চট্টগ্রাম শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

রায়ের বাজার বধ্যভূমি ও শহীদ বুদ্ধিজীবীদের কথা

অধ্যাপক রতন কুমার তুরী

১৪ ডিসেম্বর, ২০১৯ | ৪:৩৪ পূর্বাহ্ণ

বাংলাদেশের গণমানুষের বিজয় তখন আসন্ন। অনেক রক্তগঙ্গা পেড়িয়ে বাঙালি জাতি যখন তাদের চির আকাক্সিক্ষত বিজয়ের দ্বারপ্রান্তে ঠিক তখন রাও ফরমান আলীর নির্দেশে পাক হানাদার বাহিনী বেছে নিয়েছিল ইতিহাসের এক জঘন্যতম পথ। তারা বাংলাদেশ রাষ্ট্রটির মেধা ও মননকে চিরতরে ধ্বংস করে দেয়ার জন্য ১৪ ডিসেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েরসহ দেশের অনেক বুদ্ধিজীবীকে হত্যা করে পাশবিক কায়দায়। রায়ের বাজার বধ্যভূমি এখনো পাক হানাদার ও তাদের এদেশীয় দোসরদের চরম পাশবিকতার সাক্ষী হয়ে আছে। কি বিভৎস ছবিই না দেখেছিল সেদিন বিশ্ববাসী। এ সব বুদ্ধিজীবীদের কারো চোখ বাঁধা, কারো দু’হাত বাঁধা, কারো হাত নেই, কারো চোখ নেই। এমন নিষ্ঠুর হত্যাযজ্ঞ দেখে সেদিন বাঙালির হৃদয়ে রক্ত ক্ষরণ হলেও পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর চোখে এক ফোঁটা অশ্রুও আসেনি। তারা তাদের পরাজয় নিশ্চিত জেনেই সেদিন এমন অমানবিক হত্যাযজ্ঞ ঘটিয়ে ছিল। বাঙালির দীর্ঘ নয় মাস যুদ্ধ আর বঙ্গবন্ধুর আপোষহীন নেতৃত্ব সেদিন পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীদের বুঝিয়ে দিয়েছিল এজাতি কখনও মাথা নোয়াবে না অন্যায়ের কাছে। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের কালরাত্রি থেকে পশ্চিম পাকিস্তানি বাহিনী যেভাবে বাংলাদেশের নিরীহ মানুষের বুকে গুলি চালাতে শুরু করেছিল তার বিভৎসতা দিন দিন বেড়েই চলেছিল। সেই সময় বিশ্বমিডিয়া বাংলাদেশে কি হচ্ছে কিছুই বুঝতে পারছিল না। কারণ যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকেই পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী বিদেশি গণমাধ্যমকর্মিদের চলে যাওয়ার জন্য ভয়ভীতি প্রদর্শন করে চলেছিল এতে করে প্রায় সব বিদেশি সাংবাদিকই এদেশ ত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছিল। এরই পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশে পাকিস্তানি বাহিনী কি ধরনের বর্বরতা চালাচ্ছে তা বিশ্ববাসী আঁচ করতে পারছিল না। অবশ্য যুদ্ধের মাঝপথে এ বিষয়ে বিশ্বমিডিয়া ঠিকই জানতে পেরেছিল পাকিস্তানিদের নিষ্ঠুরতার কথা। চূড়ান্ত ভাবেই হতবাক হয়ে গিয়েছিল সারা পৃথিবী ১৪ ডিসেম্বর রায়ের বাজারের বধ্যভূমির কিছু ছবি প্রকাশিত হওয়ার পর। ছবিগুলো দেখে বিশ্বের আপামর জনগণ পশ্চিম পাকিস্তানিদের শুধু ধিক্কারই দেয়নি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে অকুণ্ঠ চিত্তে সমর্থন করতে থাকে। প্রকৃতপক্ষে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী যখন বুঝতে পারলো যে এদেশ বিজয়ের দিকেই এগিয়ে যাচ্ছে, তখন তারা শেষ কামড় দিয়ে বাঙালিদের মনোবল আরো ভেঙে দেয়ার সুপরিকল্পিত পরিকল্পনা করেছিল। আর এতে শরিক হয়েছিল এদেশের কিছু কুলাঙ্গার। এদেশি কিছু দোসর সেদিন বুদ্ধিজীবীদের পাকিস্তানি বাহিনীদের চিনিয়ে দিয়েছিল। ১৪ ডিসেম্বর রাতের অন্ধকারে এদেশিয় দোসরদের সহায়তায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই চোখ বেঁধে রায়ের বাজার বধ্যভূমিতে হত্যা করেছিল প্রায় ২৭জন বুদ্ধিজীবীদের। এসব বিদগ্ধ বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে, ড. গোবিন্দ চন্দ্র দেব, মুনির চৌধুরী, ড. জ্যোতিরময় গুহ ঠাকুরতা, শহীদুল্লাহ্ কায়সার, আলতাফ মাহমুদ, এবং জহির রায়হানের মতো সূর্যসন্তানরাও রয়েছেন। এখনও রায়ের বাজার বধ্যভূমিতে এসব বুদ্ধিজীবীদের স্মৃতিফলক আমাদের সেই দিনের বিভৎসতার কথা মনে করিয়ে দেয়।

যে সমস্ত বুদ্ধিজীবীদের রক্তের ফুলকি দিয়ে আজ আমরা স্বাধীন জাতি হিসেবে মাথা উঁচু করে বিশ্বের মানচিত্রে দাঁড়িয়ে আছি তাদেরকে যেনো আমরা কোনো দিন ভুলে না যাই। শুধুমাত্র একদিনের স্মরণসভা দিয়েই যেনো আমাদের দায়িত্ব শেষ না করি। দেশের জন্য জীবন উৎসর্গ করা আমাদের বুদ্ধিজীবীরা আমাদের গর্ব। আমাদের কর্তব্য হচ্ছে এসব বুদ্ধিজীবীদের স্মৃতিকে আজীবন ধরে রাখা। এ বিষয়ে বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়েরও কিছু করণীয় রয়েছে। তাদের উচিত বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধে ঠিক কতোজন বুদ্ধিজীবী প্রাণ হারিয়েছেন তার একটি পূর্ণাঙ্গ হিসাব প্রণয়নয় করা এবং রায়ের বাজার বধ্যভূমিকে আরো বেশি আধুনিকীকরণ করা। এর বাইরে দেশে আরো যে কয়টি বধ্যভূমি রয়েছে সেগুলোর যথাযথ সংস্কারের মাধ্যমে বুদ্ধিজীবীদের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা।

অধ্যাপক রতন কুমার তুরী কলেজ শিক্ষক, প্রবন্ধিক, মানবাধিকারকর্মী।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট