চট্টগ্রাম বুধবার, ২৪ এপ্রিল, ২০২৪

শ্রেণিকক্ষের পরিবেশ-আদব-কায়দা ও শিষ্টাচার

মো. সেলিমুজ্জমান মজুমদার

২১ অক্টোবর, ২০১৯ | ১:২০ পূর্বাহ্ণ

জাতীয় শিক্ষানীতি মোতাবেক শিক্ষক-শিক্ষার্থী যে একটি নির্দিষ্ট স্থানে সংগঠিত হয়ে তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করে তাকে আমরা শ্রেণিকক্ষ বলি আর কোন শিক্ষালয়ের মধ্যে নির্দিষ্ট কক্ষে কিছুসংখ্যক সমবয়সী শিক্ষার্থী নির্দিষ্ট বিষয়ে শেখার জন্য শিক্ষালয়ের শিক্ষকরা নির্দিষ্ট সময়ে যে পাঠ দান করেন তাই শ্রেণি শিক্ষা। শ্রেণিকক্ষ ও শ্রেণিশিক্ষাকে কেন্দ্র করে যে পারিপাশির্^ক অবস্থার দরকার হয় সেটাই শ্রেণিকক্ষের পরিবেশ। একটি শ্রেণি কক্ষে মূলতঃ লেখা-পড়া, বলা-শোনা এ চার শ্রেণির কার্যক্রম পরিচালিত হয়।

শ্রেণিকক্ষ শিক্ষালয়ের প্রাণকেন্দ্র এবং একটি পবিত্রতম স্থান। শ্রেণিকক্ষ একাধারে মানুষ গড়ার কারখানা, সামাজিক ও নৈতিক শিক্ষার মিলনায়তন, শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্র
ন্যায়-অন্যায় পরিমাপের দাঁড়িপাল্লা, আদর্শ ও সম্প্রীতি লেনদেনের মিডিয়া, নেতৃত্ব ও আনুগত্যের সূতিকাগার। একথা স্বীকার করতেই হবে যে, শ্রেণি শিক্ষাই গোটা পৃথিবীর উন্মুক্ত বিশ^বিদ্যালয়। শ্রেণি শিক্ষা লাভের মাধ্যমেই উলামায়ে কিরাম, যুগ¯্রষ্টা, মনিষী, ফকীহ, বিচারক, প্রধানমন্ত্রী, রাষ্ট্রপতি, শিক্ষক, উকিল, ডাক্তার, ইমাম ও পথ প্রদর্শকরা উঠে এসেছেন যাঁরা আমাদের জ্ঞান-বিজ্ঞানের আলোয় সমুদ্ভাসিত করেছেন।

শ্রেণিকক্ষে পাঠদান কার্যক্রম সক্রিয়, স্থায়ী ও অর্থবহ করার জন্য শ্রেণি কক্ষে বৈচিত্র্যময় ও আকর্ষণীয় পরিবেশ অপরিহার্য। শ্রেণিকক্ষেই ব্যবসায় শিক্ষা, মানবিক শিক্ষা ও বিজ্ঞান শিক্ষা দেয়া হয়। কর্তৃপক্ষকে প্রথমেই মনে রাখতে হবে যে, শ্রেণিকক্ষে শিক্ষক যাঁদের শিক্ষা দেবেন তারা আগামী দিনেক নাগরিক যাদের সুন্দর ভবিষ্যত সমৃদ্ধ দেশ গঠন তাদের উপরই নির্ভর করছে আমাদের আগামী কী রকম হবে। এজন্য আরো সতর্ক হওয়া আবশ্যক যে, বিদ্যালয় শ্রেণিকক্ষ নয় বরং বিদ্যালয়ের চেয়েও বেশি কিছু।

শ্রেণিকক্ষে ¯েœহ-মায়া-মমতা, আদর-ভালোবাসা হৃদয় থেকে উৎসারিত না হলে, পেশাগত সীমাবদ্ধতা থাকলে এবং শ্রেণিকক্ষে মেনি লাইব্রেরী, সেমিনার কক্ষের মত সজ্জিত-সৌরভিত না হলে, পাঠ্যপুস্তক-সিলেবাস, ডিকশনারী ছবি, ম্যাপ গ্লোব, মডেল, পত্র-পত্রিকা, ম্যাগাজিন, চার্ট, চকবোর্ড ও চক, হোয়াইট বোর্ড, মার্কার পেন, ওভার হেড, প্রজেক্টর, মাল্টিমিডিয়া সিস্টেম, কম্পিউটার, ছাত্র হাজিরা বই, ডাস্টার্ড, পানীয় জল, সংযুক্ত টয়লেট ও ওয়াশিং রুম, পর্যাপ্ত আলো-বাতাস,
টুল-টেবিল, চেয়ার (শ্রেণি মান ও শিক্ষার্থীর বয়স অনুযায়ী ছোট-বড়, উঁচু-নিচু), পর্দাসহ পরিচ্ছন্ন ও সাউন্ড সিস্টেম সর্পোপুরি স্টেইজ সদৃশ লেকচার টেবিল না থাকলে সেখানে শিখন প্রক্রিয়া বেশি দূর এগুতে পারে না, পাঠদান কার্যক্রম সার্বিকভাবে সফল হতে পারে না। একাধিক দরজা জানালা সম্বলিত কক্ষের উভয়দিক দিয়ে আগমন-প্রস্থানের সুবিধা থাকলে আরো ভালো অর্থাৎ কক্ষের ডান-বাম উভয় পাশের্^ চলাফেরা করার জন্য বারান্দা থাকা চাই। যাতে ছোটখাট কাজে সবাই সহজে চলাফেরা করতে পারে। মাটি-পানি, শব্দ, বায়ু ও আলো দূষিত শ্রেণিকক্ষ শিক্ষার্থীর কাছে কিছুতেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না।
শ্রেণিকক্ষের পরিবেশ ও পাঠদান প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার ব্যবস্থাপনায় ছাত্র-শিক্ষক-অভিভাবক ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ সকলের প্রস্তুতি দরকার। প্রথমতঃ কর্তৃপক্ষের প্রস্তুতি- শিক্ষানীতি প্রণয়ন, কারিকুলাম রচনা, সিলেবাস নির্ধারণ, পাঠ্যপুস্তক রচনা, শিক্ষালয় নির্মাণ এবং প্রতিষ্ঠান পর্যায়ে গভর্নিং বডি গঠন, প্রতিষ্ঠান প্রধান ও সহ প্রধানের শ্রেণি কার্যক্রমের ওপর গভীর ও সুন্দর নজরদারী আর শ্রেণি শিক্ষকের শ্রেণি কক্ষে যাওয়ার প্রস্তুতি, যাওয়ার পর পাঠ শুরু করার প্রস্তুতি। শিক্ষার্থীদেরও শ্রেণিকক্ষে প্রবেশের প্রস্তুতি এবং প্রবেশের পর প্রস্তুতি আর অভিভাবকদের প্রস্তুতিমূলক শিক্ষার্থীর শ্রেণিকক্ষে প্রবেশের পূর্ব প্রস্তুতির সঙ্গে যুক্ত।

সুপ্রিয় পাঠক, আপনারা জেনে সিদ্ধান্ত নিবেন এবং বাস্তবায়নে যে কোন মূল্যে তৎপর হবেন এজন্য যে, সব কর্মকা-ের চূড়ান্ত লক্ষ্য হলো শ্রেণিকক্ষে উন্নত পাঠদান যার কেন্দ্রবিন্দু হচ্ছে শ্রেণিকক্ষ। আধুনিক শিক্ষা ব্যবস্থাপনায় একজন শিক্ষক শ্রেণিকক্ষে প্রবেশের পূর্ব প্রস্তুতি- যে কোন কাজ সুন্দরভাবে সম্পাদন করতে হলে পূর্বেই তা নির্ধারণ করে নিতে হয়। এ ধরনের প্রস্তুতি গ্রহণ করাকে পরিকল্পনা বলে। মনে রাখা উচিত যে, পরিকল্পনাকে পাঠদান কার্যক্রমের ভিত্তি বলা হয়। শিক্ষক শ্রেণি লেকচারের পূর্ব রাতেই তার জন্য বরাদ্দকৃত প্রতি পিরিয়ডকে ৩ ভাগে ভাগ করবেন। প্রথমাংশ উপস্থাপন,
দ্বিতীয়াংশ প্রশ্নোত্তর/শিখন পর্ব এবং শেষাংশ রোলকলসহ মূল্যায়ন পর্ব। দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা থেকে এবার পাঠদান পদ্ধতি, কৌশল ও আদব-কায়দা নিয়ে সামান্য আলোচনা করতে চাই-

একজন শিক্ষক মানুষ এবং তিনি মানুষের বাচ্চা কাচ্চাকে শিখাচ্ছেন। এজন্যে তাকে ৩স’ থিউরি মানতেই হবে। ১। সত্যবাদিতা ২। সদাচরণ ৩। ও সময়ানুবর্তিতা। শ্রেণিকক্ষে প্রবেশের আগেই তিনি পাঠ ও শারীরিক প্রস্তুতি নিবেন। যেমন- শিখন সামগ্রীসহ নিজের চুল-দাড়ি,
রুচিশীল পোশাক-পরিচ্ছদ এবং চিন্তা চেতনাকে পাঠের মধ্যে কেন্দ্রীভূত করা। মনে রাখবেন আপনি শ্রেণিকক্ষ নয়, বরং সেমিনার কক্ষে প্রবেশ করছেন যেখানে আপনি একাই মঞ্চে অভিনয় করবেন এবং আপনাকে উপভোগ করবেন অনেকেই। আপনি দেখবেন দুচোখে আর আপনাকে দেখবে অসংখ্য চোখ। সুতরং এখানে ঝুঁকি,
অনিশ্চয়তা ও চ্যালেঞ্জ বেশি।
ছাত্র-শিক্ষক ও শিক্ষকতার স্বাদ-গন্ধ, রস সব কিছুই এখানে জড়িত। ইউনেসকোর এক গবেষণায় দেখা গেছে যে, ‘শ্রেণিকক্ষে একজন জীবন্ত শিক্ষক সুসজ্জিত শ্রেণিকক্ষ অপেক্ষা উত্তম। তাই শ্রেণিকক্ষে প্রবেশের পূর্ব তাদের অনুমতি নিয়ে প্রবেশ করবেন এবং ঢুকামাত্রই সালাম-আদাব দেবেন এবং
সালামে-আদাবের জবাব দেবেন। শিক্ষার্থীদের মধ্যে যে কোন একজন সালাম-আদাবের জবাব দিলে চলবে। এ পর্বে উক্ত আদবাটি ছাত্র-শিক্ষক উভয়ের জন্য প্রযোজ্য।
শিক্ষক গুণগত মান বলতে লেখাপড়া, বলা-শোনা-কে বুঝিয়ে থাকে। এটার বৈজ্ঞানিক ভিত্তি আছে। যেমন- গবেষণাগার ফল বলছে- একজন মানুষ ৮৩% দেখে, ১১% শুনে, ৩% নাসিকা, ২.৫% জিহ্বা ০.৫% ত্বক দ্বারা শিখে। এ তথ্য এজন্যই উপস্থাপন করলাম, শিক্ষার্থীরা আপনাকে দেখে শিখবে বেশি বলে।
প্রতিটি ক্লাস শুরু করার আগে প্রিয় শিক্ষার্থী, আদবের ছাত্র-ছাত্রী আমার ছেলে-মেয়েরা ইত্যাদি গুণবাচক শব্দ দিয়ে ক্লাস শুরু করবেন এবং দৈনিক সংবাদপত্র, কোন শিক্ষনীয় ঘটনা অথবা দু চারটা ধর্ম ও নৈতিক শিক্ষাসংক্রান্ত নতুবা ছোটখাটো কৌতুক দিয়ে শ্রেণি কার্যক্রম শুরু করা যেতে পারে। শিক্ষার্থীদের ভাল-মন্দ জেনে ক্লাস শুরু করা আরো ভালো। আগেই বলেছি, শিক্ষার্থীরা দেখে শেখে বেশী
অর্থাৎ – ডযবহ ও যবধৎ, ও ভড়ৎমবঃ, যিবহ ও ংবব, ও ৎবসবসনবৎ, যিবহ ও ফড়, ও ঁহফবৎংঃধহফ’- এ প্রবাদটি বহু পুরানো। শিক্ষা বিজ্ঞানীরা শ্রেণি কক্ষে পাঠদানের উদ্দেশ্য ও গুরুত্বকে ৪টি ধাপে দেখিয়েছেন। যেমন- শ্রেণিকক্ষ ব্যবস্থাপনা, আচরণিক ব্যবস্থাপনা পরিবেশগত ব্যবস্থাপনা ও নিদের্শনামূলক ব্যবস্থাপনা। এ ধাপের প্রত্যেকটিতে বেশ কয়েকটি উপধাপ আছে যা ছাত্র-শিক্ষক উভয়ের জন্য দরকার। এখানে আমি উল্লেখযোগ্য কয়েকটি উপস্থাপন করলাম।

শ্রেণিকক্ষ ব্যবস্থাপনা : অনুকূল শিখন পরিবেশ তৈরি শ্রেণি শৃঙ্খলা বজায় রাখা, সকলের প্রতি সমদৃষ্টি আরোপ ইত্যাদি। শ্রেণি কক্ষকে একটি জটিল কমপ্লেক্স বলা হয়। এখানে যোগ্যতা ও মেধানুযায়ী সাধারণ যোগ্যতাসম্পন্ন বিশেষ যোগ্যতা বা সহায়তা প্রাপ্ত অসাধারণ যোগ্যতা সম্পন্ন শিক্ষার্থীর মিশ্রণ দেখা যায়। এছাড়াও থাকে প্রতিবন্ধী, শারীরিক, আবেগ, ধনী-দরিদ্র শ্রেণির শিক্ষার্থী। থাকে পারিবারিক ও সামাজিক ভিন্ন প্রকৃতির ছাত্র-ছাত্রী। অঞ্চল-ধর্ম ও আদর্শগত ভিন্নমতের শিক্ষার্থীতো আছেই।

এজন্যে শিক্ষক শ্রেণিতে প্রবেশ করে আসন বিন্যাস করবেন বন্ধুদের সাথে বসা শিক্ষার্থীদের আসন সরিয়ে দেবেন। শিক্ষার্থীদের সাথে ঊুব-ঈড়হঃধপঃ এর মাধ্যমে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করবেন। দাবার গুটির মত তাদের সাজাবেন। কোমল ও কঠোর স্বরে লেকচার দেবেন। মানুষ নিজের নামকে বেশিী পছন্দ করেন তাই শিক্ষার্থীদের নাম ধরে ডাকবেন, ভয়-ভীতি প্রদর্শন, শিক্ষার বিষয় বস্তু ও পরীক্ষা নিয়ে ভীতিকর তথ্য উপস্থাপন না করা এবং তাদের জন্য সর্বদা হ্যাঁ বলা, শ্রেণির আদব ও শিষ্টাচারের লক্ষণ। (চলবে)

লেখক : শিক্ষাবিদ ও শিক্ষা বিষয়ক কলামিস্ট

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট