বাংলাদেশে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে গার্মেন্টস, বিদ্যুৎ ও টেলিযোগাযোগ খাতে বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) আশানুরূপভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে (ইউএনসিটিএডি, ২০২৩)। তবে এখনও এমন কিছু মৌলিক ও কাঠামোগত প্রতিবন্ধকতা রয়েছে, যা বৈচিত্র্যময় এবং দ্রুত বিনিয়োগ প্রবাহের পথে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রধান প্রতিবন্ধকতাসমূহ-
১. আমলাতান্ত্রিক জটিলতা ও নিয়ন্ত্রক সংস্থা: বিনিয়োগ অনুমোদনের প্রক্রিয়া দীর্ঘ এবং বিভিন্ন সংস্থার মধ্যে দায়িত্বের ওভারল্যাপ বিদ্যমান (সিপিডি, ২০২৪)। কোম্পানি নিবন্ধন বা পরিবেশগত ছাড়পত্র পেতে সপ্তাহ থেকে মাস পর্যন্ত সময়ক্ষেপণ হয়।
২. অপ্রতুল অবকাঠামো: বিদ্যুৎ বিভ্রাট, কারিগরি অদক্ষতা, লজিস্টিক দুর্বলতা ও চট্টগ্রাম বন্দরের জাহাজ জট ব্যবসার গতি কমিয়ে দেয় (বিশ্ব ব্যাংক, ২০২০)।
৩. নীতিগত ও আইনি অনিশ্চয়তা: করনীতি বা আমদানি শুল্কের আকস্মিক পরিবর্তন বিদেশি বিনিয়োগকারীদের জন্য একটি বড় ঝুঁকি (বিডা, ২০২৪)।
৪. দুর্নীতি ও শাসনব্যবস্থার দুর্বলতা: সরকারি দপ্তরগুলোতে ঘুষ ও অনৈতিক প্রভাব বিস্তারে দীর্ঘদিনের অভিযোগ রয়েছে; যার গবেষণালব্ধ দালিলিক প্রমাণ রয়েছে (সিপিডি, ২০২৪)।
৫. বিদেশি মুদ্রা বিনিময় নিয়ন্ত্রণ: কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণে বিদেশি বিনিয়োগকারীর লভ্যাংশ প্রেরণ জটিল ও সময়সাপেক্ষ (বাংলাদেশ ব্যাংক, ২০২৪)।
৬. দুর্বল বিচারব্যবস্থা ও সালিশ কাঠামো: বাণিজ্যিক বিরোধ নিষ্পত্তি সময়সাপেক্ষ; কখনও কখনও তা বছরের পর বছর গড়াতে থাকে, যা চুক্তি বাস্তবায়নকে বাধাগ্রস্ত করে (বিশ্ব ব্যাংক, ২০২০)।
৭. দক্ষ শ্রমশক্তির ঘাটতি: বাংলাদেশের শ্রমবাজারে মাঝারি থেকে উচ্চদক্ষতাসম্পন্ন কর্মীর ঘাটতি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে বড় একটি চ্যালেঞ্জ হিসেবে চিহ্নিত রয়েছে (বিশ্ব ব্যাংক, ২০২০)।
৮. রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা ও নিরাপত্তা ঝুঁকি: রাজনৈতিক সহিংসতা ও ঘনঘন ধর্মঘটের প্রবণতা বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আস্থার সংকট সৃষ্টি করে (ইউএনসিটিএডি, ২০২৩)।
প্রতিবন্ধকতা নিরসন কৌশল
১. ওয়ানস্টপ সার্ভিস (ওএসএস) এবং নিয়ন্ত্রক সংস্থার সংস্কার: ২০১৯ সালে চালু হওয়া বিডার ওএসএস পোর্টাল বিনিয়োগকারীদের জন্য একই প্ল্যাটফর্মে একাধিক সেবা আনার চেষ্টা করছে (বিডা, ২০২৪)। বর্তমানে ৬০টিরও বেশি সেবা এখানে পাওয়া যাচ্ছে এবং ভবিষ্যতে ১৫৪টি সেবা সংযুক্ত করার লক্ষ্য রয়েছে। এটির ক্রমাগত উন্নয়ন অব্যাহত রাখতে হবে।
২. অবকাঠামো উন্নয়ন: সরকার বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষের (বেজা) মাধ্যমে শতাধিক অর্থনৈতিক অঞ্চলের উন্নয়নে কাজ করছে (বিডা, ২০২৪)। এটির পুনর্মূল্যায়ন করে বিনিয়োগবান্ধব করতে হবে।
৩. নীতির স্থিতিশীলতা ও স্বচ্ছতা: বিনিয়োগবান্ধব দীর্ঘমেয়াদি নীতিমালা গ্রহণ এবং বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে নিয়মিত পরামর্শ করে তাদের এ বিষয়ে অবগত রাখতে হবে (সিপিডি, ২০২৪)।
৪. দুর্নীতিবিরোধী ব্যবস্থা: দুর্নীতি দমন কমিশনের কার্যকর ও স্বাধীন ভূমিকা নিশ্চিত করা প্রয়োজন, যাতে সরকারি সেবার জবাবদিহিতা বৃদ্ধি পায় (বিশ্ব ব্যাংক, ২০২০)।
৫. বিদেশি মুদ্রানীতির উদারীকরণ: বাংলাদেশ ব্যাংক ও বাণিজ্যিক ব্যাংকের মধ্যে কার্যকর সমন্বয় এবং লভ্যাংশ প্রত্যর্পণে নির্ভরযোগ্য সময়সীমা নির্ধারণ করতে হবে (বাংলাদেশ ব্যাংক, ২০২৪)।
৬. বিচার ব্যবস্থার সংস্কার: বাণিজ্যিক আদালত, বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি কেন্দ্র (এডিআর) এবং আইসিএসআইডি, ইউএনসিআইটিআরএএল’র মতো আন্তর্জাতিক বিরোধ নিষ্পত্তি কাঠামোতে সক্রিয় অংশগ্রহণ করা জরুরি (বিডা, ২০২৪)।
৭. মানবসম্পদ উন্নয়ন: তথ্যপ্রযুক্তি, ইলেকট্রনিক্স ও লজিস্টিকসসহ খাতভিত্তিক কারিগরি শিক্ষায় বিনিয়োগ নিশ্চিত করতে হবে (সিপিডি, ২০২৪)।
৮. রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা: নিয়মতান্ত্রিক ক্ষমতা হস্তান্তর এবং শক্তিশালী মুদ্রানীতির মাধ্যমে দেশের অর্থনৈতিক পরিবেশে আস্থা ফিরিয়ে আনতে হবে (ইউএনসিটিএডি, ২০২৩)।
উপসংহার: বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থান, সস্তা শ্রম এবং অভ্যন্তরীণ বড় বাজার বিদেশি বিনিয়োগের জন্য এক অনন্য সম্ভাবনা সৃষ্টি করেছে। তবে এসব সম্ভাবনার পূর্ণ বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে হলে আমাদের দরকার নীতিগত স্বচ্ছতা, অবকাঠামোগত উন্নয়ন এবং আইনি নিরাপত্তার নিশ্চয়তা। সরকার, বেসরকারি খাত এবং আন্তর্জাতিক অংশীদারদের সমন্বিত প্রচেষ্টাতেই গড়ে উঠবে একটি টেকসই, প্রতিযোগিতামূলক ও বিশ্বমানের বিনিয়োগ পরিবেশ।
তথ্যসূত্র:
-Bangladesh Investment Development Authority (BIDA)
https://bida.gov.bd
-World Bank Group – Doing – Business Report 2020
https://www.doingbusiness.org
-Bangladesh Bank – Annual Report 2023-24, Chapter on FDI Inflows.
-CPD (Centre for Policy Dialogue) – Investment Climate in Bangladesh: Progress and Bottlenecks, February 2024.
-UNCTAD – World Investment Report 2023: South Asia Focus.
https://unctad.org/publication
-Bangladesh – Fast Track Project Monitoring Committee Brief, 2024.
https://pmo.gov.bd