চট্টগ্রাম শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

৮০% শিক্ষার্থী বিশ্ববিদ্যালয়ে পছন্দের বিষয়ে পড়তে পারেন না, কেনো?

অনলাইন ডেস্ক

২৭ আগস্ট, ২০১৯ | ২:২৫ অপরাহ্ণ

বাংলাদেশে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল এবং প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে স্নাতক পর্যায়ে ভর্তির কার্যক্রম শুরু হয়েছে। কিছুদিনের মধ্যেই শিক্ষার্থীদের কেউ তাদের পছন্দের বিভাগে পড়াশোনা শুরু করবেন, আবার অনেকেই হয়তো নিজের পছন্দের বিভাগে পড়ার সুযোগ পাবেন না।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিসংখ্যান বিভাগের একজন শিক্ষার্থী জানান, মেধাক্রম অনুযায়ী তালিকায় না আসায় এবং পছন্দের বিভাগে আসন সংখ্যা পূর্ণ হয়ে যাওয়ায় তিনি ওই বিভাগে পড়তে পারেননি। তার বদলে আমি যে বিষয় পেয়েছি সেটা আমার আয়ত্তের বাইরে এবং আগ্রহেরও বাইরে ছিল। ফলে ভর্তি হবার পর প্রথম বছরটি আমার খুব কষ্ট করতে হয়েছে।

বিজ্ঞান অনুষদের আরেক বিভাগের শিক্ষার্থী বলেন, তার ইচ্ছা ছিল চলচ্চিত্র বিষয়ে পড়ার।

‘পরিবারের চাপে আমি সেটা পারি নাই। ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে কোচিং করেছিলাম, কিন্তু পরিবারের শর্ত ছিল ঢাকার বাইরে যাওয়া যাবে না। শেষ পর্যন্ত এখানেই পড়তে বাধ্য হচ্ছি।’

আইন পড়ার লক্ষ্যে ভর্তি পরীক্ষা দিয়ে মেধাক্রমে নিচে থাকায় ভূগোল বিভাগে ভর্তি হতে হয়েছে এক শিক্ষার্থীকে।

‘ভর্তি পরীক্ষায় আমি ইংরেজিতে কম নম্বর পেয়েছিলাম। সে কারণে আইন তো পাইই নাই, বরং যে তিনটি বিষয় আমাকে অফার করা হয়েছিল, ভূগোল ছিল তার মধ্যে দ্বিতীয়। প্রথম বিষয় ছিল পরিসংখ্যান সেটাও পাইনি।

শিক্ষার্থীরা মনে করেন ভর্তি পরীক্ষার পদ্ধতি পরিবর্তন না হলে এ সংকটের কোন সমাধান নেই।

বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি প্রক্রিয়া কি জটিল?

বাংলাদেশে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি প্রক্রিয়াটি বেশ জটিল বলে মনে করেন অনেক শিক্ষাবিদ। একেকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি প্রক্রিয়ার একেক রকম ধরন প্রচলিত আছে। যেমন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিজ্ঞান, কলা, সামাজিক বিজ্ঞান এবং বাণিজ্য এই চারটি অনুষদে আলাদা করে ছাত্র ভর্তি করা হয়। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই হয় অনুষদ ধরে, অথবা বিভাগ ধরে পরীক্ষা নেয়া হয়। ভর্তি পরীক্ষায় প্রাপ্ত নম্বর এবং এসএসসি ও এইচএসসি সমমান পরীক্ষায় প্রাপ্ত নম্বরের একটি গড় দিয়ে মেধাক্রম তৈরি হয়। দেখা যায়, মেধাক্রমে নিচের দিকে থাকার কারণে পছন্দসই বিভাগে পড়ার সুযোগ পান না শিক্ষার্থীরা। বিভাগ-ওয়ারী ভর্তি পরীক্ষা হয় যেসব বিশ্ববিদ্যালয়ে সেখানেও দেখা যায় আসন স্বল্পতার কারণে পছন্দসই বিষয়ে পড়তে পারে না অনেক শিক্ষার্থী।

ভর্তি প্রক্রিয়া কি পরিবর্তন প্রয়োজন?

বাংলাদেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে কত শতাংশ শিক্ষার্থী নিজেদের পছন্দমত বিষয়ে পড়াশোনা করতে পারেন, এ নিয়ে নির্দিষ্ট কোনো পরিসংখ্যান নেই। কিন্তু গবেষকেরা মনে করেন, সেই সংখ্যা সর্বোচ্চ কুড়ি শতাংশের বেশি হবে না। তবে এই প্রক্রিয়া বদলানোর আশু কোনো সম্ভাবনা নেই বলে জানিয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক মোহাম্মদ আখতারুজ্জামান।

‘এই মূহুর্তে সে রকম কোনো ভাবনা নেই আমাদের। হয়তো এমন একটা সময় আসবে, যুগের চাহিদা, বিষয়ের চাহিদা, সমাজের প্রয়োজনীয়তা- সব বিবেচনায় নিয়ে সামনের দিনে হয়তো এর পরিবর্তন আসবে।’

কেন ভর্তি প্রক্রিয়া পরিবর্তন হচ্ছে না?

বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ভিন্ন ভিন্ন ভর্তি পরীক্ষা পদ্ধতির কারণে, স্নাতক পর্যায়ে পড়তে আসবেন এমন একজন শিক্ষার্থীকে একাধিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দিতে হয়। তার ফলে শিক্ষার্থী এবং অভিভাবকদের পড়তে হয় নানা সংকটে।

২০১৭ সালে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের এক গবেষণায় দেখা গেছে, একজন শিক্ষার্থী যদি একাধিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষা দেন, বিভিন্ন বিষয়ে ভর্তি কোচিং করেন তাহলে সেগুলোসহ আনুষঙ্গিক খাতে তার ৯৬ হাজার টাকার মতো খরচ হয়। নিম্ন আয়ের অনেক শিক্ষার্থীর পক্ষে যে ব্যয় নির্বাহ সম্ভব হয় না।

এই কারণে বর্তমানে প্রচলিত পদ্ধতি পরিবর্তন করে মেডিকেল কলেজের ভর্তি পরীক্ষার আদলে একটি সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা নেবার ব্যপারে আলোচনা চলছে অনেকদিন যাবত। কিন্তু এ বছরের এপ্রিলে শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপুমনি বলেছিলেন, কয়েকটি বড় পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় নানা কারণে এই পদ্ধতির বিরোধিতা করছে। এখন যখন ২০১৯-২০ সেশনের ভর্তি পরীক্ষার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে, দেখা গেছে পুরনো পদ্ধতিতেই হচ্ছে সেটা।

বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের চেয়ারম্যান অধ্যাপক কাজী শহিদুল্লাহ জানিয়েছেন, তিনি দায়িত্ব নেবার পর বিষয়টি নিয়ে কোন আলোচনা হয়নি। তবে তিনি নিজে বর্তমান ব্যবস্থার খুব সমর্থক নন, সেটি জানিয়েছেন।

‘এ ব্যবস্থার কোনো সহজ সমাধান নেই। ব্যক্তিগতভাবে আমি এই ব্যবস্থা পছন্দ করি না। একটা হতে পারে যে বিভাগ-ওয়ারী ভর্তির ব্যবস্থা করা যায়।’

বিশ্লেষকদের অনেকে মনে করেন, ভর্তি প্রক্রিয়ার সময় শিক্ষার্থীদের কাছে বিক্রি করা ভর্তি ফর্ম থেকে দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো প্রতি বছর একটি বড় আয় করে থাকে। ভর্তি পরীক্ষার পদ্ধতি পরিবর্তনে তাদের অনাগ্রহের সেটি একটি বড় কারণ। তবে এবছর বাংলাদেশে কৃষি বিষয়ক আটটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় একইদিনে অভিন্ন প্রশ্নপত্রে সমন্বিতভাবে ভর্তি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে বলে জানিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন।

শিক্ষার্থীদের ওপর চাপ
বাংলাদেশে সামাজিক ব্যবস্থার কারণে ছেলেমেয়েদের উচ্চ শিক্ষার বিষয় পছন্দ করার ক্ষেত্রে শুরুতে পরিবারের পছন্দকে গুরুত্ব দিতে হয়। এরপরে যখন নিজের পছন্দ নয়, এমন একটি বিষয়ে পড়াশোনা করতে হয়, তখন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনার পুরো সময়টি শিক্ষার্থীদের ওপর এক বিরাট চাপ হয়ে উঠতে পারে বলে অনেকে মনে করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞানের শিক্ষক সামিনা লুৎফা মনে করেন, একজন শিক্ষার্থীর পরবর্তী শিক্ষাজীবন এবং পেশা নির্ধারণের ক্ষেত্রে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে।

‘সমাজের একটা পারসেপশন তৈরি হয় কোনটা ভালো সাবজেক্ট, কোনটা কম ভালো সাবজেক্ট। এটা সমাজে তার উপযোগিতা কী হতে পারে তার ধারণা দিয়ে তৈরি হয়। এটা শিক্ষার্থীদের ওপর চাপ তৈরি করে। পড়াশোনা থেকে শুরু করে পরবর্তীতে সে ঐ বিষয় সংক্রান্ত কোন পেশায় যাবে কিনা, সে সিদ্ধান্তও প্রভাবিত হয়।’

পূর্বকোণ/ময়মী

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট