি আল-জাজিরাকে বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের নতুন প্রেসিডেন্টের এ ধরনের মন্তব্য গুরুত্বের সঙ্গে নেওয়া উচিত। কারণ, আমরা দেখেছি বিগত দেড় বছর ধরে এমন দাবি তোলা হচ্ছে। এছাড়া গাজা যুদ্ধের শুরুতেও ইসরায়েলের কর্মকর্তারা যতটা সম্ভব ফিলিস্তিনি ভূখণ্ড থেকে ফিলিস্তিনিদের সরিয়ে জাতিগত নিধনযজ্ঞ চালানোর ইঙ্গিত দিয়েছিলেন।
ইতিহাসবিদেরা বলছেন, গাজা থেকে ফিলিস্তিনিদের অন্য কোথাও সরে যেতে বাধ্য করা হলে নাকবার (মহাবিপর্যয়) মতো কালো অধ্যায়ের পুনরাবৃত্তি ঘটবে। ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দে ফিলিস্তিনের ভূখণ্ড দখল করে ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সময় লাখ লাখ ফিলিস্তিনিকে ঘরবাড়ি ছেড়ে অন্যত্র যেতে বাধ্য করা হয়েছিল।
জায়নবাদের সবচেয়ে বিশ্বস্ত সমর্থক হিসেবে পরিচিত ট্রাম্প শুধু গাজা খালি করার ঘোষণাই দেননি, তিনি ইসরায়েলকে ২০০০ পাউন্ডের বোমা সরবরাহে সদ্য সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের দেওয়া স্থগিতাদেশ তুলে নিতেও সামরিক বাহিনীকে নির্দেশ দিয়েছেন। হোয়াইট হাউসের একটি সূত্র ২৫ জানুয়ারি রয়টার্সকে এ তথ্য জানিয়েছে। ট্রাম্পও বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
ট্রাম্প তার মালিকানাধীন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ট্রুথ সোশ্যালে লিখেছেন, এমন অনেক জিনিস, যা ইসরায়েল চেয়েছিল, অর্থও দিয়েছিল; কিন্তু বাইডেন সরবরাহ করেননি। সেগুলো এখন ইসরায়েলের পথে রয়েছে। অথচ ইসরায়েল সরকার বেসামরিক মানুষের ওপর, বিশেষ করে গাজার রাফা শহরে আশ্রয় নেওয়া লাখো উদ্বাস্তু ফিলিস্তিনের ওপর এ বোমা দিয়ে হামলা করতে পারে, এ আশঙ্কা থেকে বাইডেন এই বোমা ইসরায়েলকে সরবরাহ করা থেকে বিরত ছিলেন। শুধু এসব অস্ত্র নয়, মধ্যপ্রাচ্যে শান্তির পথে প্রধান অন্তরায় জায়নবাদী ইসরায়েলকে আরো নানা ধরনের মারণাস্ত্র দেওয়ার প্রক্রিয়াও শুরু হয়ে গেছে। অথচ, ট্রাম্প তার নির্বাচনী প্রচারণার সময় বারবার বলেছিলেন, যেদিন ক্ষমতায় ফিরে আসব, সেদিন থেকেই যুদ্ধ বন্ধের কাজ শুরু হয়ে যাবে।
মার্কিন মুল্লুকের মুসলিম জনগোষ্ঠীও ট্রাম্পকে ভোট দিয়েছে ফিলিস্তিনে ইসরায়েলি আগ্রাসন বন্ধ ও মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠায় ন্যায্য ভূমিকা রাখার শর্তে। কিন্তু প্রেসিডেন্টের শপথ নিয়েই তিনি সে প্রতিশ্রুতির বিপক্ষে কাজ করছেন। একটা প্রবাদ আছে- ‘মর্নিং শোজ দ্য ডে’। উঠন্তি মুলা পত্তনেই চেনা যায়। ভোরই দিনের পূর্বাভাস দেয়। ট্রাম্পযুগে নিপীড়িত ফিলিস্তিনিদের দুঃখ-দুর্দশা কোন পর্যায়ে পৌঁছবে, মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি ধরা দেবে কী না, তা এসব অনৈতিক ও জায়নবাদ-পক্ষপাতদুষ্টু পদক্ষেপই বলে দিচ্ছে। অথচ জাতিসংঘ, ওআইসি, আরব লীগসহ বিশ্বসম্প্রদায় বোবা ভূমিকা পালন করছে। কেউ কেউ আবার ট্রাম্প-তোষণের প্রতিযোগিতাও শুরু করে দিয়েছে। এটি খুবই হতাশাপূর্ণ; একটি নিরাপদ এবং শান্তিপূর্ণ মধ্যপ্রাচ্য ও বিশ্ব গড়ার ক্ষেত্রে যা প্রধান অন্তরায়।
পূর্বকোণ/ইব