চট্টগ্রাম শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪

দক্ষিণ আমেরিকায় রপ্তানি বাণিজ্যের নতুন সম্ভাবনা

নিজস্ব প্রতিবেদক

১৯ অক্টোবর, ২০১৯ | ৬:৫১ অপরাহ্ণ

 

 

দেশের রপ্তানি বাণিজ্যের বাজার পরিবর্তন হতে যাচ্ছে। সরকার বিকল্প বাজারের সন্ধানে জোর দিচ্ছে। তার অংশ হিসেবে দক্ষিণ আমেরিকার দেশ ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা, উরুগুয়ে, প্যারাগুয়েসহ এ অঞ্চলে রপ্তানি বাড়ানোর উদ্যোগ নিচ্ছে। এ উদ্যোগ বাস্তবায়ন হলে আগামীতে বাংলাদেশের রপ্তানি বাণিজ্যের নতুন দ্বার হবে দক্ষিণ আমেরিকা। আশ করা যায় একদিন বাংলাদেশের তৈরি জার্সি পরে ব্রাজিল-আর্জেন্টিনার হয়ে মাঠ কাঁপাবেন মেসি-নেইমাররা।

কিছুদিন আগেও রপ্তানি বাণিজ্যের প্রধান বাজার ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত (ইইউ) দেশগুলো। যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশি পণ্যের জিএসপি (অগ্রাধিকারমূলক বাজার সুবিধা) সুবিধা বাতিল করেছে অনেক আগেই। ইইউ রাষ্ট্রগুলোও জিএসপি সুবিধা বাতিলের হুমকি দিচ্ছে।

বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশির নেতৃত্বে সম্প্রতি ১৫ সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল বাণিজ্য বৃদ্ধির লক্ষ্যে দক্ষিণ আমেরিকার বেশ কয়েকটি দেশ সফর করে। ব্রাজিল-আর্জেন্টিনাসহ এ অঞ্চলে রপ্তানি কীভাবে বাড়ানো যায় এবং রফতানি বাড়াতে প্রধান অন্তরায় উচ্চ শুল্ক কীভাবে কমানো যায় সফরে সেসব বিষয়ে বিস্তর আলোচনা হয়েছে।

বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি এ বিষয়ে সাংবাদিকদের জানান, আমরা জোর প্রচেষ্টা চালাচ্ছি ব্রাজিল-আর্জেন্টিনাসহ দক্ষিণ আমেরিকার দেশগুলোতে রপ্তানি বাড়াতে। এজন্য বাংলাদেশের তৈরি পোশাকের আমদানি শুল্ক ৩৫ শতাংশ থেকে সহনীয় পর্যায়ে কমিয়ে আনলে বা মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি (এফটিএ) স্বাক্ষর করে শুল্কমুক্ত রপ্তানি সুবিধা প্রদান করলে এ অঞ্চলে আমাদের রপ্তানি বৃদ্ধি পাবে।

বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, ব্রাজিল  দক্ষিণ আমেরিকার অন্যতম বড় দেশ । তাছাড়া বিশ্বের নবম বৃহত্তম অর্থনীতির দেশও ব্রাজিল। ক্রয়ক্ষমতা সমতার দিক থেকে দেশটির অবস্থান বিশ্বে এখন অষ্টম, যেখানে ২১ কোটি মানুষের বসবাস। এই দেশে জনগণের মাথাপিছু আয় ৯ হাজার ১৪০ কোটি ডলার। অথচ এ রকম একটি দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্য ব্যবধান ব্যাপক। যেমন বাংলাদেশ ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ব্রাজিল থেকে আমদানি করেছে ১৪৪ কোটি ২১ লাখ ডলারের পণ্য। একই সময়ে ব্রাজিলে ১৭ কোটি ৬৯ লাখ ডলারের পণ্য রপ্তানি করেছে বাংলাদেশ। অর্থাৎ ব্রাজিলে বাংলাদেশ যা রপ্তানি করে, তার চেয়ে আট গুণের বেশি মূল্যের পণ্য আমদানি করে।

দক্ষিণ আমেরিকার আরেক বড় দেশ আর্জেন্টিনা। দেশটির বাজারে বাংলাদেশের তৈরি পোশাকের প্রচুর চাহিদা রয়েছে। তবে উচ্চ আমদানি শুল্ক হারের কারণে বাংলাদেশ আর্জেন্টিনায় প্রত্যাশা মোতাবেক তৈরি পোশাক রপ্তানি করতে পাচ্ছে না। বাংলাদেশ গত অর্থবছরে আর্জেন্টিনা থেকে ৬২২ মিলিয়ন মার্কিন ডলার মূল্যের পণ্য আমদানি করেছে, একই সময়ে মাত্র ১৮ মিলিয়ন মার্কিন ডলার মূল্যের পণ্য রপ্তানি করেছে। ফলে দুদেশের বাণিজ্য ব্যবধান বৃদ্ধি পাচ্ছে। বাংলাদেশ উন্নত ও বিশ্বমানের তৈরি পোশাক স্বল্পমূল্যে বিশ্ব^বাজারে রপ্তানি করছে। বাংলাদেশের তৈরি পোশাক আর্জেন্টিনায় রপ্তানি  করতে তৈরি পোশাক আমদানির ওপর আরোপিত উচ্চ শুল্ক হ্রাস করা একান্ত প্রয়োজন। সেটা করা গেলে দেশটিতে যেমন তৈরি পোশাক রপ্তানি বাড়বে, তেমনি বাণিজ্য ঘাটতিও কমিয়ে আনা সম্ভব হবে।

দক্ষিণ আমেরিকার বাণিজ্য জোট মারকোসারভুক্ত চার দেশ ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা, উরুগুয়ে ও প্যারাগুয়ে। ১৯৯১ সালে প্রতিষ্ঠিত এই জোটে বলিভিয়া, চিলি, কলম্বিয়া, ইকুয়েডর, গায়ানা, পেরু ও সুরিনাম হচ্ছে সহযোগী সদস্য। ব্রাজিল-আর্জেন্টিনার পাশাপাশি এই জোটের অন্য দেশেও বাংলাদেশি পণ্য রপ্তানি বৃদ্ধির বিপুল সম্ভাবনা রয়েছে।

বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ইতঃপূর্বে ট্যারিফ কমিশনকে দিয়ে মারকোসারের সঙ্গে মুক্তবাণিজ্য চুক্তি (এফটিএ) করার বিষয়ে একটি সমীক্ষা করিয়েছে। ট্যারিফ কমিশন বলছে, ভবিষ্যতে বাংলাদেশের সম্ভাব্য বড়  রপ্তানির গন্তব্যস্থল হতে পারে মারকোসারের গুরুত্বপূর্ণ চার দেশ। কারণ দেশগুলোর গড় মাথাপিছু আয় ১০ হাজার ডলারের বেশি। এফটিএ হলে উভয় পক্ষেরই বাণিজ্য বাড়বে, তবে বেশি লাভবান হবে বাংলাদেশ।

দক্ষিণ আমেরিকার বিভিন্ন দেশে গত অর্থবছরে ৪৫ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি প্রায় ১৮ কোটি ডলার হয়েছে ব্রাজিলে। এর মধ্যে ১৬ কোটি ডলারই তৈরি পোশাক। অন্যান্য পণ্যের মধ্যে ওষুধ, চামড়াপণ্য, প্লাস্টিক ও ফার্নিচার রপ্তানি হয় দেশটিতে।
দেশের পোশাক রপ্তানিকারকরাও মানছেন দক্ষিণ আমেরিকার দেশগুলো বাংলাদেশের জন্য সম্ভাবনাময় এক বাজার।

এ বিষয়ে তৈরি পোশাক প্রস্তুত ও রপ্তানিকারক সমিতির সহসভাপতি আরশাদ জামাল দীপু সাংবাদিকদের বলেন, যেকোনো বাজারই আমাদের জন্য সম্ভাবনাময়। তবে দক্ষিণ আমেরিকার দেশ ব্রাজিল, আর্জেন্টিনাসহ এ এলাকার অন্য দেশগুলোতে আমাদের তৈরি পোশাক রপ্তানির ব্যাপক সুযোগ রয়েছে। যদিও দেশগুলোতে উচ্চ শুল্ক বাধা রয়েছে। তবে সে বাধা দূর করার সুযোগও রয়েছে। আমরা যদি ব্রাজিল থেকে গরুর মাংস আমদানি বাড়াই তাহলে হয়তো তারা আমাদের পোশাক শিল্পের জন্য উচ্চ শুল্ক কমাতে পারে। শুল্ক কমালে রপ্তানি বাড়বে, রপ্তানি বাড়লে দেশগুলোর সঙ্গে আমাদের বাণিজ্য ঘাটতিও কমে আসবে।

এদিকে বাণিজ্যমন্ত্রীর গত আগস্ট মাসের সফরে আলোচনা হয় বাংলাদেশ থেকে ব্রাজিল নেবে পোশাক আর ব্রাজিল থেকে বাংলাদেশ আনবে গরুর মাংস। এতে উভয় দেশই লাভবান হবে। এজন্য অবশ্য দু’পক্ষকেই পরস্পরের পণ্যের ওপর শুল্ক হার কমাতে হবে। গরুর মাংস আমদানিতে করভার ৩০ শতাংশের বেশি, যার মধ্যে আমদানি শুল্কই ২৫ শতাংশ। এ ছাড়া অগ্রিম আয়কর ও নিয়ন্ত্রণমূলক কর রয়েছে।
মারকোসারভুক্ত চার দেশের সঙ্গে বাণিজ্য বৃদ্ধি নিয়ে বাংলাদেশ তৈরি পোশাক প্রস্তুতকারক ও রফতানিকারক সমিতি (বিজিএমইএ) ৮ আগস্ট বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে একটি ধারণাপত্র পাঠিয়েছে। এতে উল্লেখ করা হয়, পাঁচ অর্থবছরের ধারাবাহিকতা অনুসরণ করে বিজিএমইএ প্রাক্কলন করেছে চলতি ২০১৯-২০ অর্থবছরে গরুর মাংস আমদানিতে বাংলাদেশের ব্যয় হবে ৪৫ লাখ ৭৭ হাজার ডলার। এর মধ্যে শুল্ক বাদ দিলে এবং ২৫ শতাংশ ব্রাজিল থেকে আমদানি করা হলে সরকারের আয় কমবে ২ লাখ ৮৬ হাজার ডলার। একইভাবে মোট আমদানির ৫০ শতাংশ ব্রাজিল থেকে আনা হলে সরকারের ৫ লাখ ৭২ হাজার ডলার এবং ৭৫ শতাংশ আমদানি করা হলে ৮ লাখ ৫৮ হাজার ডলার আয় কমবে।
পাশাপাশি বাংলাদেশি তৈরি পাশাকে ব্রাজিলে শুল্ক ছাড় পেলে কী হবে, সেটিও প্রাক্কলনও করেছে বিজিএমইএ। এতে দেখা গেছে, ৩৫ শতাংশ শুল্ক দিয়ে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ব্রাজিলে ১৬ কোটি ৫ লাখ ডলারের পোশাক রপ্তানি করেছে বাংলাদেশ। ব্রাজিল শতভাগ শুল্ক কমালে বাংলাদেশের বাঁচবে ৫ কোটি ৬২ লাখ ডলার, ৫ শতাংশ শুল্ক হলে বাঁচবে ৪ কোটি ৮১ লাখ ডলার। যদি বর্তমানের তুলনায় ৫ শতাংশ কমে ৩০ শতাংশ শুল্কও আরোপ হয়, তাতেও বাংলাদেশের সাশ্রয় হবে ৮০ লাখ ডলার।

অন্যদিকে ব্রাজিলে রপ্তানি বৃদ্ধি করতে আগামী ৭-৮ নভেম্বর সাও পাওলোতে বিজিএমইএর উদ্যোগে ব্রাজিলে বাংলাদেশের বাণিজ্য মেলা আয়োজনের কথা রয়েছে। মেলায় বাংলাদেশের তৈরি পোশাকসহ ব্রাজিলে  রপ্তানি সম্ভাবনাময় ওষুধ, পাট, সিরামিক, প্লাস্টিক প্রভৃতি পণ্য প্রদর্শন করা হবে। তবে এ মেলা পেছাতে পারে বলে জানালেন বিজিএমইএ সহসভাপতি আরশাদ জামাল। তিনি বলেন, আগের নির্ধারিত তারিখে ওই মেলা না হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। নানা কারণে এ মেলা পেছানো হচ্ছে ।

পূর্বকোণ-রাশেদ

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট