চট্টগ্রাম বুধবার, ১৫ জানুয়ারি, ২০২৫

সর্বশেষ:

ইসলামের দৃষ্টিতে করমর্দন বা মুসাফাহার ফজিলত

২৭ ডিসেম্বর, ২০২৪ | ৩:৩৪ অপরাহ্ণ

ইসলাম এমন একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা যাতে মানবজীবনের সকল দিক ও বিভাগ নিয়ে রয়েছে সুস্পষ্ট নির্দেশনা। মানুষের সামাজিক জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো মুসাফাহা। সাক্ষাতের সময় মুখে সালাম আর হাতে হাত মেলানোকে মুসাফাহা বলা হয়। এটা মুসলিম সভ্যতা-সংস্কৃতির একটি অংশ।

 

মুসাফাহা দ্বারা হিংসা-বিদ্বেষ ও অহংকার দূর হয়। একে অন্যের প্রতি মহব্বত বাড়ে। সর্বোপরি ছোট ছোট গুনাহ মাফ হয়ে যায়। মুসাফাহা হৃদয়ের বন্ধন জোড়ে, গুনাহ মাফ করে। এক মুসলিমের সাথে আরেক মুসলিমের সাক্ষাতে সালাম বিনিময়ের পর প্রথম কাজই হলো মুসাফাহা। দুই হাতের মিলন হৃদয়কেও ছুঁয়ে যায়, জুড়ে দেয় হৃদয়ের বন্ধন, ঘুঁচে যায় দূরত্ব। মাফ হয় গুনাহ।

 

মহান আল্লাহ তায়ালাও চান যে এক মুমিন আরেক মুমিনের সঙ্গে এমনই কাছাকাছি থাকবে, অন্তরঙ্গ থাকবে। ফলে মুসাফাহা আল্লাহর কাছে অনেক পছন্দের আমল। এর কারণে আল্লাহ খুশি হন এবং তাদের মাফ করে দেন। ইসলামপূর্ব আরব সমাজে মুসাফাহার প্রচলন ছিল। ইসলামেও তা স্বীকৃত।

 

মুসাফাহা দ্বারা হিংসা-প্রতিহিংসা দূর হয়। হাদিসের বর্ণনা থেকেই তা প্রমাণিত। হজরত বারা ইবনে আজেব রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেছেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, সাক্ষাৎকালে যখন দু’জন মুসলিম মুসাফাহা করে তখন তারা পৃথক হওয়ার আগেই তাদের মাফ করে দেওয়া হয়।

 

মুসাফাহার আমল সালামের মতো গুরুত্বপূর্ণ একটি সুন্নাত। যেমনিভাবে সালামের সময় একে অপরের জন্য শান্তি ও নিরাপত্তার দোয়া করে থাকেন। ঠিক তেমনি মুসাফাহার সময় একে অপরের জন্য ক্ষমাপ্রার্থনার দোয়া করতে থাকেন। আর বলতে থাকেন (উচ্চারণ): ‘ইয়াগফিরুল্লাহু লানা ওয়া লাকুম’; অর্থ: আল্লাহ তায়ালা আপনাদের এবং আমাদের ক্ষমা করুন।

 

এ কারণেই নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, মুসাফাহাকারী ব্যক্তি নিজেদের স্থান ত্যাগ করার আগেই আল্লাহ তায়ালা তাদের গুনাহ ক্ষমা করে দেন। এর চেয়ে সৌভাগ্যের আমল আর কী হতে পারে! আর মুসাফাহার মাধ্যমে একে অপরের কল্যাণ কামনা করে থাকেন। যেকোন ভালো কাজের দ্বারা যেহেতু আল্লাহর হক সম্পৃক্ত ছোট গুনাহগুলো মাফ করে দেওয়া হয়।

 

সালমান (রা.) থেকে বর্ণিত হাদিসে আরও এসেছে, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, কোন মুসলমান যখন অন্য মুসলমানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে এবং মুসাফাহা করে তখন উভয়ের গুনাহ ঝরে যায়। যেভাবে প্রবল বাতাসে শুকনো গাছের পাতা ঝরে যায়। যদিও বা তাদের গুনাহ সাগরের ফেনা সমপরিমাণ হয়। তাই কেউ যদি নিয়মিত মুসাফাহা করেন আশা করা যায় আল্লাহর হক সম্পর্কিত ছোট গুনাহগুলো থেকেও মুক্তি পাবেন মুমিন।

 

গুনাহ মাফের সেরা আমল দুই মুসলিমের দেখা-সাক্ষাতে মুসাফাহ করা বা হাত মেলানো। মুসাফাহা করার প্রতি উৎসাহ দিয়েছেন নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম। এটি সুন্নাত আমল। যখন দু’জন মুসলিম সাক্ষাতকালে মুসাফাহা করে বা হাত মেলায় সঙ্গে সঙ্গেই তাদের গুনাহ মাফ করে দেওয়া হয়। সুতরাং নবীজির ঘোষণা অনুযায়ী যখন দু’জন মুসলিম একত্রিত হয়ে মুসাফাহা করবে; তাদের বিচ্ছিন্ন হওয়ার আগেই আল্লাহ তায়ালা তাদের গুনাহ ক্ষমা করে দেবেন। এর চেয়ে সৌভাগ্যের আমল আর কী হতে পারে!

 

আর মুসাফাহার মাধ্যমে একে অপরের কল্যাণ কামনা করে থাকেন। যেকোন ভালো কাজের দ্বারা যেহেতু আল্লাহর হক সম্পৃক্ত ছোট গুনাহগুলো মাফ করে দেওয়া হয়। তাই কেউ যদি নিয়মিত মুসাফাহা করেন আশা করা যায় আল্লাহর হক সম্পর্কিত ছোট গুনাহগুলো থেকেও মুক্তি পাবেন মুমিন। মনে রাখতে হবে হারাম মুসাফাহা করা যাবে না। যেমন- কোন পুরুষ কোন গায়রে মাহরাম নারীর সঙ্গে মুসাফাহা করা। এটি মারাত্মক গুনাহ। আয়শা (রা.) থেকে বর্ণিত; তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, তারা আল্লাহর সঙ্গে কোন কিছুকে শরিক করবে না- এ আয়াত পাঠ করে স্ত্রীলোকদের কাছ থেকে বায়আত নিতেন। তিনি আরও বলেন, যাদের হাতে হাত দেওয়া বৈধ এমন মহিলা বাদে রাসুল (সা.)-এর হাত অন্য কোন মহিলার হাত স্পর্শ করেনি।

 

সুতরাং মুমিন মুসলমানের উচিত পরস্পর দেখা-সাক্ষাতে একে অপরের জন্য দোয়া করা। সুন্নাত আমলের অনুসরণ ও অনুকরণ করে নিজেদের গুনাহ মাফে সচেষ্ট থাকা। হাদিসের ওপর যথাযথ আমল করা। করমর্দন বা মুসাফাহা ইসলামের দৃষ্টিতে সুন্নত। এটি কুশল বিনিময়ের ইসলামি পদ্ধতি।

 

নবীজি (সা.) সাহাবায়ে কেরামকে মুসাফাহার মাধ্যমে কুশল বিনিময়ের শিক্ষা দিয়েছেন। আনাস ইবনে মালিক (রা.) বলেন, কোন একসময় জনৈক ব্যক্তি প্রশ্ন করল- হে আল্লাহর রাসুল! আমাদের কোন ব্যক্তি তার ভাই কিংবা বন্ধুর সঙ্গে দেখা করলে সে কি তার সামনে ঝুঁকে (নত) যাবে? তিনি বলেন, না। সে আবার প্রশ্ন করল, তাহলে কি সে গলাগলি করে তাকে চুমু খাবে? তিনি বলেন, না। সে এবার বলল, তাহলে সে তার হাত ধরে মুসাফাহা (করমর্দন) করবে? তিনি বলেন, হ্যাঁ।

 

আমাদের প্রিয় নবীজি (সা.) নিজেও কারও সঙ্গে দেখা হলে তার সঙ্গে করমর্দন করতেন এবং তার জন্য দোয়া করতেন। নবীজি (সা.) এর এই সুন্নতের প্রতি সাহাবায়ে কেরামের বিশেষ গুরুত্ব ছিল। কাউকে বিদায় দেওয়ার সময়ও মুসাফাহা করা সুন্নত। ইবনে ওমর (রা.) বর্ণনা করেন, কাউকে বিদায় দেওয়ার সময় মহানবী (সা.) নিজে হাতে ধরতেন এবং যতক্ষণ পর্যন্ত সে নিজের হাত মহানবী (সা.) থেকে না ছাড়াতেন ততক্ষণ পর্যন্ত তিনিও তার হাত ছাড়তেন না।

 

মুসাফাহা করার সুন্নত পদ্ধতি হলো উভয় হাত দিয়ে মুসাফাহা করা। যদিও ইদানীং কেউ কেউ এক হাতের পক্ষে কথা বলেন। ইবনে ওমর (রা.) বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) যখন কাউকে বিদায় দিতেন তখন তার হাত ধরে মুসাফাহা করতেন। ওই ব্যক্তি হাত সরিয়ে না নেওয়া পর্যন্ত নবীজি নিজের হাত সরিয়ে নিতেন না।

 

আবু মামার (রহ.) বর্ণনা করেন, আমি আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদকে (রা.) বলতে শুনেছি, আল্লাহর রাসুল (সা.) আমাকে তাশাহহুদ শিখিয়েছেন এমন অবস্থায় যে আমার হাত তার উভয় হাতের মধ্যে ছিল। যেভাবে আমাকে তিনি কোরআনের সুরা শিক্ষা দিতেন। মুসাফাহা করার সময় আল্লাহর প্রশংসা এবং দরুদ পাঠের কথা হাদিসে বর্ণিত হয়েছে। আর মুসাফাহা করার সময় এই দোয়া পাঠ করা উত্তম : ইয়াগফিরুল্লাহু লানা ওয়া লাকুম। মুসাফাহা করার সময় হাতে ঝাঁকি দেওয়া এবং হাত বুকের সঙ্গে মেলানো নিষ্প্রয়োজন।

 

মুসাফাহা কয় হাতে করতে হবে এ ব্যাপারে দুটি মত পাওয়া যায়। একটি হলো এক হাতে মুসাফাহা করবে। অর্থাৎ শুধু ডান হাত দিয়ে মুসাফাহা করবে। দ্বিতীয় মতটি হলো- মুসাফাহা দু’হাতে হবে। অর্থাৎ ডান হাতের সাথে বাম হাতও যোগ করা হবে। তবে এক হাতে করার ব্যাপারে বেশি শক্তিশালী দলিল পাওয়া যায়। তবে কেউ যদি দু’হাতে মুসাফাহা করে, তাতেও কোন দোষ নেই। এক হাতে বা দু’হাতে- এ নিয়ে কোন বাড়াবাড়ি করা ঠিক হবে না। মুসাফা করলেই গুনাহ মাফ হয়ে যাবে ইনশাআল্লাহ।

 

মুসাফাহা কয় হাতে হবে এ নিয়ে শায়খ মুহাম্মদ সালেহ আল মুনাজ্জিদকে প্রশ্ন করলে তিনি জবাবে বলেছেন- মুসাফাহা সংঘটিত হয় ব্যক্তি তার হাতের তালু অপর ব্যক্তির হাতের তালুতে রাখার মাধ্যমে। এটাই আরবি ভাষার দাবি। মুসাফাহা সম্পর্কে ইতোপূর্বে উল্লিখিত হাদিসগুলোর আপাত মর্ম এভাবেই বুঝতে হবে। এ কারণে অধিকাংশ আলেমের মতে এক হাতে মুসাফাহা করাই সুন্নত হিসেবে যথেষ্ট এবং এটা ছিল মুসলমানদের মাঝে ও সাহাবায়ে কিরামের মাঝে সাধারণ অভ্যাস।

 

আল্লাহ তায়ালা মুসলিম উম্মাহকে হাদিসের ওপর যথাযথ আমল করার তাওফিক দান করুন। আল্লাহ তায়ালা মুসলিম উম্মাহকে দেখা-সাক্ষাতে সালাম বিনিময়ের পর পরস্পরে হাত মেলানোর মাধ্যমে হৃদয়ে সম্পর্ক গড়ার এবং গুনাহমুক্ত জীবনের জন্য মুসাফাহার আমল ও পরস্পরের জন্য ক্ষমা প্রার্থনার দোয়া করার তাওফিক দিন। আমিন।

লেখক: ইসলামি গবেষক ও কলামিস্ট

 

পূর্বকোণ/মাহমুদ

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট