চট্টগ্রাম শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

বকুল ফুল

রুমানা নাওয়ার

১৩ সেপ্টেম্বর, ২০১৯ | ১:২২ পূর্বাহ্ণ

দিনের বেলায়ও অন্ধকার এ কেমন ঘর নিলা তুমি?

আকাশ দেখা যায় না জোছনার আলো পড়ে না জানালায়। রোদের ঝলকানিও নেই ঘরের কোথ্থাও। আমি কিভাবে থাকবো এ ঘরে তুমিই কও? আমারে গ্রামেই রাইখা আস।
জামিল একগাদা পুরনো পেপার নিয়ে তখন নিচ থেকে ঘরে ফিরলো। বকুলের কথার উত্তরে বললো-
প্র্যাকটিকাল হও বউ। এসবে পেট ভরবে না। আমার যা আয় এর থেকে ভালো বাসা নেয়ার সাধ হলেও সাধ্য আমার নেই। এ দু’কামরার ঘরেই চলে যাচ্ছে আট হাজার টাকা। আর তুমি রোদ বৃষ্টি আকাশ খোঁজ- হু।
এ বলে জামিল পুরনো কাগজগুলো আলমারির তাকে তাকে বিছিয়ে দিতে লাগলো। বকুলকে ডেকে বললো- কাপড়চোপড়গুলো আগায় দাও বউ। গুছায় রাখি।

বকুল আনমনা হয়ে এগিয়ে দিতে লাগলো সব কাপড়।

নতুন সংসার তাদের। বিয়ে হলো মাত্র এক মাস। জামিল আগে বন্ধুদের সাথে মেসে থাকত। বিয়ের পর এ দু’ কামরার ঘরটা ভাড়া নিলো। জামিল চেয়েছিল বউ মা-বাবার সাথে গ্রামে থাকুক। খরচাপাতির ব্যাপার-স্যাপার আছে। দুদিকে চালাতে গেলে হিমশিম খেতে হবে। তাছাড়া মার কাছে থাকলে মার থেকে শিখবে আর সেবা-যত্ন পাবে মা-বাবা ছেলে বউ থেকে।
জামিলের সব যুক্তি চিন্তা অমূলক করে মা বললো- বউকে তোমার কাছেই রাখো জামিল। আর কতোদিন মেসের খাবার খাবা। শরীরটাতো শেষ করে ফেললা। গাধার খাটুনি খেটে খেটে। বউ এখানে থাকলে তোমার দেখভাল কে করবে। বিয়ের পর স্বামী-স্ত্রীর একসাথে থাকাই ভালো। দূরে থাকলে মহব্বত জন্মায় না দু’জনের মাঝে।
জামিল মা’র কথায় শহরে নিয়ে আসলো বকুলকে। গ্রামে বেড়ে ওঠা বকুল। সহজ-সরল প্রকৃতির মতো। শহরের যান্ত্রিকতায় দমবন্ধ হয়ে আসে কিছুদিন যেতে না যেতেই। ঘরের ভিতর বসে থাকা ছাড়া আর কিইবা আছে এখানে। বৌয়ের মন বসার জন্য স্যাটেলাইট সংযোগও দিলো বাসায়। কিন্তু না ওসবে মন ভরে না বকুলের।

এ কেমন শহর গো তোমার। আজব আজব লাগে আমার। পাখির ডাক নাই নদীর কলকলানি নাই। শিশির ঝরার শব্দ নাই। চাঁদনী রাইতের উৎসব নাই। অবারিত আকাশ নাই। শুধু দালান আর দালান। খালি মানুষের ছুটে চলা। কেউ কাউরে সময় দেয় না। খোঁজ নেয় না। দরজা জানালা বন্ধ রাখার সংস্কৃতি এখানে।

জামিল মাঝে দু’একবার বকুলকে নিয়ে বাইরে গেলো। পাহাড় বনের কাছাকাছি। যদি মেয়েটার মনটা শান্ত হয় এ আশায়। যতক্ষণ ওখানে ছিলো কি উচ্ছল ছিলো বকুল। যখনি ঘরে ফিরলো আবার মনমরা ভাব। জামিল থাকলে একটু কথা বলার মানুষ পাওয়া যায়। ও কাজে চলে গেলে আবার একা একা দিন-যাপন বকুলের। পাশের বাসার ভাবিটা আসে। গল্প জমাতে চায় বকুলের সাথে। পরনিন্দা পরচর্চা ছাড়া আর কোন গল্পই নেই উনার কাছে। কার বাসায় কে আসলো কার বউয়ের সাথে কার পরকিয়া চলছে এসবে সমান আগ্রহ লিলি ভাবির। জামাইটা একটু গোবেচারা টাইপ হওয়াতে জামাইতেও উনার মন নেই বুঝিয়ে দেয় কথায় কথায়। বিয়ের আগের প্রেমকে তাই জিইয়ে রেখেছে এখনো। এখানে ওখানে দেখা করে নাকি নানান ছুতোয়। বাসায় ও আসে পুরনো প্রেমিক জামাইয়ের অবর্তমানে। শুনে বকুলের চোখ কপালে উঠলো মুখ হাঁ হয়ে গেলো।
মনে মনে ভাবলো এসব কি কথা। বাপের জন্মে ও শুনেনি এসব।

লিলি ভাবি বকুলের মনোভাবনা বুঝতে পারলো। তারপর বকুলের থুতনিটা টেনে বললো- বকুল ফুল তুমি তো নতুন আসলা গো শহরে। তাই কেমন কেমন লাগছে শুনতে। কয়টা দিন যাক তুমিও অভ্যস্ত হবা এসবে। তোমার মতো আমারও ভালো লাগতো না এ শহর, শহরের মানুষজন। আর এখন গ্রামেও যাওয়া হয় না। যেতে মন চায় না।
বিবাহিত জীবনের দশ বছরে একটা সন্তানও দিতে পারলো না তোমার ভাই। অনেক ডাক্তার কবিরাজ দেখালাম। সবার এক কথা সমস্যা ওর। সন্তান জন্ম দিতে অক্ষম। শারীরিকভাবে অক্ষম একটা লোকের সাথে আমি ঘর করতাছি। সমাজ সংসারের ভয়ে। বাবা-মার মান না যাওয়ার ভয়ে। এ বলো হু হু করে কাঁদতে লাগলো প্রাণোচ্ছল লিলি ভাবি।
বকুলের মনটা ভার হয়ে গেলো মুহূর্তেই। কি আজব শহর এটা। মানুষজনগুলোর কি আজব দুঃখ। এত কষ্ট বুকে নিয়ে ওরা হাসে কথা বলে সঙ সাজে। লিলি ভাবিকে কি বলে সান্ত¡না দেবে বুঝতে পারলো না বকুল। তবে খুব ইচ্ছে করলো তার একটা হাত ধরে একটু কাঁদতে। পারলো না বকুল। বুকের পাড়ে চোখের ভিতরে শুধু কান্নারা উথলায়। এ চরম দুঃখী মেয়েটার জন্য বকুলের অনেক কিছু করতে ইচ্ছে করলো।
তার পুরনো প্রেমিকের সাথে বিয়ে দিতে ইচ্ছে করলো। একটা ফুটফুটে বাচ্চা আসুক তারপর ওদের সংসারে। হাসি উচ্ছ্বাসে কাটুক লিলি ভাবির বাকি জীবন। যা পায়নি তা পাওয়া হোক তার অনাগত জীবনটায়। আহা যা ভাবা, তা যদি হতো তাহলে দুঃখবোধ কষ্টবোধ থাকত না কারো। সারারাত একফোঁটা ঘুমুতে পারলো না বকুল। জামিলকে বলবে কি বলবে না ভাবতে ভাবতে বলেই ফেললো শেষতক-

জানো লিলি ভাবীর না অনেক দুঃখ। ভাইটা নাকি আনফিট শারীরিকভাবে। একটা বাচ্চার জন্য কিভাবে কাঁদলো আজকে। আচ্ছা আল্লাহ এত কষ্টে কেন রাখে বলোতো আমাদের?
জামিল বললো- আল্লাহ কষ্ট যেমন দেয় সুখ ও দেয় তার সৃষ্টিকে। আমরা তা বুঝি না। শোকরানা আদায় করি না বলেই বিপদে পড়ি। লিলি ভাবিকে বলো তাঁর উপর ভরসা রাখতে তাঁকে ডাকতে। তিনিই উত্তরণের পথ বাতলে দেবেন। এটা বলে বকুলকে বুকে টেনে নিলো জামিল। বকুলও পরম নিশ্চিন্তে মুখ লুকালো জামিলের বুকে।

আকাশ দেখে দেখে সময় পার করতে পারে বকুল। নীলাকাশ তার ভীষণ ভালো লাগে। নীলের মাঝে সাদা মেঘের লুটোপুটি আহা কত্ত সুন্দর। বাড়ির পুকুর পাড়টায় বসে দখিনা হাওয়ায় খোলা বিলের ওপারের আকাশটার জন্য বকুলের মন কাঁদে এই ভরদুপুরে। সাদা মেঘেদের জন্য বকুল উতলা হয়। কচিধান ক্ষেতের উপর দিয়ে বয়ে যাওয়া বাতাসের পরশ বকুলকে আকুল করে। কোথায় পায় এসব এ পোড়া শহরে। দুপুরটায় ঘুঘু পাখিদের ডাক কি মনোহর তা কিভাবে বুঝবে এ শহর-শহরের মানুষজন। রোদের তেজ কমতে কমতে কি মায়াবী রূপে পৌঁছায় বিকেলটা । এরা কি তা জানে?
সকালে পাখির ডাকে ঘুম ভাঙার যে সুখ এখানে তা কই পায় বকুল? রোদ আর ছায়ায় যে লুকোচুরি গাছের পাতায় পাতায় তা পায় না খুঁজে কোথাও। উঠোনের কোণায় লাউয়ের মাচাটায় টুনটুনির বাসাটায় উঁকি না দিলে ভাত হজম হতো না যে বকুলের। সে এখন টুনটুনি টার জন্য কাঁদে ঘুমের ঘোরে।

জামিল বুঝে বকুলের কষ্ট। কিন্তু কি করবে। কিছুই করার নেই তার। ও মনেপ্রাণে চাচ্ছে এ জীবনে অভ্যস্ত হয়ে যাক তার বকুল। শহরের অন্যসব মানুষের মতো। পাষাণে বুক বাঁধুক। কিন্তু না দিনদিন কেমন হয়ে যেতে লাগলো তার বকুল ফুলটা। খিলখিল করে হাসে না। কথা বলে না অকারণে। কোন চাওয়া পাওয়া নেই জামিলের কাছে তার। জামিল বউকে খুশি করতে এটা ওটা নিয়ে আসে সাধ্য মতোন। তাতেও মন ভরে না মেয়েটার। খায়ও না ঠিক মতো। কেমন উদাস উদাস ভাব।
শেষমেশ ডাক্তার দেখালো বকুলকে। বড়ো কোন সমস্যা হলো কিনা আবার। ডাক্তার বকুলকে দেখলো কথা বললো। শরীরের এ কন্ডিশন কেন জানতে চাইলো জামিলের কাছে- কি জামিল সাহেব বউকে খেতে দেন না নাকি। সুন্দরী বউ আপনার। কিন্তু চেহারা স্বাস্থ্যেতো এ সময় আলোর বিচ্ছুরণ হওয়ার কথা। তা না হয়ে উল্টোটি হচ্ছে। ডাক্তার বকুলের সমস্যা কোথায় বুঝতে পারলো শেষতক। তারপর জামিলকে ডেকে বললো-

জামিল সাহেব বকুল তো গ্রামবাংলার প্রকৃতি। সুরেলা মেঠো পথের সুর। পাখিদের সাথে ডানা মেলে উড়ার সাধ ওর। পুকুরের জলে উদ্দাম সাঁতার কাটা মেয়েটাকে আপনি অর্গল দিলেন শহরের চারদেয়ালের ঝর্নাতলে। ওর আকাশটা কেড়ে নিলেন। কেড়ে নিলেন বৃষ্টির মাতাল সুর। রোদের প্রার্থনায় এখন তার দিনাতিপাত। রোদতো পায়ই না বকুল। পাওয়া হয় তার ঘুটঘুটে অন্ধকার। বনের পাখিটাকে খাঁচায় পোষ মানাবেন কিভাবে জামিল সাহেব। ওর চোখের দিকে তাকান দেখবেন সেখানে আমাদের গ্রামবাংলার জলাধার, মাঠের পরে মাঠ, আকাশ আর মাটির মিতালী। ওকে আপনার মার কাছে রেখে আসুন। বকুলকে ওর জায়গায় মানায়। ফুলকে যেমন গাছ থেকে ছিঁড়লে শুকিয়ে যায় তেমনই। বকুলতো আমাদের এক বুনো গ্রামীণ ফুল।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট