চট্টগ্রাম শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

শিশুর জন্য সাজানো বাগান এবং আমাদের করণীয়

এস আর রাশেদ

৯ ডিসেম্বর, ২০১৯ | ৩:৩১ পূর্বাহ্ণ

অভি। বয়স মাত্র চার বছর। গা’য় গতরে অনেক বড় হয়েছে। মনে হয় ছয় বছর। তবে ওর মানসিক বিকাশ তিন বছর থেকে চার বছরের মধ্যে রয়ে গেছে। সে ওটা সেটা দিয়ে মিছিমিছি খেলা, দৌড়াদৌড়ি করা, লুকোচুরি খেলা ভালোবাসে। সে গল্প শুনতে মজা পায়। ছবি আঁকতে ভালোবাসে। ঘরের মধ্যে পড়ে থাকা প্যাকেট, দেয়াশলাই এর বক্স দিয়ে বিভিন্ন জিনিস বানায়। অর্থাৎ তার এই বয়সটা

খেলাধুলার বয়স। খেলাধুলার মধ্যে দিয়েই শিশুর মস্তিস্ক বিকশিত হয়, প্রকৃতির প্রতি আগ্রহ সৃষ্টি হয় এবং পড়াশোনার জন্য অতি প্রয়োজনীয় মনোযোগের বিকাশ ঘটে। অভির মা তাকে নিয়ে গ্রামে থাকেন। বাবা বিদেশে। অভির দিন ভালোই কাটছিল। হঠাৎ মায়ের শখ হলো ছেলেকে শিক্ষিত করবেন। জামাইকে চাপ দিয়ে চট্টগ্রাম শহরে বাসা ভাড়া করলেন। অভির বয়স যখন মাত্র তিন বছর আটমাস, তখন ওকে নিয়ে চট্টগ্রাম এলেন। এসেই ওকে স্কুলে ভর্তি করে দিলেন। শিশু বিকাশে নূন্যতম জ্ঞান না থাকায় মা বুঝতে পারলেন না যে অভি দেখতে বড় সড় হলেও সে এখনো ভালো করে কলম ধরতে জানে না। স্কুলে ভর্তি হওয়ার জন্য আরও দুই বছর অপেক্ষা করতে হবে। মা ছাগল দিয়ে হাল চাষ শুরু করলেন। মাত্র চার বছর বয়সী ছেলের উপর স্কুলের পড়াশোনা চাপ পড়ল। মা ওকে পড়াশোনার জন্য মারধর শুরু করলেন। যে চাপ বহন করার জন্য অভি মানসিকভাবে প্রস্তুত নয়, তাকে সেই চাপ দিতে থাকলেন। ফলে চঞ্চল অভির শিশুসুলভ চপলতা থেমে গেল। পড়া লেখার ভীতি ওর মধ্যে ঢুকে গেল। এভাবে অল্প বয়সে শিশুর উপর পড়াশোনার বোঝা চাপিয়ে দিয়ে আমরা অঙ্কুরে তাদের বিকাশ বাধাগ্রস্থ করি।

বিশ্বের সবচেয়ে সেরা এডুকেশনাল সিস্টেমের একটি হচ্ছে ‘ফিনল্যান্ডের এডুকেশনাল সিস্টেম’। সেখানে শিক্ষার্থীরা তাদের ‘বাধ্যতামূলক ছয় বছরের প্রাথমিক শিক্ষা’ শুরু করে সাত বছর বয়স থেকে। তাদের প্রাইমারী শিক্ষা পরীক্ষা মুক্ত। তাদের এডুকেশনাল সিস্টেমে শিক্ষার্থীদের ‘নিউম্যারিক্যালি গ্র্রেডিং’ করা আইনত নিষিদ্ধ। তারা ‘নিউম্যারিক্যাল গ্রেডিং’ এর পরিবর্তে ‘বর্ণনামূলক ধারাবাহিক মূল্যায়ন’ এবং উত্তরণ কল্পে প্রয়োজনীয় ফিডব্যাক দেয়। তারা ‘জানার জন্য, করার জন্য এবং স্বভাবজাত অনুসন্ধিৎসা’ থেকেই শিখে। তারা শিক্ষার্থীদের পরীক্ষায় ভালো করার পরিবর্তে শিখার জন্যই তৈরি করে। তারা

ছাত্র-ছাত্রীদের ভালো পরীক্ষার্থীর পরিবর্তে ভালো শিক্ষার্থী হিসেবে তৈরী করে।

ইউনেস্কো ২০০৬ সালে একটি তথ্যে জানান, এডুকেশন ডেভেলপমেন্ট সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান ১২১ টি দেশের মধ্যে ১০৬ তম। এ থেকে বুঝা যায় ‘মানসম্মত শিক্ষা’ বাংলাদেশের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ। যদিও বা প্রায় ‘শতভাগ শিশু ভর্তির হার’ এবং ‘জেন্ডার সমতা’ আনয়ন আমাদের শিক্ষাক্ষেত্রের বড় অর্জন।

২০০০ সালে ইউনিসেফ ‘মানসম্মত শিক্ষা’র একটি সংজ্ঞা দেন। তারা বলেন পাঁচটি মানসম্মত সূচকের সমন্বয়ে হয় ‘মানসম্মত শিক্ষা’। তা হচ্ছে মানসম্মত শিক্ষাথী, মানসম্মত শিক্ষাবান্ধব পরিবেশ, মানসম্মত শিক্ষাবান্ধব কনটেণ্ট, মানসম্মত শিশুর শিক্ষা (পেডাগজি), জ্ঞানসমৃদ্ধ শিক্ষক, ফলশ্রুতিতে মানসম্মত প্রজন্ম যা শিক্ষার জাতীয় লক্ষ্য তথা সমাজে তার ইতিবাচক অংশগ্রহণ থাকবে।

একজন শিশু শিক্ষার্থীর গল্প, বিশ্বের সেরা এডুকেশনাল সিস্টেম, এডুকেশন ডেভেলপমেন্ট সূচকের আলোকে আমাদের অবস্থান, আমাদের অর্জন এবং ইউনিসেফের মানসম্মত শিক্ষার সংজ্ঞা থেকে আমরা বুঝতে পারি ‘শিশুর জন্য সাজানো বাগান এবং আমাদের কী করণীয়’। এর জন্য প্রয়োজন একটি সমন্বিত প্রচেষ্ঠা, যেখানে সম্পৃক্ত করতে হবে অভিভাবক, শিক্ষক , শিক্ষার্থীর পাশাপাশি স্কুল মালিক, শিক্ষাবিদ এবং শিক্ষা প্রশাসন তথা শিক্ষানীতি যেটা হতে হবে শিশু বিকাশের লেটেস্ট গবেষণার আলোকে। যেখানে আমাদের দেশে ‘হাইজিনের নূন্যতম জ্ঞান না থাকা সত্ত্বেও রেস্তোরা বা খাবার দোকান দেওয়া যায়, নিরাপদ সড়কের জ্ঞান না থাকা সত্ত্বেও রাস্তার গাড়ী চালানো যায়, তেমনি শিশু শিক্ষার নূন্যতম জ্ঞান না থাকা সত্ত্বেও শিক্ষক হওয়া যায় এবং শিশু বিকাশের নূন্যতম জ্ঞান না থাকা সত্ত্বেও স্কুলের মালিক হওয়া যায়’। এই বিষয়ে আমাদের এখন নজর দেওয়ার সময় এসেছে। এইগুলোর অভাবে বর্তমানে আমাদের শিক্ষা-ব্যবস্থায় যে ‘মানসম্মত শিক্ষা’ পরিপন্থী যে অরাজকতা চলছে তার অবসান হওয়া উচিত। বর্তমানে আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় ভর্তি যুদ্ধের নামে যে অমানবিক প্রতিযোগীতা চলছে, কিন্ডার গার্টেন বিদ্যালয়গুলো যেভাবে শিক্ষার্থীর উপর বইয়ের বোঝা, অভিভাবকদের উপর বিরাট অংকের অর্থের বোঝা, অভিভাবকরা যেভাবে তার সন্তানকে প্রতিযোগিতায় প্রথম ও এ প্লাস পাওয়ার জন্য শিশু শিক্ষার্থীদের প্রতিযোগীতার মুখে ঠেলে দিচ্ছে, সেজন্য আমরা অভিভাবক হিসেবে, শিক্ষক হিসেবে, স্কুল মালিক হিসেবে, শিক্ষাবিদ হিসেবেএবং শিক্ষা প্রশাসনের লোক হিসেবে আমরা সবাই আসামী কারণ আমরা শিশুদের জন্য দিতে পারি নাই শিশু বান্ধব অভিভাবক, শিশু বান্ধব শিক্ষক, শিশু বান্ধব স্কুল এবং শিশু বান্ধব শৈশব। যেখানে ফিনল্যান্ডে শিশুদের শিক্ষা জীবন শুরু হয় সাত বছর বয়সে এবং পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত নিউম্যারিক্যাল গ্র্রেডিং দেয়া আইনত নিষিদ্ধ, সেখানে আমাদের দেশে চার বছর বয়স থেকে শিশুদের অবতীর্ণ হতে হয় ভর্তিযুদ্ধে, বইয়ের প্রেশারে এবং পরীক্ষার ভালো করার জন্য অভিভাবক ও শিক্ষক
কর্তৃক প্রেশারে। ফলশ্রুতিতে শিশুর অবস্থা হয় অভির মতো, যেখানে শিশু বয়সে জন্ম নেয় পড়ালেখার প্রতি ভীতি। আমরা শিশুদের দিতে চার আনন্দময় শৈশব, যেখানে শিশু খেলতে খেলতে শিখবে। তাই গানের ভাষায় বলতে চাই, ‘আজ যে শিশু, পৃথিবীর আলোয় এসেছে, আমরা তার তরে একটি সাজানো বাগান চাই’, গানের এই আহবান ছড়িয়ে পড়–ক শিক্ষা সংশ্লিষ্ট সবার মধ্যে এবং শিশুর জন্য রচিত হোক একটি আনন্দময় শৈশব।

সহকারী থানা শিক্ষা অফিসার,
কোতোয়ালী, চট্টগ্রাম

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট