চট্টগ্রাম শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

জাপানি অধ্যাপকের নিবন্ধ

সোভিয়েত ইউনিয়নের মতো তিন কারণে যুক্তরাষ্ট্রে ধস নামতে পারে

পূর্বকোণ ডেস্ক

১৯ জানুয়ারি, ২০২১ | ১১:৪২ পূর্বাহ্ণ

গত বছরের শেষের দিকে জাপানের নাগোয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক রাজনীতির এক অধ্যাপকের লিখিত একটি নিবন্ধ বেশ সাড়া ফেলে দিয়েছিল বিশ্বজুড়ে। স্থানীয় একটি জার্নালে লিখিত সেই নিবন্ধটি লেখা হয়েছিল ‘মার্কিন গণতান্ত্রিক ভিত্তি’র অসাড়তা নিয়ে। নিবন্ধে বলা হয়েছিল, মার্কিন সমাজব্যবস্থার তিনটি ‘বৈপরিত্য’ অচিরেই কাটিয়ে উঠতে না পারলে, কিংবা সেগুলো সহসা ‘সহনশীলতা’য় রূপান্তরিত করা না গেলে আগামী ১০ বছরের মধ্যে, দেশটি হঠাৎ করেই বিভক্ত হয়ে পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে!

নিবন্ধটিতে বলা হয়েছে ‘মার্কিন দারুণ শক্তিশালী’ গণতন্ত্রের অভ্যন্তরে সেইসব ‘বৈপরিত্য’ এমনভাবে গেঁথে আছে যে, দেখে মনে হয়- প্রাক্তন সোভিয়েত ইউনিয়নের মতোই এটি শেষ পর্যন্ত একটি ‘অপরিবর্তনীয় বিভক্তি’র দিকেই ধাবিত হচ্ছে।

নিবন্ধে সেই ৩টি বৈপরিত্য চিহ্নিত হয়েছে এভাবে- ১. গভীর-শিকড়ে প্রোথিত বর্ণগত বৈষম্য, যার কারণে বর্ণগত দ্বন্দ্ব প্রায়শই দৃশ্যমান হয়; ২. আমেরিকান গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার অভ্যন্তরীণ ‘প্রাণশক্তি’ ক্রমশ যেন নিঃশেষ হয়ে আসছে; ৩. স্বাধীনতার পক্ষে জনগণের ক্রমবর্ধমান দাবি এবং বাস্তবতা ও সামর্থ্যরে মধ্যে দ্বন্দ্ব। এখন পর্যন্ত যে অবস্থা দেখা যাচ্ছে তাতে মনে হয়, এই তিনটি দ্বন্দ্ব আমেরিকান সমাজব্যবস্থায় অনিরাময়যোগ্য দীর্ঘস্থায়ী রোগে পরিণত হয়েছে। বিশেষত, জাতিগত বৈপরীত্য এবং জাতিগত বিভাজন আমেরিকান গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে প্রশ্নের মুখে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। গত ৪ বছরে অমন ভুরি ভুরি নজির আমরা দেখেছি। এর সর্বশেষ উদাহরণটি বিশ্ব দেখেছে গত ৬ জানুয়ারি।

মিনেসোটার ‘ফ্লয়েড কা-’ কিংবা উইসকনসিনের ‘কেনোশা- কা-’র মতো একের পর এক ঘটনায় দেশটি জুড়ে দাঙ্গা-বিক্ষোভ-সহিংসতা ছড়িয়ে পড়েছিল। যার রেশ এখনো রয়ে গিয়েছে। গেল নির্বাচনেও তার প্রকট প্রভাব দেখা গেছে।

এখন প্রশ্ন একটা করাই যায়- আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের কী হল? মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে বহুবার জাতিগত দাঙ্গা হয়েছে, তবে পার্থক্যটি হল অতীতে সেসব বেশিরভাগই ঘটত কৃষ্ণকায় মানুষদের বসতিগুলিতে। এখন, নতুন নতুন মিডিয়া, মোবাইল ফোন ইত্যাদির মাধ্যমে জনসাধারণের আবেগকে সহজেই নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে। ফলে দ্রুত সামাজিক সংহতি যেমন রক্ষা করা যাচ্ছে তেমনি, দেশজুড়ে তাৎক্ষণিকভাবে উগ্রবাদিতাও ছড়িয়ে দেয়া যাচ্ছে। উগ্র শ্বেত গোষ্ঠীগুলি তাৎক্ষণিকভাবে তাদের গণ্ডগোল পাকাতে পেরেছে। এরই সহায়তায় সশস্ত্র মিলিশিয়াগুলি রাস্তায় অটোমেটিক রাইফেল দুলিয়েছে।

দেখা গেছে পুলিশও সামাজিক শৃঙ্খলা বজায় রাখার নাম করে মাঝে মাঝেই এদের সহায়তা দিয়েছে। ফলস্বরূপ, তীব্র জাতিগত দাঙ্গা, উগ্র সাদা সশস্ত্র মিলিশিয়ারা আরও অহঙ্কারী হয়ে উঠেছিল। এবং এসবেই ইন্ধন জুগিয়েছে রাষ্ট্রপতি ট্রাম্প’র অবিবেচনাপ্রসুত ‘টুইট’গুলো। তাহলে কী বলা যাবে এসব কেবলি কিছু বিচ্ছিন্ন ঘটনা, নাকি আমেরিকার কাঠামোগত অবক্ষয়ের লক্ষণ?

২০১২ সালে, যুক্তরাষ্ট্রের ব্রুকিংস ইনস্টিটিউশনের একটি সমীক্ষা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জনসংখ্যার জাতিগত অনুপাতের পরিবর্তন নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিল। তাতে দেখা গেছে, ১৯৮০ সালে, সাদা আমেরিকানরা জনসংখ্যার ৬৯.৬% ছিল, এবং বাকীরা মূলত লাতিনো, এশিয়ান এবং অন্যান্য নন-হোয়াইট কৃষ্ণাঙ্গ ছিল।

২০১৮ সালের চিত্রে দেখা যায়, সাদারা জনসংখ্যার ৬০.৪% এবং নন-হোয়াইটরা হয়ে যায় প্রায় ৪০%। অর্থাৎ প্রায় ৪০ বছরে, সাদাদের জনসংখ্যা ২০ শতাংশ কমে গেছে। ১৯৮০ সালে, ১৫ বছর বয়সের নিচের জনসংখ্যার হিসাবে, সাদাদের সংখ্যা ছিল ৭৩%, তবে ২০১৮ সালে, সেই সাদাদের সংখ্যা অর্ধেকেরও কমে নেমে এসেছিল (মাত্র ৪৯.৯%)।

এই প্রবণতা অনুসারে, আগামী ২০ বছরের মধ্যে, সাদা জনসংখ্যা জাতীয় জনসংখ্যার অর্ধেকেরও কম হবে, এবং ৩০ বছরের কম বয়সী শ্বেতাঙ্গরা একটি সুস্পষ্ট সংখ্যালঘুতে পরিণত হবে।

জনসংখ্যার কাঠামোর এই পরিমাণগত পরিবর্তন আমেরিকান রাজনীতিতে মূল পরিবর্তন ঘটাবে। এক্ষেত্রে দুটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় রয়েছে: একটি হল ফেডারেল থেকে স্থানীয় স্তরে আরও বেশি করে নন-হোয়াইটরা নিয়ন্ত্রণ করবে। আর দ্বিতীয়টি হল নন-হোয়াইটরা আইন প্রণয়নের মাধ্যমে অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রগুলিকেও নিজেদেও নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নেবে।

বলাবাহুল্য রাজনৈতিক শক্তি এবং সামাজিক ও অর্থনৈতিক সম্পদের এই মৌলিক পরিবর্তন সামাজিক বিভাজনকে আরও বাড়িয়ে তুলবে এবং দুর্ভোগ বয়ে নিয়ে আসবে। যেমনটি হয়েছে ট্রাম্পের উত্থান’র সাথে সাথে সাদা উগ্রবাদী দলগুলির। এবং এর ফলাফল কী হতে পারে তা দেশটির সাম্প্রতিক পরিস্থিতি আমাদের বুঝিয়ে দিয়েছে।

তবে একটা ব্যাপার গত ৪ বছরে পরিষ্কার হয়ে গেছে- যুক্তরাষ্ট্র তার ‘প্রতাপ’ অনেকটাই হারিয়ে বসেছে। করোনা মহামারির এই বিশ্বময়তায় সেটা আরো বেশি স্পষ্ট হয়েছে। এক্ষেত্রে দেশটির অবস্থা বর্তমানে সবচেয়ে নাজুক। দেশটির দোর্দ-প্রতাপ ভাবমূর্তি এই একটি ক্ষেত্রে একেবারে তলানিতে এসে ঠেকেছে। সেই সাথে বিদায়ী প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ‘কুশাসন’ দেশকে দারুণ এক বিভক্তিরেখার ওপর দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। তার রেকর্ড সংখ্যার ভোটপ্রাপ্তি জাতিকে দাঁড় করিয়েছে প্রায় মুখোমুখি অবস্থানে।

এ পরিবর্তন কালো আমেরিকান ইতিহাসের ঐতিহাসিক ছায়া (সাদাদের দ্বারা কলোদের প্রতি দাসত্ব, নিপীড়ন এবং বৈষম্য) যুক্তরাষ্ট্রের ভবিষ্যতকে বিদ্বেষ, ঘৃণা ও রক্তেরঞ্জিত করে তুললে তা মোটেও অবাক করা কিছু হবেনা। এ মুহূর্তের বিশ্বে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বের সর্বাধিক পারমাণবিক অস্ত্র-সমৃদ্ধ দেশ। তাই বলা যায়, এ সময়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিভক্তি পূর্বের সোভিয়েত ইউনিয়নের চেয়ে অনেক বেশি গুরুতর হবে- যেটা হতে পারে মানবজাতির জন্য অকল্পনীয় বিপর্যয়স্বরূপ।

অবস্থা যদি ঠিক এভাবেই এগোয়, তবে বলতে দ্বিধা নেই ত্রিশ বছর আগেকার ‘স্বপ্নের দেশ’টিতে অভিবাসনের হাল আজকের ঠিক বিপরীত হবে। বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনা করে এখনি বলা যায়, আগামী ২০ বছরে, অভিবাসন-পথটি বিপরীতমুখী হবে এবং অনেক আমেরিকান অন্য দেশে চলে যেতে চাইবে।

তবে ‘আসছে ১০ বছরের মধ্যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পতন হবে’- এমনটি এ মুহূর্তে কারোরই ঠিক বিশ্বাস হবেনা, যেমনটি সোভিয়েত ইউনিয়নের ভাঙ্গনও মানুষের প্রত্যাশার বাইরেই ছিল। তবে ইতিহাস এরকমই, সবসময়ই অনিশ্চয়তায় পরিপূর্ণ! আপনি, আমি কখনই জানবো না আগামীকাল কী হতে চলেছে।

সুতরাং, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পতন কিংবা এর যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় ধস নামবেনা- তা কেউই হলফ করে বলতে পারবেনা। কেননা মানুষই পরিচালনা করে রাষ্ট্র ও রাষ্ট্রীয়ব্যবস্থা। আর এই ‘পরিচালনা’য় নিরন্তর ঘটে যাওয়া ‘ভুল-ভ্রান্তি’র মাশুলতো না গুনে উপায় নেই!

সাধারণের মতে, এ রাষ্ট্রটি প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পরে গত ২০০ বছর ধরে এটি বিশ্বের জন্য তেমন ভাল কিছু করতে পারেনি বা করেনি। যে জাতিটি বরাবর অন্য জাতির উপর নিজের ইচ্ছাকে চাপিয়ে দিতে পছন্দ করেছে; এমন জাতি যে অন্য জাতিকে ধ্বংস করতে প্রতিনিয়তই চেষ্টা করে গেছে; এমন রাজনৈতিক সত্তা যা সর্বত্র বিস্তৃত, সর্বগ্রাসী কিংবা অন্যের ওপর আধিপত্য বিস্তারে সদা সচেষ্ট থেকে সবসময় তার শক্তি জাহির করে যায়- একসময় তারও ‘ক্লান্তির দিন’ আসে।

সম্ভবত এটিই ইতিহাসের নিয়ম! ইতিহাস, বাস্তবতা বা যুক্তি যা-ই হোক না কেন, আক্ষরিক অর্থেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার ‘পরিণতি’র দিকে এগিয়ে চলেছে বলেই মনে করা হচ্ছে। তবে নতুন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন’র ‘ঐকমত্যে’র সরকার সেটা কতটা ঠেকাতে সক্ষম হবে, কিংবা এই ‘গতিপথ’ কতটা বদলাতে সক্ষম হবেন সেটাই এখন দেখার।

[জাপানের নাগোয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যকাডেমিক জার্নাল-এ (Izq View the World) ৫ সেপ্টেম্বর ২০২০-এ প্রকাশিত নিবন্ধের সহায়তায়]

পূর্বকোণ/পি-আরপি

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট