চট্টগ্রাম বৃহষ্পতিবার, ০৭ নভেম্বর, ২০২৪

চট্টগ্রামে রাস্তাঘাটের বেহাল দশা : সংস্কার-উদ্যোগ জরুরি

জহির উদ্দিন মো. ইমরুল কায়েস

২৮ অক্টোবর, ২০২৪ | ১২:২৫ অপরাহ্ণ

বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান হলেন চট্টগ্রামের সন্তান প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস। তাঁর সাথে সরকারের ক্যাবিনেটে রয়েছেন চট্টগ্রামের আরো পাঁচজন গুরুত্বপূর্ণ উপদেষ্টা। অনেকে বলেন বাংলাদেশ নাকি বর্তমানে চাঁটগাইয়া লোকেরা পরিচালনা করছেন। চট্টগ্রামের জন্য আরো সুখবর যে, এই প্রথম চাঁটগার কোন সন্তান দেশের নির্বাহী বিভাগের প্রধান হিসেবে দেশ পরিচালনা করছেন। শুধু তাই নয়। সরকারের গুরুত্বপূর্ণ বেশির ভাগ উপদেষ্টাও যেহেতু চট্টগ্রামের, সেহেতু চট্টগ্রামের বহুমাত্রিক উন্নয়ন কর্মকাণ্ড পরিচালিত হওয়া অপ্রাসঙ্গিক কিছু নয়। কিন্তু চট্টগ্রামে বহুমাত্রিক উন্নয়ন কর্মকান্ড হওয়াতো দূরের কথা। চট্টগ্রাম শহরে বর্তমানে রাস্তাঘাটের সংস্কারমূলক রুটিন কাজও পরিচালিত হচ্ছে না। কিন্তু একসময়ের প্রাচ্যের রাণী এবং হাল আমলের বাণিজ্যিক রাজধানী খ্যাত চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন আওতাধীন রাস্তাঘাটগুলোর যাচ্ছেতাই অবস্থা।

 

বিগত ভয়াবহ বন্যামৌসুম পার হয়ে যাবার পর আপামর চট্টগ্রাম শহরের রাস্তাঘাটের দ্রুত মেরামতের যে প্রয়োজন ছিল চসিক সে রুটিন ওয়ার্ক না করার কারণে শহরের রাস্তাঘাটে বর্তমানে অস্থিরতা অবস্থা বিরাজ করছে। শহরের বর্তমান অবস্থা দেখে উপায় নেই এই শহরকে দেখার মতো কোন অভিভাবক আছে। বর্ষাকালে চট্টলার রাস্তাগুলো ডুবে ছিল বন্যার পানিতে। আর বর্ষাপরবর্তী পুরো শহর খানা-খন্দকে ভরে গেছে। সে সাথে ওয়াসার নানা জায়গায় খোঁড়াখুঁড়ির ফলে ‘মরার উপর খাড়ার ঘা’ হওয়ার উপক্রম চট্টগ্রামবাসীর। চট্টগ্রাম শহরের এমন কোন রাস্তাঘাট আর অবশিষ্ট নাই, যা পুরোপুরি ফিট অবস্থায় আছে। মুরাদপুর থেকে অক্সিজেন পর্যন্ত সড়কটি চলাফেরার জন্য আর মোটেই উপযুক্ত নয়। প্রায় পাঁচ কিলোমিটার দীর্ঘ এই সড়কটির বিভিন্ন অংশে সৃষ্টি হয়েছে কয়েকশত ছোট বড় গর্ত। বিগত কয়েক বছর ধরে এই সড়কটির অবস্থা খারাপ থেকে আরো অধিকতর খারাপের দিকে যাচ্ছে। সবচেয়ে ভয়াবহ অবস্থা বিবিরহাট, হামজারবাগ, আতুরার ডিপো, মুরাদপুর রেল লাইনের কাছাকাছি অংশগুলো। এই সড়কটি সর্বদা ব্যস্ত থাকার কারণে এবং রাস্তা নষ্ট হেতু সারাক্ষণ যানজটের ফলে পথচারীর চলাফেরা দুঃসাধ্য হয়ে উঠেছে। এই পাঁচ কিলোমিটার রাস্তা পাড়ি দিতে এখন আধা ঘণ্টা বা তার চেয়েও বেশি সময় লাগে। হাটহাজারী-নাজিরহাট-ফটিকছড়ি-খাগড়াছড়ি, রাউজান, রাঙ্গুনিয়াগামী যাত্রীরা এই সড়কটি ধরে চলাফেরা করার কারণে তাদের দুর্ভোগের শেষ নাই। সড়কদুর্ঘটনা এ সড়কের নিত্যনৈমিত্যিক বিষয়। খুব তড়িৎগতিতে এ সড়কের উন্নয়নের কাজে হাত না দিলে খুব অল্পসময়ের মধ্যে চট্টগ্রামের এই গুরুত্বপূর্ণ সড়কটি সম্পূর্ণরূপে বন্ধ হয়ে যাবে।

 

পাহাড়-পর্বত আর নৈসর্গিক পরিবেশ সাথে সবুজে ঘেরা আমাদের সিআরবি এলাকা। কদমতলি-বটতলি ও সাইফুদ্দীন খালেদ রোড হয়ে একদিকে ইস্পাহানি মোড় এবং আরেক দিকে কাজিরদেউড়ি বাজারের সাথে সড়কটির সংযোগ। গুরুত্বপূর্ণ এই সড়কে দৈনিক হাজার হাজার গাড়ি ও পথচারী যাতায়াত করেন। কিন্তু বর্তমানে সাত রাস্তার সংযোগস্থল সমৃদ্ধ সিআরবি এলাকার রোডটির অবস্থা শোচনীয়। শতশত ট্রেনের যাত্রীকে এই রাস্তাটি ধরে চলাফেরা করতে হয়। রাস্তার বেহাল অবস্থার কারণে অগণিত যাত্রীকে নাকাল অবস্থা পোহাতে হচ্ছে। চট্টগ্রামের পর্যটনের অন্যতম আকর্ষণীয় এলাকা হিসেবে বহু পর্যটক সিআরবি এলাকা পরিদর্শন করেন। কিন্তু রোডটি দীর্ঘদিন ধরে সংস্কারের অভাবহেতু চলাফেরার অযোগ্য হয়ে পড়েছে। শুধু তাই নয়। রোডটির অনতি দূরেই চট্টগ্রাম সার্কিট হাউজ, চিটাগাং ক্লাব, এমএ আজিজ স্টেডিয়াম এবং রেডিসন ব্লুসহ আরো গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা। চট্টগ্রামের ভিআইপি এলাকার এই রোডটি দীর্ঘদিন ধরে কিভাবে অবহেলায় অবস্থা পড়ে থাকে তা সত্যি ভাবার বিষয়। রাস্তা ভাঙ্গা থাকার কারণে সিএনজি এবং অন্যান্য যানবাহন অপেক্ষাকৃত স্লোভাবে চলার কারণে পকেটমারের উপদ্রুবও বেড়েছে। চট্টগ্রামের ঐতিহ্যের সাথে এই সড়কটি জড়িত থাকায় দ্রুত এই সড়কের কাজ শুরু না করলে চট্টগ্রামের নামের প্রতি অসম্মান হচ্ছে।

 

স্টেশন রোডের অবস্থাও তথৈবচ। চট্টগ্রাম শহরের অন্যতম ব্যস্ততম রোড হওয়ার কারণে লক্ষ লক্ষ যাত্রী এই রোডটি দৈনন্দিন ব্যবহার করে থাকেন। কিন্তু দেড় থেকে দুই কিলোমিটার ব্যাপী এই সড়কের উভয় অংশে বড় বড় গর্ত সৃষ্টি হয়ে গাড়ি চলাচলে বড় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে। যানজটে নাকাল হচ্ছে দৈনিক অফিসগামী ও সাধারণ যাত্রীরা। নিউ মার্কেট মোড়েও রয়েছে রাস্তায় বড় বড় গর্ত। কোতোয়ালী মোড় থেকে লাল দিঘী, পুরো জুবিলী রোড, এস. এস. খালেদ রোড, মোহাম্মদ ইউছুপ চৌধুরী সড়ক, সিডিএ এভিন্যু, দুই নম্বর গেইট, মুরাদপুর, বহদ্দারহাট, হালিশহর, আগ্রাবাদ, চট্টেশ্বরী রোড, মেহেদীবাগ, দামপাড়া গরিবুল্লাহ শাহ মাজার রোড, টাইগার পাস থেকে বটতলিসহ সমগ্র শহরের বেশিরভাগ রোডই চলাফেরার অযোগ্য। ৫ আগস্ট বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে অন্তর্বর্তী সরকার আসার পর পূর্ববর্তী স্বেচ্ছাচারী সরকারের প্রধানের পদত্যাগ অতঃপর সরকারের অন্যান্য মন্ত্রী, এমপি এবং বড় বড় নেতারা গা ঢাকা দেওয়ার পরে সিটি কর্পোরেশনের মেয়ররাও পর্যায়ক্রমে গা ঢাকা দেন। সেই থেকে চট্টগ্রামের মেয়র রেজাউল করিমেরও আর হদিস নেই। দায়িত্ব নেওয়ার তিনবছর ছয় মাস ৪ দিনের মাথায় চসিকের মেয়র রেজাউল করিমকে অপসারণ করা হয়েছে। তাঁকে অপসারন করে বিগত ২০ আগস্ট বর্তমানে চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনারকে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের (চসিক) প্রশাসক হিসেবে দায়িত্ব দেওয়া হলেও প্রশাসকের তরফ থেকে চসিক আওতাধীন রাস্তাঘাট সংস্কারে তেমন উদ্যোগ গ্রহণ করতে দেখা যাচ্ছে না।

 

সড়কের বড় বড় গর্ত তথা খানাখন্দক গুলোতে ইট বালির সাথে বিটুমিনের সংমিশ্রণ ঘটিয়ে গর্তগুলো আপাতত ভরাট করে দিলে নগরবাসী ঝক্কি ঝামেলা এড়িয়ে চলাফেরা করতে পারত। চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনকে এ ব্যাপারে কেন জানি উদাসীন মনে হচ্ছে। ১ অক্টোবর চট্টগ্রামের প্রথম যুগ্ম জেলা জজ ও নির্বাচনী ট্রাইব্যুনালের বিচারক বিগত ২০২১ সালে অনুষ্ঠিত চসিক মেয়র নির্বাচনে ব্যাপক কারচুপির প্রমাণ পান। সেই সঙ্গে বিএনপির মেয়র প্রার্থী নগর বিএনপির সাবেক সভাপতি ডা. শাহাদাত হোসেনের দায়ের করা মামলায় তাঁকে মেয়র হিসেবে ঘোষণা করে আগামী ১০ দিনের মধ্যে গেজেট প্রকাশ করার নির্দেশও দেওয়া হয়। গত ৮ অক্টোবর ইসি সচিবের সইয়ে এই সংক্রান্ত সংশোধনী গেজেট প্রকাশিত হলেও স্থানীয় সরকার মন্ত্রীর অসুস্থতাজনীত কারণে নতুন মেয়রের শপথ অনুষ্ঠানের তারিখ এখনো নির্দিষ্ট হয়নি। সবকিছু দেখে মনে হচ্ছে চসিকে একটা মারাত্মক স্থবিরতা বিরাজ করছে। মেয়র আসবে মেয়র যাবে কিন্তু সেই অজুহাতে চট্টগ্রামের মতো গুরুত্বপূর্ণ একটি শহরে মাসের পর মাস রাস্তাঘাটের বেহাল অবস্থা বিরাজ করবে তা কোনভাবেই মেনে নেওয়া যাচ্ছে না। মেয়রের অনুপস্থিতিজনীত কারণে বড় বড় সংস্কার কাজ বন্ধ থাকবে তা স্বাভাবিক। কিন্তু সড়কের খানা-খন্দক ভরাটের মতো রুটিন ওয়ার্ক গুলো চলমান থাকবে না- তা মোটেই কাম্য নয়।

 

সিটি কর্পোরেশনের প্রশাসক, প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা এবং প্রকৌশল বিভাগ এ ব্যাপারে কারো অপেক্ষায় না থেকে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের আওতাধীন বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সড়কের প্রয়োজনীয় সংস্কার কাজে হাত দেওয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে পৌর নাগরিকগণ আশা পোষণ করেন। কারণ তড়িৎগতিতে সড়কের এই সংস্কার কাজে হাত না দিলে একদিকে যেমন মানুষের অসহনীয় যন্ত্রণার ব্যাপকতা বাড়াচ্ছে অপরদিকে সড়কের ছোট ছোট গর্তগুলো দিনে দিনে আরো ব্যাপকতর অবস্থা ধারণ করে সিটি কর্পোরেশেনের সড়ক সংস্কারের বাজেটকে আওতার বাহিরে নিয়ে যাচ্ছে। রুটিন কাজ বৃহত্তর প্রজেক্টে রূপান্তরিত হচ্ছে। রাস্তাঘাটের এই ভয়াবহ অবস্থার কারণে ৫০ লক্ষ চট্টগ্রামবাসীর কাজে-কর্মে এখন স্থবিরতা নেমে এসেছে। ছাত্রছাত্রীরা সুচারুভাবে স্কুল-কলেজে গমন করতে পারছে না। এই ভাঙ্গা-চোরা রাস্তাতে চলাফেরা করতে গিয়ে রোগীদের অবস্থা আরো দুর্বিষহ হয়ে উঠছে। মোটকথা, সমগ্র চট্টগ্রামবাসী সড়কের ভয়াবহতায় আজ নাজেহাল। এই ভয়াবহতা থেকে পরিত্রান পাবার জন্য আর সময় নষ্ট না করে দ্রুত রাস্তা সংস্কারের কাজে হাত দিয়ে চট্টগ্রামবাসীকে এই ভয়াবহতা থেকে উদ্ধারের জন্য স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের মাননীয় উপদেষ্টা ও চসিকের সংশ্লিষ্ট বিভাগ ও কর্মকর্তাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।

 

লেখক : প্রাবন্ধিক, পরিবেশ-মানবাধিকারকর্মী।

পূর্বকোণ/ইব

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট