চট্টগ্রাম শনিবার, ২৭ এপ্রিল, ২০২৪

মোর্শেদ খান মাহবুবের পথে নোমান- হাফিজ-আলতাফ ?

শিবুকান্তি দাশ হ ঢাকা অফিস

৮ নভেম্বর, ২০১৯ | ২:৫১ পূর্বাহ্ণ

পর পর দুই দিনে দুই শীর্ষস্থানীয় নেতার দল থেকে পদত্যাগে আবারও আলোচনায় বিএনপি। গত বুধবার দল ছাড়লেন বিএনপির সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম স্থায়ী কমিটির সদস্য লে. জে. (অব.) মাহবুবুর রহমান। তার আগের দিন দল ছাড়লেন ভাইস চেয়ারম্যান এম মোর্শেদ খান। এখানেই শেষ নয়, আরো কয়েকজন সিনিয়র নেতার পদত্যাগের গুঞ্জন চলছে। তাদের মধ্যে বিএনপি সরকারের সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আলতাফ হোসেন, সাবেক মন্ত্রী ও দলের ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল্লাহ আল নোমান, মেজর হাফিজ উদ্দিনের নামও শোনা যাচ্ছে। যারা পদত্যাগ করেছেন তারা সবাই ব্যক্তিগত কারণ উল্লেখ করলেও দলে এবং বাইরে আলোচনা ব্যত্তিগত কারণ ছাড়াও অন্য কারণ রয়েছে। তাদের মতে, দেশে একটা রাজনৈতিক অস্থিরতা সৃষ্টির পাঁয়তারা চলছে। সেই

অস্থিরতা থেকে কোনো কোনো মহলের চাপেও বিএনপি নেতাদের এই পদত্যগের ঘটনা ঘটতে পারে। তবে যারা পদত্যাগ করছেন তাদের কেউ কেউ গণমাধ্যমে আকার ইঙ্গিতে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের স্বেচ্ছাচারিতার কথা উল্লেখ করেছেন। খালেদা জিয়ার অনুপস্থিতিতে তারেক রহমান লন্ডনে বসে একক সিদ্ধান্তে দলকে পরিচালনা করছেন। সম্প্রতি সিলেটে জেলাও মহানগর যুবদলের কমিটি গঠনকে কেন্দ্র করে সিলেট সিটি করপোরেশনের মেয়র আরিফুর রহমানসহ সিনিয়র নেতারা গণপদত্যাগের ঘোষণা দিয়েছেন। তাদের অভিযোগ যারা রাজপথের আন্দোলন সংগ্রামে কখনো ছিল না তাদেরকে দিয়ে তারেক রহমান কমিটি গঠন করেছেন।

বিএনপিতে সিনিয়রদের মূল্যায়নের বিষয়টিও উপেক্ষিত হবার কথা অনেকে বলছেন। যে কারণে গত কয়েক বছরে সিনিয়র অনেকে দল ছেড়ে চলে গেছেন। তাদের মধ্যে জিয়াউর রহমানের ঘনিষ্ঠ কর্নেল অলি আহমদ, ডা. বদরুদ্দোজা চৌধুরী, শমসের মবিন খান, এনাম আহমেদ চৌধুরী, আলী আজগর লবি উল্লেখযোগ্য।

তবে নেতাদের এ পদত্যাগের বিষয়ে বিএনপি নেতৃত্ব খুব বিচলিত নয় বলে জানিয়েছেন দলের সিনিয়র দুইজন নেতা। তারা বলেন, বিএনপি অনেক বড় দল। এখানে কেউ যাবে কেউ আসবে। তাতে দলে তেমন প্রতিক্রিয়া হবে না। তাছাড়া ভিন্ন কথাও বলেন কেউ কেউ।

যদিও বিএনপির দায়িত্বশীল সূত্রগুলো বলছে ভিন্ন কথা। তাদের পর্যবেক্ষণ, মোরশেদ খান দলে গুরুত্বহীন হয়ে পড়েছিলেন। দলের সম্ভাব্যতা যাচাই করে তিনি কোনও সম্ভাবনা দেখতে পাননি। বয়সের সামথ্যের পাশাপাশি নিজের ব্যবসায়িক লাভ-ক্ষতির জায়গা থেকে তিনি অবসরের চিন্তা করতে পারেন।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার জমির উদ্দিন সরকার মনে করেন, মোরশেদ খানের পদত্যাগের পেছনে তিনি যে কারণ দেখিয়েছেন, তা দৃশ্যমান কারণ। এর নেপথ্যে অন্য কারণও আছে। সাবেক রাষ্ট্রপতি ও স্পিকার বলেন, ‘দেশের অবস্থা সম্পর্কে আঁচ করতে পারেন। আওয়ামী লীগের মধ্যেও অস্থিরতা, এখন বিএনপির মধ্যে অস্থিরতা সৃষ্টি করতে চায় একটি মহল।’ এর অংশ হিসেবেই এসব পদত্যাগ বলে দাবি করেন তিনি।
জমির উদ্দিন সরকার বলেন, ‘মোরশেদ খান যেসব কথা বলেছেন, এগুলো বলার কথা। দলের প্রতি তার যথেষ্ট শ্রদ্ধা আছে। দলের প্রতি আমাদের পার্টির যারা আছেন, সবারই শ্রদ্ধা আছে। তারপর কেউ কেউ কিছু স্টেটমেন্ট দিচ্ছে। দেশের অবস্থা কী, আপনারা বুঝতে পারছেন না।’
বিএনপির স্থায়ী কমিটির একাধিক সূত্র জানায়, মাহবুবুর রহমানের পদত্যাগের পেছনে কারণ দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সরাসরি বিরোধিতা করা। গত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর তিনি একাধিক অনুষ্ঠানে দলের চেয়ারম্যান নিয়ে মন্তব্য করেন। এরপরও সাবেক এই সেনা কর্মকর্তা স্থায়ী কমিটির বৈঠকে অংশ নিতেন। গত আড়াই মাস ধরে বৈঠকে অংশগ্রহণ থেকে বিরত থাকেন তিনি।
গত জানুয়ারিতে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে মাহবুবুর রহমান অভিযোগ করেন, একাদশ নির্বাচনে গিয়ে বিএনপি ভুল করেছে। যদি দলের নেতৃত্ব দিতে হয়, তারেক রহমানকে দেশে আসতে হবে। দেশে এসেই তাকে নেতৃত্ব দিতে হবে। বিদেশ থেকে দলের নেতৃত্ব দেওয়া সম্ভব নয়।
জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ নিয়ে দলীয় ফোরামে বিভক্তি ছিল। তবে দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ও ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান দুজনই নির্বাচনের বিষয়ে একমত ছিলেন। দলীয় ফোরামে অনেক রকম আলোচনা হয়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ১/১১ এর সময় বিএনপির সংস্কারবাদীদের একজন ছিলেন মাহবুবুর রহমান। এর জেরে দলের সাধারণ নেতাকর্মীরা তাকে মানিক মিয়া এভিনিউতে ধাওয়া দিয়েছিলেন। অভিযোগ আছে, কয়েকজন কর্মী তার গায়েও হাত দেয়। যদিও পরে ডেকে এনে তাকে দলে পদ দেন খালেদা জিয়া।

২০১৯ সালে বইমেলায় লেখক মহিউদ্দিনের ‘এক-এগারো বাংলাদেশ ২০০৭-২০০৮’ নামে একটি বই প্রকাশিত হয়। সেই বইয়ে মাহবুবুর রহমানের একটি সাক্ষাৎকার আছে। সেখানে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান সম্পর্কে মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘১/১১-এর পরে বিএনপিতে ইনিশিয়ালি আমার একটু অসুবিধা হয়েছিল। যা-ই হোক, দল আন্ডারস্টুড মাই পজিশন। দল মানে খালেদা জিয়া। তারেক স্টিল নট হ্যাপি মাই পজিশন।’

এই সাক্ষাৎকারে তারেক রহমানকে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব করা প্রসঙ্গে মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘গ্র্যাজুয়াল মুভ করা হলে এক জিনিস। কিন্তু একেবারে সিনিয়র জয়েন্ট সেক্রেটারি? এটা একটা ব্লানডার!’

মাহবুবুর রহমান বিএনপির সঙ্গে জামায়াতের জোট নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন একাধিকবার। গত জানুয়ারিতেই গণমাধ্যমে তিনি বলেন, ‘এমন কোনও দলের সঙ্গে বিএনপির জোট করা উচিত নয়, যে দলের নীতি-আদর্শ সম্পূর্ণ বিপরীত। মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমানের প্রতিষ্ঠিত দল স্বাধীনতাবিরোধী জামায়াতের সঙ্গে ঐক্য করতে পারে না। বিএনপির উচিত জামায়াতের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করা। এ ক্ষেত্রে আমি জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের নেতা ড. কামাল হোসেনের অবস্থানকে সমর্থন করি। জামায়াত বিএনপির শক্তি নয়, বোঝা।’ বিএনপি কেন বোঝা বহন করে চলবে, নেতাকর্মীরা এমনটি মনে করে বলে মন্তব্য করেন তিনি।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির একাধিক সদস্য মনে করছেন, কেন্দ্রীয় নেতাদের পদত্যাগের পেছনে ভিন্ন কোনও গোষ্ঠীর সম্পর্ক থাকতে পারে। দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি অস্থিতিশীল থাকলে যাদের সুবিধা, ওই পক্ষেরই কোনও না কোনও চাপে নেতারা পদত্যাগের সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন।
বিএনপির একটি পক্ষের দাবি, আজ পর্যন্ত যারাই দল ছেড়েছেন, তাদের পদত্যাগের পেছনে ব্যক্তিগত কারণ কাজ করেছে বলে নেতাকর্মীরা মনে করেন। অতীতে আবদুল মান্নান ভুঁইয়ার মতো নেতারা দল ছেড়ে গেলে কোনও প্রভাব পড়েনি। অন্যদিকে সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারক হিসেবে না থাকলেও মৃত্যুর পর সাদেক হোসেন খোকা দলের সর্বস্তরের শ্রদ্ধা পেয়েছেন। যেখানে বিএনপির লাখ লাখ নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে মামলা, এর ওপর দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া জেলে। এ অবস্থায় কেন্দ্রীয় কয়েকজন নেতার চলে যাওয়ায় দলে কোনও প্রভাব পড়বে না। এসব পদত্যাগকারী নেতা গত এক যুগে রাজপথে কোনও কমসূচিতেও অংশ নেননি।

বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার জমির উদ্দিন সরকার বলেন, আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪ দলের শরীক দল ওয়ার্কাস পাটির সভাপতি ‘রাশেদ খান মেনন সম্প্রতি নির্বাচন নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন, সেই অবস্থান তিনি পরিবর্তন করেছেন। কোন চাপে?’ বিএনপি নেতাদের দল ছাড়ার পেছনে এ ধরনের কোনও চাপ থাকতে পারে বলে মনে করেন তিনি।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট