চট্টগ্রাম রবিবার, ২৮ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

১৯৭০ সালে নির্বাচনোত্তর নেতৃত্বের অগ্নিপরীক্ষা

নাওজিশ মাহমুদ

২৯ ডিসেম্বর, ২০১৯ | ৫:০৪ পূর্বাহ্ণ

পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদে ১৯৭০ সালের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় সামরিক শাসক ইয়াহিয়া খানের অধীনে। নির্বাচন পূর্বে ১৯৭০ সালের ১২ নভেম্বর বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলে ভয়াবহতম প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাস আঘাত হানে। লক্ষ লক্ষ লোকের প্রাণহানি ঘটে। এই প্রাকৃতিক দুর্যোগে পশ্চিম পাকিস্তানের একজন রাজনৈতিক নেতাও তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের দুর্দশাগ্রস্ত জনগণকে দেখতে আসেনি। গভর্নর এডমিরাল আহসান দুর্গত এলাকা পরিদর্শনের জন্য হেলিকপ্টার চেয়েও পান নি। কেন্দ্রীয় সরকারের নিষ্ক্রিয়তা, অবহেলা ও আন্তরিকতার অভাব বাঙালিদের মনে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। ফলে বাঙালিদের মনে পশ্চিম পাকিস্তানের প্রতি ক্ষোভ ও ঘৃণা আরো বাড়িয়ে দেয়। যা নির্বাচনে প্রতিফলিত হয়। পাকিস্তান সরকার নির্বাচন পিছানোর কোন অজুহাত যাতে না পায়, সে জন্য বঙ্গবন্ধু নির্বাচন পিছানোর বিরুদ্ধে কঠোর হুশিয়ারি দেন। যদিও মাওলানা ভাসানী নির্বাচন পিছানোর দাবী করেছিলেন। তবু যথাসময়ে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়।

নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ পূর্ব পাকিস্তানের ১৬২ আসনে ১৬০টি (মহিলা আসনসহ ১৬৭) জয়লাভ করে। পিপলস পার্টি পাঞ্জাবের ৮২টি আসনের মধ্যে ৬২টি, সিন্ধুর ২৭ আসনে মধ্যে ১৮আসন, উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের ২৫টির মধ্যে ১টি আসনে জয়লাভ করে। বেলুচিস্তানে ৪টির মধ্যে কোন আসন পায়নি। সর্বমোট পশ্চিম পাকিস্তানে ১৩৮ আসনে পিপল্স পার্টি ৮১ আসনে জয়লাভ করে। এই নির্বাচনে পাকিস্তানের সামরিক সরকার কোন হস্তক্ষেপ করেনি। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে নির্বাচনে ভোট গ্রহণকারী সরকারি কর্মচারিরা প্রায় সকলে ছিল আওয়ামী লীগ তথা বঙ্গবন্ধুর সমর্থক। এই নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের ধ্বসনামানো বিজয় বিশ^কে অবাক করে দেয়। এই বিজয় পাকিস্তানের সামরিক শাসকরা ও পশ্চিম পাকিস্তানের রাজনীতিবিদদের হতভম্ব করে দেয়। সেই সাথে ভুট্টো ও সামরিক সরকারকে আতঙ্ক ধরিয়ে দেয়। আর বাঙালিকে দেয় আত্মবিশ^াস এবং পাকিস্তানের রাজনীতিতে আধিপত্য করার অপূর্ব সুযোগ। পাকিস্তানের পশ্চিমাংশের জুলফিকার আলী ভুট্টোর নেতৃত্বাধীন পিপলস পার্টির জয়লাভ, পশ্চিম পাকিস্তানের রাজনীতিতেও নতুন মেরুকরণের সম্মুখীন হয়। পাকিস্তানের পুরানো রাজনীতিবিদদের বদলে ভূট্টোর মতো এক তরুণ রাজনীতিবিদকে পশ্চিম পাকিস্তানবাসী বিশেষ করে পাঞ্জাব ও সিন্ধুর জনগণ বেছে নেয়। ভূট্টো ছিলেন সিন্ধী তবু পাঞ্জাবের জনগণও তাঁকে ভোট দেয়। কারণ পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধের পর তাশখন্দ চুক্তির বিরুদ্ধে সবচেয়ে বেশি সোচ্চার ছিল ভূট্টো। প্রেসিডেন্ট আইউবের এই তরুণ পররাষ্ট্রমন্ত্রী মন্ত্রীসভা থেকে পদত্যাগ করে রাজনীতিতে নামেন। বাম রাজনীতির পক্ষে শ্লোগান এবং ভারতবিরোধী সেন্টিমেন্টকে কাজে লাগিয়ে তিনি আইউবের বিরুদ্ধে বিষোদগার করেন। নির্বাচনপরবর্তীকালে তিনি পাঞ্জাবের আমলা এবং সামরিক বাহিনীকে প্রভাবান্বিত করেন। পাশাপাশি করাচীর পুঁজির মালিকদেরও আস্থাভাজন হয়ে উঠেন। পাকিস্তনের তরুণরাও ভূট্টোকে তাঁদের নেতা হিসেবে মেনে নেয়। ব্যতিক্রম ছিল উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশে। সেখানে মুসলিম লীগের একটি অংশ এবং ধর্মীয় গোষ্ঠীর উত্থান ঘটে। বেলুচিস্তানে ৪টির মধ্যে ৩টি ওয়ালি ন্যাপ পায়। পূর্ব পাকিস্তানে ও পশ্চিম পাকিস্তানে দুই দলের জয়লাভে পাকিস্তানের জনগণের দ্বিধাবিভক্ত রায়ে একটা জিনিষ বেরিয়ে আসে পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তানের জনগণের চিন্তা-চেতনায় বিস্তর ফারাক। পশ্চিম পাকিস্তানের বেলুচিস্তান এবং উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশে ভুট্টোর জনপ্রিয়তা অপেক্ষাকৃত কম। পাকিস্তানের ক্ষমতার কেন্দ্রভূমি পাঞ্জাব ও সিন্ধুর জনগণের সাথে বেলুচিস্তান ও উত্তর-পশ্চিম সীমান্তের জনগণ দ্বিমত পোষণ করে। পাঞ্জাবের প্রশাসনিক ও সামরিক আধিপত্য এবং সিন্ধুর করাচীর পুঁজির আধিপত্যের বিরুদ্ধে দুই প্রদেশের অবস্থান জনসংখ্যার সংখ্যাল্পতার কারণে অন্য দুই প্রদেশের নেতৃবৃন্দ কোন কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারেনি। ভোগোলিক দূরত্বের কারণে বেলুচিস্তান এবং উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের জনগণ চাইলেও বাঙালির সাথে ঐক্যবদ্ধ হতে পারছিল না।

পাকিস্তানের অখ-তা বজায় থাকলে এবং গণতন্ত্র চর্চা অব্যাহত থাকলে বাঙালিরা পাকিস্তানের শাসন ক্ষমতায় থাকতো। কিন্তু পাকিস্তানের সেনাবাহিনী এবং আমলাতন্ত্র বাঙালির শাসন চায়নি। ফলে গণতান্ত্রিক শাসন কায়েম করতে দেয়নি। পাকিস্তানে পাঞ্জাবীদের আধিপত্য বাজায় রাখতে পাকিস্তানের অখ-তা এবং গণতন্ত্র যে কোন একটিকে বিসর্জন দিতে হতো। পাঞ্জাবীদের আধিপত্য ও গণতন্ত্রের স্বার্থে অখ-তাকে বিসর্জন দিতে হয়। তাই পাকিস্তান বিভক্তি অপরহিার্য হয়ে পড়েছিল। যেহেতু বাঙালি পাকিস্তান থেকে বিভক্ত হয়ে যাওয়ায় পাকিস্তানে পাঞ্জাবীদের শাসন চ্যালেঞ্জ জানাবার আর কোন উপায় থাকলো না।

বর্তমানে পাকিস্তানের গণতন্ত্র অব্যাহত থাকলেও পাঞ্জাবীরা সংখ্যাগরিষ্ঠ। পাঞ্জাবের বাকী সকল প্রদেশ পাঞ্জাববিরোধী মনোভাব পোষণ করতো। পাঞ্জাবের বিরুদ্ধে তিনটি প্রদেশের জনগণ স্বাভাবিকভাবে বাঙালির নেতৃত্বকে স্বাগত জানাবে এটাই ছিল স্বাভাবিক। বেলুচিস্তানের জনগণ ছাড়া বাকী দুটি প্রদেশের জনগণ বহুধাবিভক্ত রায় দেয়ায় তাদের একক নেতৃত্ব গড়ে উঠে নাই। বেলুচিস্তান সংখ্যায় একবারে কম হওয়ায়, ভুট্টো ছাড়া বাকী সকলে গুরুত্বহীন হয়ে পড়ে। পাকিস্তানের ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত সামরিক শাসকেরা এবং বেসামরিক আমলাদের অধিকাংশ পাঞ্জাব থেকে আসায়, পাঞ্জাবের জনগণ ভুট্টোকে ভোট দেয়ায় স্বভাবিকভাবে পাঞ্জাবী জনগণের প্রতিনিধি হিসেবে ভুট্টো গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেন। সামরিক শাসকেরা ও বেসমারিক আমলারা মুজিবের প্রতিপক্ষ হিসেবে ভুট্টোকেই কাছে টেনে নেন। ভুট্টো এই সুযোগে পাঞ্জাবী সামরিক কর্মকর্তা ও বেসমারকি আমলাদের উপর তাঁর খবরদারী অব্যাহত রাখেন। সেইসাথে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে মোকাবিলা করার জন্য সামারিক শাসন বেসামরিক আমলা এবং করাচীর শিল্পপতিরা সকলে একজোট হয়ে যায়। ঐক্যবদ্ধ হয় আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে এবং বাঙালির বিরুদ্ধে। পাকিস্তানের রাজনীতিতে সবচেয়ে বিপজ্জনক হয়ে উঠেন ভুট্টো। কারণ সে কোন অবস্থাতেই বিরোধী দলের আসন গ্রহণ করতে রাজী নয়। বঙ্গবন্ধু কোন অবস্থাতেই তার সাথে সরকার গঠন করতে রাজী নয়। সে সরকারে থাকতে চায় কিন্তু সরকারে সংখ্যাগরিষ্ঠ নাই। তার একমাত্র ভরসা হলো সামরিক বাহিনী ও বেসমারিক আমলা। বঙ্গবন্ধুর কাছে পাকিস্তানের ক্ষমতা হস্তান্তরের ব্যাপারে সামরিক বাহিনী ও বেসামরিক আমলাদের যৎসামান্য ইচ্ছা থাকলেও ভুট্টো এককভাবে মুজিবের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের বিরোধিতা করে। ফলে এক অচলাবস্থা দেখা দেয়। ভূট্টোর অতিরিক্ত ক্ষমতার প্রতি লোভ পাকিস্তানের গণতন্ত্রের জন্য শুধু হুমকি নয়। পাকিস্তানের অস্তিত্বের জন্যও হুমকি, এটা বুঝেও এই অচলাবস্থা নিরসনের কোন রাস্তা খুঁজে পাচ্ছিল না। সামরিক শাসকেরাও বঙ্গবন্ধু মুজিবের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করবে কি করবে না এটা নিয়ে দ্বিধা-দ্বন্দ্বে ছিল। ভুট্টোর যে কোন কিছুর বিনিময়ে ক্ষমতায় যেতে হবে এই প্রশ্নে ধীরে ধীরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ও বাঙালির সাথে পাকিস্তানের ক্ষমতার ভরকেন্দ্র পাঞ্জাবের সামরিক শাসক ও আমলার সাথে বৈরী সম্পর্ককে বিচ্ছিন্নতার দিকে নিয়ে যায়। ফলে পাকিস্তানের সামরিক শাসকেরা ক্ষমতা হস্তান্তরে বিভিন্ন টালবাহানা করতে থাকে।

পাকিস্তানের পার্লামেন্টে নারী আসনসহ ৩১৩ আসনে আওয়ামী লীগ ১৬৭ আসন পেয়ে বাকী ১৪৬ এর তুলনায় মাত্র ২১ আসনে এগিয়ে থাকলে মাত্র ১১ জনের দলবদলে সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারানোর যে আশঙ্কা ছিল, তা বিবেচনায় বঙ্গবন্ধু প্রকাশ্যে নির্বাচনে এমপিদের জনসমক্ষে শপথ পড়ান। কারণ অতীতে এই দলবদলের তিক্ত অভিজ্ঞতা আমাদের রাজনীতির অনেক অর্জন ধুলিস্যাৎ হয়ে দিয়েছিল।

তবে জনগণের হিমালয়সম অটল ঐক্য, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের প্রতি জনগণের ও দলের গভীর আস্থা এই দলবদলে প্রধান বাধা ছিল। তবে সেই সাথে আশার কথা ছিল পিপলস পার্টি ব্যাতিরেকে বাকী সদস্যরা ভুট্ট্রোকে মেনে নিতে প্রস্তুত ছিল না। ফলে দলবদলের আশঙ্কা থেকে মুক্ত ছিল আওয়মী লীগের নেতৃত্ব।
তখন সামরিক সরকার বারবার চাচ্ছিল বঙ্গবন্ধুকে উসকানি দিয়ে তাঁদের পাতা ফাঁদে পা দেয়ার জন্য। যাতে বঙ্গবন্ধু আগাম বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করে। এই সুযোগে পাকিস্তানীরা তাঁর বিরুদ্ধে দেশদ্রোহের অভিযোগ এনে তাঁকে বিচারের সম্মুখীন করতে পারে। বঙ্গবন্ধু সবসময় সতর্ক ছিলেন যাতে তাঁর বিরুদ্ধে পাকিস্তানের সামরিক সরকার কোন দেশদ্রোহীতার অভিযোগ আনতে না পারে।
(আগামী রবিবার সমাপ্য)

নাওজিশ মাহমুদ রাজনীতি বিশ্লেষক ও কলামিস্ট।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট