চট্টগ্রাম শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

জল পাহাড় আর সোনারোদের গল্প

রোকসানা বন্যা

১৩ ডিসেম্বর, ২০১৯ | ৪:৪০ পূর্বাহ্ণ

পাবলিক বাসে এই প্রথম দূরের যাত্রা আমার। রাতে সিদ্ধান্ত নিলাম আর সকালে নগরের অক্সিজেন মোড়ে এসে টিকেট কেটে উঠে বসলাম একটি পাবলিক বাসে। বিরতিহীন বাস। দু’জন নারীর সঙ্গে অভিভাবকসুলভ কোনো পুরুষ না দেখে অন্যান্য যাত্রীদের কৌতূহলী দৃষ্টিকে উপেক্ষা করে আমরা দু’বন্ধু মেতে উঠেছি তুখোড় আলাপে। আমরা কথা বলছি আর জানালা পাশ দিয়ে দেখছি সেলুলেডের মতো সাজানো একেকটি দৃশ্যকে। বাস একসময় সমতল ভূমি ছেড়ে উঠে পড়ে পাহাড়ি রাস্তায়। আঁকাবাঁকা মসৃণ পথ বেয়ে দুরন্ত বেগে চলছে। চারিদিকে সবুজের সমাহার আর পাহাড়ঘেরা পথ। মনের খেয়ালে গেয়ে উঠি, ‘গ্রামছাড়া ওই রাঙামাটির পথ…’ যদিও জানি করিগুরু এই রাঙামাটি নিয়ে এ গান রচনা করেননি। গানের ইতিহাস থাক আজ ভ্রমণের গল্প বলি।

ঘুরে বেড়ানো আমার সখ। মানুষের নানারকমের সখ থাকে। আমার সে ছেলেবেলা থেকেই বেড়ানোর খুব ইচ্ছে ছিল। বাড়ির বড়রা যখন বাইরে ঘুরতে যেতো, অথবা সিনেমা দেখতে যেতো আমি মন খারাপ করে বসে থাকতাম। মাঝে মাঝে খুব কান্না পেতো। আমার বাবা সবার সাথে যখন তখন ঘুরতে যেতে দিতে চাইতেন না। কাজেই এখন কেউ বেড়ানোর কথা বললেই আমি কাপড় গোছানো শুরু করি।
আমি অনেকবার রাঙামাটি গিয়েছি। তবুও বারবার মন চায় এমন জায়গায় যেতে। আকাশের মেঘ ছ্ুঁয়ে যায় পাহাড়ের বুকে। আঁকাবাঁকা এই পথে যেতে যেতে দূর সবুজ পাহাড়ের ভাঁজে ভাঁজে মেঘের খেলাও চলে এই শরৎ, হেমন্ত আর শীতে। এখানে পাহাড়ের কোল ঘেঁষে ঘুমিয়ে থাকে শান্ত জলের হ্রদ। এশিয়ার বৃহত্তম কৃত্রিমহ্রদ। সীমানার ওপারে নীল আকাশ মিতালী করে হ্রদের। সাথে, আঁছড়ে পড়ে পাহাড়ের বুকে। এখানে চলে পাহাড় আর হ্রদের এক অপূর্ব মিলনমেলা। দেখেই প্রাণ ভরে ওঠে।

আগে থেকেই হোটেল বুকিং করা ছিলো। রাঙামাটি শহরের শেষ প্রান্তেই কাপ্তাই হ্রদের তীর ঘেঁষে অবস্থিত সরকারি পর্যটন হোটেল। খুবই দৃষ্টিকাড়া আকর্ষণীয় স্থান এটি। ওয়েটিং রুমে বসলাম। কিছুক্ষণ বসার পর হোটেল বয় আমাদের নিয়ে গেলো রুম দেখাতে। পছন্দমতো রুমে গেলাম আমরা। চারতলায় আমাদের রুম। যথেষ্ট সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন সেখানকার কর্মকর্তা, কর্মচারি সবাই। একটু সতর্ক করে দিয়ে বলেছিলো বারান্দার দরজা যেন খোলা না রাখি বানর আসতে পারে। পর্দা সরিয়ে জানালার স্বচ্ছ কাচ দিয়ে দেখলাম সোনারোদের আলোয় লেকের পানি চিকচিক করছিল। আর পাহারের গাছপালা তার সবুজের যতখানি পারা যায় তা দিয়ে আদরে জলকেলিতে মেতেছিলো। আর ধৈর্য ধরতে পারলাম না। দরজা খুলে ব্যালকনিতে দাঁড়ালাম, মনে হলো প্রকৃতি আমাকে সম্ভাষণ জানানোর জন্য তার ডালপালা ছড়িয়ে, পাহাড় পর্বত, নদী, লেক সবকিছু নিয়ে যেন দাঁড়িয়ে আছে একেবারেই বারান্দা ছ্ুঁয়ে। শান্ত লেকের পানি আর চারিদিকে কেবল পাহাড় আর পাহাড়। দেখে মনে হলো যেন কোনো চিত্রশিল্পীর আঁকা ছবি। এখানে পাহাড়ের ভাঁজে ভাঁজে লুকিয়ে আছে মৌনতার সুতোয় বোনা অনেক গল্প। সে গল্প শুনতে হলে কান পাততে হয় নীরবে। হ্রদের মাঝখান দিয়ে বয়ে চলা নৌকার শব্দ কখনো কখনো সে নীরবতা ভেঙে দিচ্ছে।
আমরা যা যা কল্পনায় এঁকেছি তার সবটুকুই ছুঁতে পেরেছি। দুপুরে খাওয়ার পর্ব শেষ করে বের হবো ভাবছিলাম। একটু বারান্দায় বসে গল্প করছি। হঠাৎ কালোমেঘে আকাশ ছেয়ে গেল। ঝড়ো হাওয়ায় গাছের পাতা ঝরে পড়ে নদীতে। সারি বেঁধে পাতারা এঁকেবেঁক ভেস যাচ্ছে। তাদের চলার সৌন্দর্য আমাদের পুলকিত করে। বৃষ্টি দেখে মাঝিরা নৌকাগুলো কিনারে ভিড়াচ্ছে। বৃষ্টি শুরু হয়ে গেছে এর মধ্যে। দারুণ লাগছে এই সময়টা। বৃষ্টির ফোঁটাতে হাত বাড়িয়ে দিলাম। পানির ছিটা নিয়ে খেলা করতে করতে সেই ছেলেবেলায় ফিরে গেলাম। টিনের চালে পানি যখন এভাবে নেমে আসতো আমরা মুখে হাতে মেখে নিতাম। আর তুতোতো ভাইবোনদের ভিজিয়ে দিতাম। কতক্ষণ খেলতাম জানি না। বড়দের বকাতে সম্বিৎ ফিরে আসতো।
আজও বৃষ্টিতে পাহাড় আর নদীর মিলনে আমাদের রঙিন স্মৃতিপথ ঘুরে এলাম। এই রাঙামাটিতে বহুবার এসেছি। যতবারই আসি নানাভাবে আনন্দ নিয়েই ফিরে যাই বারবার। কখনও বিমুখ হইনি।

আনন্দ ভাগাভাগি করতে হয়। বেদনা রাখতে হয় লুকিয়ে। আমার আনন্দের ভাগ নিতে হলে এই তথ্যগুলো জেনে রাখুন। পাহাড়, নদী আর হ্রদের অপূর্ব মিলনমেলা দেখতে ও উপভোগ করতে চাইলে ছুটিতে নিজে বা বন্ধু, পরিবারের সদস্যদের নিয়ে ঘুরে আসুন।।
এখানে দর্শনীয় স্থানগুলোর মধ্যে কাপ্তাই হ্রদ অন্যতম। কর্ণফুলীতে বাঁধ নির্মাণের কারণে সৃষ্টি হয় কাপ্তাই হ্রদ। পানি বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্যই এই বাঁধ নির্মিত হয়।
হোটেলের পাশেই অবস্থিত ঝুলন্ত ব্রিজ। এই ঝুলন্ত ব্রিজ এর নির্মানশৈলির কারণে পর্যটকদের আকর্ষণীয় কেন্দ্র হয়ে আছে। এখান থেকেই শুরু হয় হ্রদে ভ্রমণ। এখানে পর্যটনের বোট ভাড়া পাওয়া যায়। এই বোট নিয়ে শুভলং, টুকটুক, ইকো ভিলেজ, বৌদ্ধ মন্দির, কাপ্তাই শহরসহ নানা জায়গায় যাওয়া যায়।

দেশীয় নৌকা, ইঞ্জিন নৌকা, লঞ্চ, স্পিড বোট ভাড়া করে দিনভর ঘুরে বেড়ানো যায়। এই হ্রদে মাঝখান দিয়ে নৌযান চলে। নৌভ্রমণে মনে তৃপ্তি আসে। কেবল পানি আর ছোট ছোট টিলা। অনেক সময়ে লেকের পানিতেও টিলা আর গাছ দেখা যায়। সে অপূর্ব দৃশ্য।
লেকে ঘুরতে ঘুরতে দেখতে পাবেন ছোট ছোট টিলা। এইরকম কয়েকটি টিলার দেখা মিলবে যেখানে অপেক্ষা করছে খাবার। চা, কফি, কচি বাঁশের তরকারি, বাঁশের ভিতরে মাছ অথবা মাংসের ঝাল ফ্রাই।
চারিদিকে পানিবেষ্টিত দ্বীপে রয়েছে একটি ইকো রিসোর্ট। এই দ্বীপে একধরনের শান্তি পাওয়া যায়। গাছ, আর নানারঙের পাহাড়ি ফুলের মাঝে সারাটাদিন বসে কাটিয়ে দেয়া যায় কোন সুন্দর কল্পনাতে। এখানে থাকারও ব্যবস্থা রয়েছে। এখানে পথ চলতে থামিপরা আদিবাসী নারীদের নিষ্কলুষ মুখশ্রী দেখে দেখে নিজেকে বড় বেমানান মনে আমার।
লেকে দীর্ঘ ভ্রমণে ক্লান্ত-পরিশ্রান্ত অতিথির জন্য রয়েছে বেশ কয়েকটি উপজাতীয় রেস্তোরাঁয় রকমারি খাবারের স্বাদ। কাঠ এবং বাঁশের কারুকাজে তৈরি এসব রেস্তোরাঁয় দেশীয় ও পাহাড়ি মজাদার সব খাবার-দাবার পাওয়া যাবে। ৫০ একর জায়গা জুড়ে বহু টিলা-উপটিলায় পুরো ইকো ভিলেজটিতে সুদৃশ্য বেশ কয়েকটি কাঠের কটেজ রয়েছে রাত্রিযাপনের জন্যে।
সুভলং ঝরনা রাঙামাটির অন্যতম দর্শনীয় স্থান। চমৎকার একটি জলপ্রপাত এই স্থানের সৌন্দর্যে দ্বিগুণ করেছে। বর্ষাকালে এই ঝরনা রূপে নবযৌবনা। নৌকায় বসেও এই ঝরনার দিকে অপলক চেয়ে থাকা যায়। খুব সাজানো গোছানো এই জায়গা।
বোটে করে সুভলং যাওয়ার আনন্দটাই অন্যরকম। বর্তমানে ঝর্নায় পানি খুব বেশি নেই তবে ভরা বর্ষা মৌসুমে মূল ঝর্নার জলধারা প্রায় ৩০০ ফুট উঁচু থেকে নিচে আছড়ে পড়ে এবং অপূর্ব সুরের মূর্ছনায় পর্যটকদের মুগ্ধ করে।
বর্তমানে এ এলাকায় উপজেলা প্রশাসন কর্তৃক কিছু স্থাপনা নির্মাণ করা হয়েছে। এখানে ঝর্নাস্নানও সারতে পারেন। এরপরেই সুভলং বাজার। হ্রদের তীরে অবস্তিত স্থানীয় এই বাজারে রয়েছে সেনা ক্যাম্প।

এখানে সেনাবাহিনীর একটি ক্যান্টিনও রয়েছে। চাইলে সেখানে সেরে নিতে পারেন চা-নাস্তা পর্ব।
এখানকার খাবার খুব সুস্বাদু। হ্রদের মাছ আর মাছের ঝোল দিয়ে দুপুরের খাবারটা সেড়ে নিতে পারবেন।
রাতের রাঙামাটির দৃশ্য মনভোলানো। বানরের ভয়ে বারান্দায় রাতে তেমন একটা বসতে পারিনি। শব্দ পেলেই রুমে ছুটে এসেছি।
জানালার ফাঁক গলে দূর পাহাড়ের ঢালে হ্রদের পানিতে চাঁদের প্রতিচ্ছবি অসাধারণ দেখাচ্ছে। রাতগভীরে বন-বনানী থেকে ভেসে আসা ঝিঁঝি পোকা, নাম জানা-অজানা পশু-পাখির বিচিত্র ডাকে অজানা রাজ্য এসে সামনে দাঁড়ায়। অজান্তেই অজানা কারো জন্য মন কেঁদে ওঠে। চোখ ছলছল। কেউ কারো দিকে তাকাচ্ছি না।

দুজনেই গুনগুনিয়ে সুর তুলেছি-
“দূরে কোথায় দূরে দূরে
আমার মন বেড়ায় গো ঘুরে ঘুরে।
যে বাঁশিতে বাতাস কাঁদে সেই বাঁশিটির সুরে সুরে।
যে পথ সকল দেশ পারায়ে, উদাস হয়ে যায় হারায়ে
সে পথ বেয়ে কাঙাল পরান যেতে চায় কোন অচিনপুরে।”

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট