চট্টগ্রাম শনিবার, ২৭ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

ভুলে যাওয়া রোগের প্রাদুর্ভাব বেশি নারীদের মধ্যে

অনলাইন ডেস্ক

৬ সেপ্টেম্বর, ২০২২ | ১২:০৫ পূর্বাহ্ণ

অ্যালঝেইমার মূলত একটি মস্তিষ্কের বিশেষ ধরনের রোগ। আক্রান্ত রোগীরা সবকিছু ভুলে যেতে থাকেন। সাধারণত বয়স্করা এ রোগের শিকার হন। আক্রান্তরা প্রথমে মস্তিষ্কের স্বাভাবিক কার্যক্ষমতা হারাতে থাকেন। রোগটির তীব্রতা ক্রমাগত বেড়ে স্মৃতিশক্তি নষ্ট করে দেয়। চিকিৎসকরা বলছেন, এসব রোগী হঠাৎ কোনো একটা জায়গার নাম ভুলে যাচ্ছেন, কোনো কোনো সময় পরিচিত মানুষ বা নিজের সন্তানের নামও ভুলে যাচ্ছেন। সাধারণভাবে তাদের সঙ্গে কথা বলার সময় বোঝা যায় না যে তারা রোগটিতে আক্রান্ত।

অ্যালঝেইমার হলো ডিমেনশিয়ার একটি ধরন। ডিমেনশিয়া মূলত ভুলে যাওয়া রোগের বিস্তৃত শব্দ। ডিমেনশিয়ায় আক্রান্তদের সিংহভাগই আবার অ্যালঝেইমার ধরনে ভুগে থাকেন। বিশ্বে সরাসরি এ রোগ নিয়ে আক্রান্ত ও মৃত্যুর সমীক্ষা খুব বেশি পাওয়া যায় না। তবে ডিমেনশিয়া নিয়ে বিভিন্ন তথ্য রয়েছে।

পরিসংখ্যানে দেখা যায়, বর্তমানে সারা বিশ্বে ডিমেনশিয়া রোগীর সংখ্যা প্রায় সাড়ে ৫ কোটি, আগামী ২০৩০ সালে এ সংখ্যা ৮ কোটিরও বেশি হবে। তাছাড়া আগামী ২০৫০ সালে এসব রোগীর সংখ্যা হবে ১৫ কোটিরও অধিক। বিশ্বে ডিমেনশিয়ার কারণে মৃতের সংখ্যা প্রতি বছরই বাড়ছে। ১৯৯০ সালে ডিমেনশিয়ার কারণে মৃতের সংখ্যা ছিল ১০ লাখ। ২৬ বছর পর ২০২৬ সালে এ সংখ্যা বেড়ে দাঁড়াবে ২৪ লাখে।

ডিমেনশিয়া নিয়ে বাংলাদেশে ২০১৯ সালের আগে জাতীয় পর্যায়ে কোনো সমীক্ষা হয়নি। তবে সম্প্রতি জাতীয় নিউরোসায়েন্স হাসপাতাল ও ইনস্টিটিউট (নিনস) এবং আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশ (আইসিডিডিআর,বি) একটি সমীক্ষা চালিয়েছে। এতে দেখা যায়, বর্তমানে ষাটোর্ধ্ব ব্যক্তিদের মধ্যে ডিমেনশিয়ার প্রাদুর্ভাব বা ব্যাপকতা ৮ দশমিক ১ শতাংশ। সংখ্যার বিচারে যা ১১ লাখ। সমীক্ষায় বলা হয়, আগামী ২০৪১ সালে দেশে এসব রোগীর সংখ্যা হবে প্রায় ২৪ লাখ। অর্থাৎ বর্তমান সংখ্যার চেয়েও প্রায় তিন গুণ বেশি। সে গবেষণায় দেখা যায়, পুরুষের তুলনায় নারীদের মধ্যে ডিমেনশিয়ার প্রাদুর্ভাব বেশি। এক্ষেত্রে নারীদের আক্রান্তের হার ১১ দশমিক ৬ শতাংশ আর পুরুষদের আক্রান্তের হার ৪ দশমিক ২ শতাংশ।

দেশের অন্যান্য জেলার তুলনায় উত্তরের জেলাগুলোতে ডিমেনশিয়ার প্রাদুর্ভাব বেশি বলে প্রমাণ পাওয়া গেছে। সমীক্ষায় দেখা যায়, রাজশাহী অঞ্চলে ডিমেনশিয়ার প্রাদুর্ভাব ১৫ দশমিক ৩ শতাংশ আর রংপুর অঞ্চলে এ হার ১৩ দশমিক ১ শতাংশ।

তাদের গবেষণায় আরো জানানো হয়, বয়সের সঙ্গে সঙ্গে ডিমেনশিয়ার প্রাদুর্ভাবও বেড়ে যায়। তবে গ্রাম ও শহর এলাকায় ডিমেনশিয়ার কোনো তারতম্য নেই বলে জানানো হয়েছে। বিবাহিতদের তুলনায় যারা একাকী জীবনযাপন করেন বা যাদের জীবনসঙ্গী নেই, তাদের মধ্যে ডিমেনশিয়া রোগটির প্রাদুর্ভাব বেশি। এছাড়া যারা প্রাথমিক শিক্ষা সম্পন্ন করেছেন তাদের তুলনায় নিরক্ষর বা যারা কখনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যাননি তাদের মধ্যেও এ রোগের প্রাদুর্ভাব বেশি।

নিনস ও আইসিডিডিআর,বির গবেষণায় বলা হয়, ডিমেনশিয়া রোগীদের মধ্যে শতকরা ৯ ভাগ রোগীর জীবনসঙ্গী নেই বা ছিল না। ১৭ ভাগ রোগী ছিল নিরক্ষর। ৪০ ভাগ রোগী প্রাথমিক শিক্ষা সম্পন্ন করতে পেরেছেন।

শুধু নিনসের ডিমেনশিয়া ক্লিনিকের এক সমীক্ষায় দেখা যায়, হাসপাতালে আগত রোগীদের মধ্যে ২৩ দশমিক ৮ ভাগ রোগী ছিল প্রাথমিক পর্যায়ের ডিমেনশিয়া। মাঝারি পর্যায়ের ডিমেনশিয়ায় আক্রান্ত ৩৩ শতাংশ। তবে হাসপাতালটির ডিমেনশিয়া ক্লিনিকে পুরুষের তুলনায় নারী রোগীদের উপস্থিতি কম বলে জানিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। একই সঙ্গে শহরের রোগীর তুলনায় গ্রামের রোগীর উপস্থিতিও কম বলে প্রমাণ পেয়েছে তারা।

অ্যালঝেইমার রোগের প্রকৃত কারণ জানতে পারেননি চিকিৎসাবিজ্ঞানীরা। তবে গবেষণায় দেখা যায়, এটি মস্তিষ্কের ভেতরে বিটা-অ্যামিলয়েডের চাপড়া ও স্নায়ুতন্তু জটের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট রোগ। আর ৫-১০ শতাংশের ক্ষেত্রে বংশগত একটি কারণ রয়েছে। তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে জীবনযাত্রা ও স্বাস্থ্যগত কারণেও হতে পারে বলে মনে করছেন চিকিৎসকরা।

শুরুর দিকে অনেক সময়ই রোগটি শনাক্ত করা যায় না। কারণ অন্যান্য অসুস্থতার ক্ষেত্রেও এ রোগের লক্ষণ দেখা যেতে পারে। রোগটি শুরুর পর ব্যক্তি যাবতীয় কার্যক্রম বা ১০ মিনিট আগের ঘটনাও ভুলে যান। অথবা কিছুক্ষণ আগের কথাবার্তাও ভুলে যান। কিন্তু এসব রোগী ছোটবেলার কোনো আকর্ষণীয় স্মৃতি স্মরণ করতে পারেন।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ডিমেনশিয়া বা অ্যালঝেইমার রোগ নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে সচেতনতার অভাব রয়েছে। অনেকের ধারণা, স্মৃতিশক্তি অবক্ষয় অথবা বোধশক্তির অন্যান্য ক্ষেত্রের অবক্ষয় বয়সের কারণে হয়ে থাকে। তাই চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়ার প্রয়োজন বোধ করেন না। মহিলাদের মধ্যেও আক্রান্তের সংখ্যাও অনেক, যারা বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই উপেক্ষিত।

অ্যালঝেইমার রোগীদের অনেক সময় দেখা যায়, তাদের অন্যান্য রোগও থাকে। এ কারণে সমন্বিতভাবে চিকিৎসা দিতে হয়। যদিও এ ব্যবস্থা সেভাবে গড়ে ওঠেনি দেশে। রোগটির ক্ষেত্রে চিকিৎসকের পেশাদারিরও ঘাটতি রয়েছে। যে রোগের চিকিৎসা দেয়ার কথা নয়, তিনি সে রোগেরও চিকিৎসা দিচ্ছেন। চিকিৎসা ব্যবস্থায় এসব দুর্বলতাগুলো কাটিয়ে উঠতে হবে।

এ রোগে আক্রান্তরা অন্যের ওপর নির্ভরশীল থাকেন। বিপরীতে তাদের যত্ন নেয়ার লোকের মারাত্মক অভাব রয়েছে। পরিবারের সদস্যরা চাকরিজীবী হলে এ সমস্যা আরো প্রকট আকার ধারণ করে। এ চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় দেশে সরকারি বা বেসরকারিভাবে কেয়ার গিভিং ব্যবস্থা চালুর ওপর জোর দিয়েছেন চিকিৎসকরা।

জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ও মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞ ডা. মেখলা সরকার বণিক বার্তাকে বলেন, অ্যালঝেইমার রোগীদের মূল চিকিৎসাই হলো তাদের কেয়ার করা। কারণ ওষুধ বা অন্যান্য পদ্ধতির চেয়ে কেয়ার গিভিং ব্যবস্থাই উত্তম। ওষুধের মাধ্যমে রোগটির উপসর্গ কিছুটা কমানো গেলেও পরিবারের পক্ষ থেকে রোগীদের যথেষ্ট সহযোগিতা করতে হবে।

জাতীয় নিউরোসায়েন্স হাসপাতাল ও ইনস্টিটিউটের নিউরোলজি বিভাগের প্রধান, স্নায়ুরোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. মালিহা হাকিম জানান, প্রথমেই সাধারণ মানুষের মধ্যে সচেতনতা বাড়াতে হবে। ডিমেনশিয়া রোগীদের পরীক্ষা-নিরীক্ষা এবং পর্যায়ক্রমে চিকিৎসা ব্যবস্থার সব পর্যায় সহজলভ্য করা প্রয়োজন। এছাড়া চিকিৎসক ও সব পর্যায়ের স্বাস্থ্যকর্মীদের এ রোগের ওপর প্রশিক্ষণ দিয়ে দক্ষ করে গড়ে তোলা অত্যন্ত জরুরি। তথ্যসূত্র: বণিক বার্তা

 

পূর্বকোণ/সাফা/পারভেজ

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট