চট্টগ্রাম শুক্রবার, ০৭ ফেব্রুয়ারী, ২০২৫

সর্বশেষ:

নবী করিম (সা.)’র জীবন্ত মুজিযা মিরাজ

মুহাম্মদ আবুল কালাম আমিরী

২৭ জানুয়ারি, ২০২৫ | ১:৩৪ অপরাহ্ণ

নবী কমির (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)’র বিশ্বয়কর ও জীবন্ত একটি মুজিযা হলো মিরাজ। মুজিযার প্রকৃতি সাধারণত প্রত্যেক নবী রাসুলগণের যুগ চাহিদার প্রেক্ষিতে স্থির হয়ে থাকে। মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)’র যুগ হলো বিজ্ঞানের যুগ। তাই আল্লাহ তা’য়ালা নবী করিম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এক অলৌকিক মুজিযা দান করলেন, যা বিজ্ঞানের সকল সফলতাকেই তাক লাগিয়ে দেয়, যার নাম ‘মিরাজ’।

 

‘মিরাজ’ নবী করিম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)’র নবী জীবনের এগার বৎসর ৫ মাস তথা হিজরতের দুই বছর পূর্বে রজব মাসের ২৭ তারিখ সংগঠিত হয়। মিরাজের এ ঘটনাটি তিন স্তরে বিভক্ত ছিল। রাসুল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)’র মসজিদে হারাম হতে রাত্রিকালে মসজিদে আকসায় গমণ যা কুরআনুল করিম’র বনী ইসরাইলের প্রথম আয়াত দ্বারা সাব্যস্ত’ এবং অকট্য ভাবে প্রমানিত। পবিত্রতা তারই জন্য, যিনি আপন বান্দাকে রাতের কিয়দংশে মসজিদে হারাম হতে মসজিদে আকসায় নিয়ে গেছেন। (সুরা বনী ঈসরাইলের নং আয়াতে-০১)। যা অস্বীকারকারী কাফির। যা কুরআনের ভাষায় ‘ইসরা’। আর মসজিদে আকসা হতে সিদরাতুল সুন্তাহা পর্যন্ত উর্ধ্বেগমন যা হাদীসে মাশহুর ও কুরআনুল করীমের সূরা আন-নজম’র ১৩-১৮ নং আয়াত দ্বারা পরোক্ষভাবে প্রমাণিত তা অস্বীকারকারী ‘ফাসিক’ আর সিদরাতুল মুনতাহা হতে আরশ্-কুরশী পর্যন্ত গমন। যা খরবে ওয়াহেদ দ্বারা প্রমাণিত।

 

নবী করিম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)’র অসংখ্য মুজিযার মধ্যে মিরাজ একটি রহস্যময় মজিযা যার অর্ন্তনিহিত রহস্য হলো এক লক্ষ চব্বিশ হাজার নবী রাসুলগণ জান্নাত ও জাহান্নামের সাক্ষ্য প্রদান হরেছেন, তাদের কারো এ সাক্ষী প্রত্যক্ষদর্শী ছিলনা বরং শোনা আর সাক্ষীর পূর্ণতা লাভ হয় প্রত্যক্ষদর্শীর সাক্ষীর মাধ্যমে। তাই নবী করিম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)কে জান্নাত ও জাহান্নাম পরিদর্শন করে সাক্ষীর পূর্ণতা দেওয়ার জন্য মিরাজ সংগঠিত হয়েছে। এছাড়া আল্লাহ তা’য়ালা এরশাদ করেছেন ‘নিশ্চয় আল্লাহ তায়ালা মুমিনের জন-মাল জান্নাতের বিনিময়ে ক্রয় করেছেন (সূরা তাওবা)। অর্থাৎ আল্লাহ তায়ালা মুমিনের জান-মালের ক্রেতা আর মুমিন বিক্রেতা। আর বেচা-কেনা সংগঠিত হয়েছে নবী করিম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)’র মধ্যস্তায়। ফলে মধ্যস্ততাকারী মাল দেখেছেন এবং তাকে মালের যে বিনিময় জান্নাত দেখিয়ে বেচা-কেনাকে পূর্ণতা দান করার জন্য আল্লাহ তায়ালা তাঁর হাবীব (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)কে মিরাজের ন্যায় অলৌকিক মুজিযা দান করেছেন।

 

বুখারী ও মুসলিমসহ হাদীসের প্রসিদ্ধ গ্রন্থে ’এসেছে- রজব মাসের ২৭ তারিখ সোমবার রাতের ত্রিয়দংশে নবী করিম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)কে তাঁর চাচাত বোন ও দুগ্ধবোন হযরত উম্মে হানী (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা)’র ঘর হতে কাবা চত্বরে এনে তাঁর বক্ষ বিদীর্ন করে হ্নৎপিন্ড বের করে যমযমের পানি দ্বারা পরিষ্কার করে ধুয়ে তাতে আধ্যাত্বিক জ্ঞান ও স্বর্গীয় জ্যোতিতে পরিপূর্ণ করে পুনরায় যথাস্থানে রেখে দেন। এরপর হযরত জিবরাইল আলাইহি সালাম ‘বোরাক’ নামক স্বর্গীয় বাহনের পৃষ্ঠে আরোহণ করিয়ে মসজিদুল আকসা’র দিকে রওয়ানা হন। বোরাকের গতি বরক তথ্য বিদ্যুতের ন্যায় দ্রæত বিধায় উহাকে বোরাক বলা হয়। মসজিদে আকসায় এসে নবী করিম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) পূর্ববর্তী সকল নবী রাসুল (আলাইহিস সালাম)’র সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। তাঁর ইমামতিতে তারা দুই রাকাত নামায আদায় করেন। তারপর মসজিদে আকসা হতে হযরত জিবরাঈল নবী করিম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)কে উর্ধ্বোগমন করেন।

 

নবী করিম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)’র সাথে প্রথম আসমানে হযরত আদম (আলাইহিস সালাম), দ্বিতীয় আসমানে হযরত ঈসা ও হযরত ইয়াহহিয়া (আলাইহিস সালাম), তৃতীয় আসমানে হযরত ইউনুছ (আলাইহিস সালাম), চতুর্থ আসমানে হযরত ইদরিস (আলাইহিস সালাম), পঞ্চম আসমানে হযরত হারুন (আলাইহিস সালাম), ষষ্ঠ আসমানে হযরত মুসা (আলাইহিস সালাম) এবং সপ্তম আসমানে হযরত ইবরাহীম (আলাইহিস সালাম) এর সাথে সাক্ষাৎ করেন। তাঁরা তাকে সাদর সংবর্ধনা জ্ঞাপন করেন। তিনি সপ্তম আসমানে ‘সিদরাতুল মনতাহা’ নামক স্বর্গীয় বৃক্ষের নিকট ‘হাউযে কাউসার’ দর্শন এবং জান্নাত ও দোজখ পরিদর্শন করেন এরপর ‘রফরফ’ নামক অন্য একটি বাহনের সাহায্যে আল্লাহর আরশ ও কুরশীর নিকটবর্তী হয়ে আল্লাহ তায়ালার সাথে সাক্ষাৎ করেন। আর আল্লাহ তায়ালা তথায় আমাদের জন্য ৫০ ওয়াক্ত নামাজ ফরজ করেন।

 

নবী করিম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আসার পথে ষষ্ঠ আসমানে হযরত মুসা (আলাইহিস সালাম) জিজ্ঞেস করলেন, আল্লাহ তায়ালা আপনাকে কি দিয়েছেন? নবী করিম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন- আমার উম্মতের জন্য ৫০ ওয়াক্ত নামাজ দান করেছেন। তখন হযরত মুসা (আলাইহিস সালাম) বললেন- আমি প্রাণপন চেষ্টা করেও আমার উম্মৎ বণি ইসরাঈলকে একটি আদেশও পালন করাতে সক্ষম হইনি, আর আপনি আপনার উম্মতের জন্য দৈনিক ৫০ ওয়াক্ত নামাজ নিয়ে আসছেন। আপনি ফিরে যান এবং নামাযের সংখ্যা হ্রাস করে আনুন। নবী করিম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ফিরে গেলেন এবং আল্লাহর দরবারে পুনঃপুনঃ আরজের মাধ্যমে দৈনিক পাঁচবার নামাজের আদেশ নিয়ে আসলেন। আর উম্মতে মুহাম্মদী দৈনিক পাঁচবার নামাজ পড়বে কিন্তু ‘প্রতিবারের জন্য দশগুণ পূন্য লাভ করবে, যাতে এ পাঁচবার নামায ৫০ বারের সমকক্ষ গণ্য হয়। তাই পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তায়ালা বলেন- যে ব্যক্তি একটি মাত্র ভাল কাজ করবে সে তার দশগুণ পূন্য লাভ করবে। (সুরা আনআম আয়াত-১৬০)।

 

মিরাজের রাতের কিয়দংশে নবী করিম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)’র বৃহৎ সফর সম্পন্ন করে সকালে মক্কাবাসীদের নিকট তার বর্ণনা দিলে তাঁরা তাকে বিদ্রুপ করতে লাগলেন আর এটা সবাই যাদু বলেও আখ্যা দেয়। আর আবু বকর ছিদ্দিক (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা) এই ঘটনাকে নির্দিধায় স্বীকার করে ছিদ্দিক উপাধীতে ভূষিত হয়। আর নও মুসলিমদের মধ্যেও একদল এ ঘটনাকে অবিশ্বাস করে ইসলাম পরিত্যাগ করে। মিরাজের সমুদয় ঘটনা নবী করিম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)’র জাগ্রত অবস্থায় সংঘটিত হয়েছিল এবং স্বশরীরে আল্লাহ তায়ালার সান্বিধ্য লাভ করেছেন। মিরাজের রাতেই আল্লাহ তায়ালা নবী করিম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)’র উম্মতের পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ ফরজ করেছেন, যা মুমিনদের মিরাজ বা মুসলমানদের মধ্যে সাম্য-মৈত্রী ও ভ্রাতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে এবং ধনী-দরিদ্র সকলকেই এক কাতারে আবদ্ধ করে।

 

লেখক: অধ্যক্ষ, হযরত খাজা কালু শাহ্ (রহ.) সুন্নিয়া আলিম মাদ্রাসা, জাফরাবাদ, সীতাকুণ্ড, চট্টগ্রাম।

 

পূর্বকোণ/ইব

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট